একটা জেদ ছিল মুশফিকুরের মনে
উৎপল শুভ্র
৯ মে ২০২১
দেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান, যা এনে দিয়েছে ম্যাচসেরার স্বীকৃতিও। তবে এসবের কিছুই নয়, গল টেস্টে মুশফিকুর রহিম সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কানদের প্রায় দু শ ওভার ফিল্ডিং করিয়ে। খাটিয়ে মারার এই অনুভূতিটা তো এর আগে কেবল বাংলাদেশিদের ভাগেই বরাদ্দ ছিল।
প্রথম প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।
ড্রেসিংরুমে বসে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ দেখলেন এই প্রথম। দেখে বড় তৃপ্তি পেলেন। পাওয়ারই কথা। মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি, আশরাফুলের প্রায় ডাবল, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তো এই প্রথম শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ড্র করতে পারা। না, তামিম ইকবালকে এর কোনোটাই এতটা আনন্দ দেয়নি, যতটা দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে ১৯৬ ওভার ফিল্ডিং করাতে পারা।
‘এই টেস্টে আমাদের অনেক অর্জন আছে। তবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ওদেরকে প্রায় দুই শ ওভার মাঠে খাটিয়ে মারাটা। আমাদের তো এই অভিজ্ঞতা কম হয়নি। সেটি প্রতিপক্ষকে ফিরিয়ে দিতে পেরে খুব ভালো লেগেছে’—মাঠের পাশে নেটে গত পরশু দলে যোগ দেওয়া আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করার ফাঁকে বললেন চোটের কারণে এই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়া বাংলাদেশের বাঁহাতি ওপেনার।
মুশফিকুর রহিমের তৃপ্তির খাতাতেও এটি আছে। অধিনায়ক হিসেবে দেশের বাইরে প্রথম টেস্টেই জয়ের সমান ড্র পেয়েছেন। যেটিতে তাঁর বড় অবদান। বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির আনন্দে সোনায় সোহাগা হয়ে যোগ হয়েছে ম্যাচসেরার স্বীকৃতি। এত সব অর্জনের মধ্যেও আলাদা হয়ে আছে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং করে যাওয়াটা, ‘ওরা ম্যাচের পর ম্যাচ আমাদের এই কষ্ট দিয়েছে। এবার ওদেরকে তা ফিরিয়ে দিতে পারলাম, এটা তো ভালো লাগবেই। আমার মনে হয়, ওরাও একেবারে হকচকিয়ে গেছে। এমন কিছু আশাই করেনি।’
মজাটা হলো, বাংলাদেশ একটু বেশিই ফিরিয়ে দিয়েছে। দুই দলের আগের ১২ টেস্টে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ১৩৫.৫ ওভার মাঠে রেখেছিল শ্রীলঙ্কা। এই টেস্টে বাংলাদেশ ওদের রাখল প্রায় ৬০ ওভার বেশি। অভিজ্ঞতাটা সবচেয়ে ভুতুড়ে লাগার কথা কুমার সাঙ্গাকারার। শ্রীলঙ্কার এই দলে বাংলাদেশের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন তিনিই। কিপিংই করুন বা ফিল্ডিং—খুব বেশি সময় রোদে পুড়তে হয়নি।
মুশফিকুর রহিমও অবশ্য এখানে রোদে কম পুড়লেন না। সোয়া সাত ঘণ্টারও বেশি ব্যাটিং করেছেন, উইকেটকিপিং করেছেন ২১৮ ওভার। এই টেস্টে ড্রেসিংরুমের শীতল ছায়া মিলেছে খুব কমই। স্বাভাবিকভাবেই এটি নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, বরং এটি এসেছে তাঁর কাছে আনন্দদায়ী এক অভিজ্ঞতা হয়ে। ‘হ্যাঁ, মাঠে অনেক সময় কেটেছে। আরেকটি টেস্টেও এমন হয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে দুই ইনিংসে ৭৯ ও ৯৫ রান করেছিলাম, ওরা ৪০০-৪৫০ (আসলে ৫৯৯) করেছিল। সেবারও অনেক সময় মাঠে ছিলাম। কিন্তু সেই টেস্টে হেরে যাওয়ায় খুব কষ্ট হয়েছিল। এখানে কষ্ট করলেও তৃপ্তিও আছে।’
