হাতির রাজ্যে উড়ন্ত ময়ূর

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

২০ এপ্রিল ২০২১

হাতির রাজ্যে উড়ন্ত ময়ূর

আমাকে শ্রীলঙ্কান ভাবার ভুলটা অনেকেই করেন, শেন ওয়ার্নও তো করেছেন। তবে এই শ্রীলঙ্কান-শ্রীলঙ্কান চেহারা একবার উপকারও করেছে। উদাওলাওয়ে ন্যাশনাল পার্কে ঢুকতে পেরেছিলাম স্থানীয়দের জন্য নির্ধারিত প্রবেশমূল্যেই। আলিয়ার রাজ্যে উড়ন্ত মোনারাও প্রথম দেখেছিলাম সেখানেই। এই আলিয়া আবার কী? মোনারা? প্রাণীদের ওই অভয়ারণ্যে গিয়েই আমি তা জেনেছি, আলিয়া আর মোনারা কী। আপনি না হয় লেখাটা পড়েই জানুন।

প্রথম প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

আলিয়া দেখে শুরুর যে উত্তেজনা, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা একটু থিতিয়ে গেল। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই তো আলিয়া! মা আলিয়ার গা ঘেঁষে ছোট্ট বাচ্চা (ছোট্ট! এটিও তো আকারে বিশাল)। একটু পরপরই আলিয়াকুলকে রাস্তা পেরোনোর সুযোগ দিতে থামাতে হচ্ছে জিপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলিয়া-দর্শনটা এমন ডালভাত হয়ে গেল যে যেন গ্রামের বাড়িতে হাঁস-মুরগি দেখছি!

এই ‘আলিয়া’ বস্তুটা আসলে কী? হাতি রে ভাই, হাতি! বাংলায় হাতি সিংহলিজে (শ্রীলঙ্কানরা অবশ্য বলে সিংহলা) হয়ে যায় আলিয়া। সেই ‘আলিয়া’ দেখতেই কাল ভোরে উঠে উদাওলাওয়ে (উচ্চারণটা এমন বিদঘুটে যে কাল নামটা ভুল লিখেছিলাম) ন্যাশনাল পার্কে। হাতির জন্যই বিখ্যাত এই অভয়ারণ্য। তবে শুধু হাতিই নয়, দেখলাম আরও অনেক কিছুই—মোনারা, মিহারকা, উয়ান্দুরা, মোয়া ইত্যাদি।

এখানেও বঙ্গানুবাদ লাগছে। মোনারা মানে ময়ূর, মিহারকা মহিষ, উয়ান্দুরা বানর আর মোয়া হলো হরিণ। তা হঠাৎ এমন সিংহলিজে আক্রান্ত কেন? কারণ তো আছেই। কাল সকালে যে সিংহলিজ ভাষার ওপর একটা শর্টকোর্স করতে হলো! পার্কে তো ঢুকলাম শ্রীলঙ্কান পরিচয়ে!

তাঁর হোটেলে থাকছি শুনেই রমেশ কালুভিতারানা বলে দিয়েছিলেন, ন্যাশনাল পার্কে গেলে যেন বিদেশি পরিচয়টা না দিই। শ্রীলঙ্কায় এর আগে আরও অনেকবার শোনা কথাটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে দেখতে একদম শ্রীলঙ্কানদের মতো লাগে।

যাক, এত দিনে সেই শ্রীলঙ্কান-শ্রীলঙ্কান চেহারাটার একটা অর্থকরী ব্যবহার হলো! ঘটনা হলো, শ্রীলঙ্কানদের জন্য উদাওলাওয়ে ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশমূল্য এক শ টাকারও কম। বিদেশিদের জন্য সেটিই প্রায় ছয় হাজার টাকা। তাতে কি! তুচ্ছ অর্থের কারণে নিজের জাতীয়তা বিসর্জন দেব—এমন কুলাঙ্গার আমি নই। একবার দার্জিলিং থেকে গ্যাংটক যাওয়ার সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেও শুধু এ ব্যাপারে আপস করতে রাজি হইনি বলে আর যাওয়াই হয়নি। বিদেশিদের কী একটা বিশেষ অনুমতি নিতে হয়, যাতে অনেক ঝামেলা। ট্যুর অপারেটর, হোটেলের লোকজন সবাই তাই পরামর্শ দিয়েছিল, তুমি তো বাংলাই বলো। বলবে, তুমি ভারতীয়, কলকাতা থেকে এসেছ। এই প্রস্তাব আমার জাতীয়তাবোধে এমনই লেগেছিল যে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করে আমি তা প্রত্যাখ্যান করি।

পার্কে ঢুকতে না ঢুকতেই জিপের সামনে এক পাল আলিয়া, মানে হাতি আর কি!

কাল রাজি হয়ে গেলাম কালুর হোটেলের ম্যানেজারের যুক্তিতে। ইউরোপ-আমেরিকার পাউন্ড-ইউরো-ডলারের দেশ থেকে যারা আসে, তাদের কাছে তো ওই ছয় হাজার টাকা কিছুই না। ওদের কাছ থেকে ডলার-পাউন্ড খসানোর জন্যই এই নিয়ম। আপনি কেন অকারণে এতগুলো টাকা দিতে যাবেন? সবচেয়ে মোক্ষম যুক্তি হয়ে এল, আপনাকে তো জিজ্ঞেসই করবে না আপনি বিদেশি কিনা!

