‘ইতিহাসে’র মুশফিক ইতিহাসে
উৎপল শুভ্র
৯ মে ২০২১
তিনি ইতিহাসে এমএ। ২০১৩ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে সেই মুশফিক নিজেই হয়ে গেলেন ইতিহাস। ইতিহাসের ওই অধ্যায়ের নাম? বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান!
প্রথম প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।
ক্রিকেট চলে তার আপন খেয়ালে। কাকে কী দেবে, সেটিও ঠিক করে রাখে তার মতো করে। ৭৬তম টেস্টে এসে প্রথম দেখা মিলবে ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের—এই উন্মুখ প্রতীক্ষায় কাল ঘুম ভেঙেছিল বাংলাদেশের। সেই প্রতীক্ষা শেষও হলো। তবে মোহাম্মদ আশরাফুল নন, টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা করলেন মুশফিকুর রহিম।
‘ইতিহাস’ শব্দটা এসব ক্ষেত্রে খুব উচ্চারিত হয়। হওয়াই উচিত। কাকতালীয়ভাবে সেই ইতিহাস যিনি গড়লেন, সেই মুশফিকুর রহিম ইতিহাসেই এমএ! ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচির মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য অনন্য এক উদাহরণ গড়েছেন। উদাহরণ গড়লেন ক্রিকেট মাঠেও। এখন থেকে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছেও মোক্ষধাম হয়ে থাকবে মুশফিকুর রহিমের এই ডাবল সেঞ্চুরি।
অধিনায়ককে এমন উদাহরণই রাখতে হয় সতীর্থদের সামনে। ইতিহাস গড়ে সংবাদ সম্মেলনেও এলেন যেন ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর নন। অধিনায়ক মুশফিকুর। ব্যক্তিগত অর্জনের প্রসঙ্গে যতটুকু উচ্ছ্বাস না দেখালেই নয়, দেখালেন সেটুকুই। বরং যতবার নিজের কীর্তির কথা বললেন, টেনে নিয়ে এলেন দলের কথা, ‘ভালো লাগছে। তবে কালকের দিনটাও যদি ভালো হয়, সবচেয়ে বেশি খুশি হব তখন। এর আগে আমরা ব্যক্তিগত অনেক মাইলফলকের পর অনেক সময় ইনিংসেও হেরেছি। এবার যদি ভালোভাবে টেস্টটা শেষ করতে পারি, তাহলেই শুধু খুশি হব।’
এত দিন উইকেটকিপার ও অধিনায়কের যুগল ভূমিকায় টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি ছিল শুধু একজনেরই। গত মাসেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেছেন তা ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনি। মুশফিকুর রহিমের কীর্তিটা কত বড়, এটিই তা বুঝিয়ে দিচ্ছে পরিষ্কার।
তবে বিস্ময়ের কিছু বোধ হয় নেই। উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে কিছুদিন আগেও হয়তো প্রশ্ন ছিল, কিন্তু ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে কখনোই নয়। টেস্ট অভিষেক হয়েছিল স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের ভূমিকায়। মাস দশেক পর দ্বিতীয় টেস্টটিও খেলেছিলেন নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান হিসেবেই। ২০০৭ সালে তৃতীয় টেস্টে এসে এই শ্রীলঙ্কাতেই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক। সেই শ্রীলঙ্কাতেই অধিনায়ক হিসেবে দেশের বাইরে প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় করে রাখলেন নিজের নাম।
অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর নিজের ব্যাটিংকে নিয়ে গেছেন আরও এক ধাপ ওপরে। বাড়তি দায়িত্বটা যে তাঁর ব্যাটকে আরও শাণিত করেছে, সেটির প্রমাণও এই ডাবল সেঞ্চুরি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যে ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ছিল ১১৫, টেস্টে তিনিই কিনা করে ফেললেন ডাবল সেঞ্চুরি! মুশফিকুরও একটু বিস্মিত হয়ে থাকলেও তাঁর প্রতিক্রিয়ায় তা বোঝার উপায় নেই, ‘সুযোগ এসেছিল, আমি তা কাজে লাগিয়েছি।’
আগের দিন মোহাম্মদ আশরাফুল জানিয়ে গেছেন, বাংলাদেশ দলে ঢোকার পর থেকেই তাঁর দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা করার স্বপ্ন। মুশফিকুরের এমন কোনো স্বপ্ন-টপ্ন ছিল না, স্বপ্ন ছিল শুধু লম্বা একটা ইনিংস খেলার। এখানেও সতীর্থদের অবদানের কথা বললেন সবিস্তারে, ‘আমার স্বপ্ন ছিল লম্বা সময় ধরে খেলে বড় একটা হান্ড্রেড করার। আশরাফুল ভাইয়ের সঙ্গে বড় একটা পার্টনারশিপ হলো। উনি আমাকে বারবার বলছিলেন, উইকেট খুব ভালো। এখানে সিলি শট না খেললে আউট হওয়া কঠিন। আজ নাসিরের সঙ্গেও ভালো একটা জুটি হয়েছে বলেই সম্ভব হয়েছে এটি করা।’
নিজের কীর্তির আনন্দ আছে, সঙ্গে আশরাফুলের জন্য সমবেদনাও, ‘উনি এত ভালো খেলেছেন! ডাবল সেঞ্চুরিটা ওনার প্রাপ্য ছিল। যে শট খেলে আউট হয়েছেন, ওই শটে কিন্তু উনি অনেক রানও করেছেন। ওনার জন্য সত্যি খুব খারাপ লাগছে।’ গত পরশু ১৫২ রানে অপরাজিত থাকার পর ডাবল সেঞ্চুরির কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন নিজেও। তবে ‘প্রথম’-এর কীর্তিটা আশরাফুলেরই হবে বলে ভেবেছিলেন, ‘গতকাল (পরশু) ডিনারের সময় ওনাকে বলছিলাম, আপনার যখন ২৫০ হবে, আমার হবে ২০০। সেদিন ব্যাটিংয়ের সময়ও আমরা এমন বলছিলাম। অ্যাশ বলছিল, "আমার যখন ১৫০ হবে, তোর হবে ১০০।"
লাঞ্চের সময় ১৯৮ রানে অপরাজিত। কেমন কেটেছে সেই সময়টা? নাসিরের কথাটা খুব কাজে এসেছে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময়, ‘লাঞ্চের আগেই ডাবল সেঞ্চুরিটা করে ফেলতে চেয়েছিলাম। ৪০ মিনিটের একটা ব্রেক তো অনেক বড়। নাসির বলল, “১৯৮ রান যখন করতে পেরেছেন, বাকি ২ রানও করতে পারবেন।” আমিও ভাবলাম, ঠিকই তো। আমি তো ডাবল সেঞ্চুরি করার পর ২৫০ রানের টার্গেট করব।’
তা আর হয়নি। ডাবল সেঞ্চুরি করার পরের বলেই আউট হয়ে গেছেন। ফেরার সময় শরীরী ভাষাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন হতাশাটা। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তটা নিয়ে একটু সংশয় ছিল বলে হতাশাটা হয়তো আরও বেশি হয়েছে। দিন শেষে অবশ্য দার্শনিকতায় আশ্রয় নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজলেন, ‘হয়তো বলটা (স্টাম্পে) লাগত না। তবে এমন একটা সিদ্ধান্ত তো আমি ২০০ করার আগেও পেতে পারতাম।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। অটোগ্রাফ নেওয়ার একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। মুশফিকুর রহিমকে মাঝখানে নিয়ে ছবিও তোলা হলো। ইতিহাসের সাক্ষী থাকার আনন্দটাও যে কম নয়!
আরও পড়ুন:
ভুল মুশফিক, ঠিক মুশফিক!
দুই তরুণের 'স্বপ্নের অভিষেক'
বিজ্ঞাপন বলতে ওই মুশফিকুর রহিমই
বগুড়ার টেস্ট অভিষেকে তো থাকাই উচিত মুশফিকুরের