চতুর্থ দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে ইতিহাস গড়া ডাবল সেঞ্চুরির উচ্ছ্বাসও চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। আগে অনেকবার তীরে এসে তরী ডোবার দুঃসহ স্মৃতি নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছিল না অধিনায়ককে। ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঢাকা টেস্ট ফিরে ফিরে আসছিল সামনে। সতীর্থদেরও সেটি মনে করিয়ে দিয়েছেন বারবার, ‘ওই অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে এসেছে। কাল (পরশু) খেলা শেষে এবং আজ মাঠে নামার আগেও আমি সবাইকে বলেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমাদের ড্র করার বা জেতার সুযোগ ছিল। আমরা পারিনি। এখানে গত চারটা দিন আমরা যে কষ্ট করেছি, শেষ দিনে আরও বেশি কষ্ট করতে হবে। নইলে সেটির কোনো মূল্য থাকবে না।’
এই ড্রটাকে ‘হিউজ রেজাল্ট’ বললেন বারবার। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ড্র, এটিই তা বলার জন্য যথেষ্ট। সেটি আরও বড় হয়ে উঠছে ম্যাচ-পূর্ব পরিস্থিতির কারণে, ‘অনেক চাপ ছিল। সিনিয়র অনেক প্লেয়ার ছিল না। তার ওপর গলে খেলা, যেখানে শ্রীলঙ্কার রেকর্ড খুব ভালো।’
একটা জেদও ছিল মনে, ‘শ্রীলঙ্কায় আমরা এর আগে কখনোই ভালো খেলিনি। আমাদের বিপক্ষে ওদের বোধহয় ১৯-২০টা (আসলে এই টেস্টের আগে ১৮টি) সেঞ্চুরি ছিল। মনে তাই একটা জেদ ছিল।’
চোখমুখই বলে দিচ্ছিল এই ড্রয়ে কতটা খুশি। কিন্তু বাংলাদেশ দলের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ যে পরের টেস্টে, সেটি মনে করিয়ে দিলেন নিজেই, ‘টেস্ট ক্রিকেটে আমরা খুব অধারাবাহিক। ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখাটাই আসল চ্যালেঞ্জ। আমি এখানে আসার আগেই বলেছি, আমার লক্ষ্য হলো প্রতিটি সেশন, প্রতিটি দিন ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করা। এখানে তা পেরেছি।’
বাংলাদেশের এই দলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অতীত যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি মোহাম্মদ আশরাফুলের। ব্যক্তিগত কীর্তিতে অনেকবারই উদ্ভাসিত হয়েছেন, কিন্তু দলের ব্যর্থতা সেই আনন্দকে পরিপূর্ণ হতে দেয়নি। এবার নিজের পারফরম্যান্সের সঙ্গে দলের সাফল্যও মিশে যাওয়ায় সেই আক্ষেপ অনেকটাই মুছে গেছে, ‘দল হিসেবে আমরা যে অনেক উন্নতি করেছি, এই টেস্ট তার আরেকটি প্রমাণ। মানসিকভাবেও অনেক উন্নতি করেছে দল। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, চার বছর পর আমি বোধহয় আবার এমন ভালো খেললাম, দলও ড্র করেছে।’
সেই ড্রয়ে উইকেটের বড় ভূমিকা দেখছেন অনেকে। হয়তো তা আছেও। তবে দলের সঙ্গে আসা নির্বাচক হাবিবুল বাশার মনে করিয়ে দিলেন, ‘এমন ব্যাটিং উইকেট আমরা আগেও পেয়েছি। কী করেছি তাতে? আর উইকেট যেমনই হোক, প্রতিপক্ষ ৫৭০ রান করে ফেললে যেকোনো দলের ওপরই চাপ চলে আসে। সেখানে আমরা লিড নিয়েছি, এটা সহজ ব্যাপার নয়।’
তা তো নয়ই। গলে এত এত টেস্ট ম্যাচ হয়েছে। সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা বাংলাদেশের—এটাই কি আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে না বাংলাদেশের কীর্তিটা!
আরও পড়ুন...
ভুল মুশফিক, ঠিক মুশফিক!
দুই তরুণের 'স্বপ্নের অভিষেক'
বিজ্ঞাপন বলতে ওই মুশফিকুর রহিমই
বগুড়ার টেস্ট অভিষেকে তো থাকাই উচিত মুশফিকুরের