কিন্তু টিকিট তো কাটতে হবে। সাফারি জিপের ড্রাইভার শিখিয়ে দিলেন, কাউন্টারে গিয়ে বলতে হবে ‘দেনা টিকিট দেক্কা’। মানে ‘দুটি টিকিট দাও’। সেটি মুখস্থ করতে করতে গেলাম। সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তর পর্বের আরও কিছু অনুশীলন হলো যাত্রাপথে। ‘কিয়েদা’ শব্দটাও শেখা হলো। যার অর্থ ‘কত দাম?’ যদি টিকিটের দাম জিজ্ঞেস করতে হয়!

টিকিট কাটাপর্ব নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হলো। সমস্যাটা হলো জিপে সঙ্গী হওয়া ন্যাশনাল পার্কের গাইডকে নিয়ে। গাইডের ইংরেজি জ্ঞান আমার সিংহলিজ জ্ঞানের চেয়েও খারাপ। ঠিকই আছে, শ্রীলঙ্কানের সঙ্গে তো আর ইংরেজি জানা গাইডের দরকার নেই। এ-গাছে ও-গাছে পাখি দেখিয়ে গাইড মহোদয় সিংহলিজে চিত্কার করছেন, আমি তো কিছুই বুঝি না। ‘আলিয়া’ বলে চিৎকারটা অবশ্য ঠিকই বুঝলাম। জিপচালক যে আগেই তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন! না শেখালেও সমস্যা ছিল না। গাছে বসে থাকা পাখি চিনতে নামটা বোঝা জরুরি, হাতি চিনতে কি আর নামে কিছু আসে-যায় নাকি!

পার্কে ঢুকতে না-ঢুকতেই জিপের সামনে মেঠোপথে দুটি ময়ূর। ময়ূর আমাকে সব সময়ই বিস্ময়বোধে আক্রান্ত করে—কোন শিল্পীর তুলিতে এত সুন্দর কারুকাজ! হাতির মতো অমন অগণ্য না হলেও ময়ূরও খুব কম দেখলাম না। কিন্তু একটা আফসোস কিছুতেই যাচ্ছিল না। পেখম না মেললে কি আর ময়ূর ময়ূর হয়! কোথায় যেন শুনেছিলাম, মেঘ ডাকলেই শুধু ময়ূর পেখম মেলে। সাতসকালের রোদেই শরীর পুড়ে যাচ্ছে, মেঘ ডাকবে কোত্থেকে! ওই জানাটা যে কত বড় ভুল ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই পরম বিস্ময়ে তা আবিষ্কার করলাম। রাস্তার মাঝখানে পেখম তুলে দাঁড়িয়ে একটা ময়ূর!

ময়ূর যে উড়তে পারে, এটাও আমার জানা ছিল না। রাস্তা থেকে উড়ে গিয়ে একটা ময়ূর যখন গাছের ডালে গিয়ে বসল, আমার তাই বিস্ময়ের সীমা থাকল না। ১১৯ বর্গমাইল আয়তনের এই অভয়ারণ্যে আড়াই শ হাতির বাস। জিপে ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরির প্রায় পুরো সময়টাই তাই হাতি চোখে পড়ল। বেশ কয়েকবার তো জিপের উইন্ডস্ক্রিনজুড়ে হাতি! তিন-চারটা চিতাবাঘও নাকি আছে। কিন্তু এত বড় বনে তাদের খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সেই ভাগ্য হলো না।

মেঠোপথে হঠাৎই সামনে চলে এলো পেখম তোলা ময়ূর। ছবি: ডিপোজিট ফটোস

আফসোস করে আর কী হবে, হাতি তো দেখলাম ইচ্ছামতো। নিঃসঙ্গ হাতি, দলবদ্ধ হাতি। পুরুষ হাতির খুব ডাঁট। একা একা ঘোরে। মেয়ে হাতি আর হাতির বাচ্চারা ঘোরে দল বেঁধে। হাতির বাচ্চা দেখার জন্য অবশ্য আলাদা একটা জায়গাই আছে। যেটিকে বলতে পারেন ‘হাতির এতিমখানা।’ শিকারিদের হাতে মাতৃহীন হাতির বাচ্চাগুলোর আশ্রয় মেলে এই ‘এলিফ্যান্ট ট্রানজিট পয়েন্ট’-এ। হাতির বাচ্চাগুলোর জন্য এটা ‘ট্রানজিট’ই। বয়স পাঁচ হওয়ার পর এগুলোকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় জঙ্গলে। মনুষ্যসমাজের কোনো গন্ধ-টন্ধ পেলে হাতিসমাজ যদি ওদের একঘরে করে রাখে, ছেড়ে দেওয়ার আগে তাই ‘গোসল’ করানো হয় হাতির বিষ্ঠা দিয়ে।

সবচেয়ে মজা লাগল বাচ্চা হাতিগুলোকে খাওয়ানোর দৃশ্য দেখে। একটা একটা করে হাতির বাচ্চা এসে শুঁড় তুলে হাঁ করছে। সেখানে পাইপ দিয়ে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে দুধ। খেয়ে আবার লক্ষ্মী ছেলের, সরি, লক্ষ্মী হাতির মতো চলে যাচ্ছে দূরে।

এতিমখানায় হাতির বাচ্চাদের খাওয়ানোর দৃশ্য দেখতে আলাদা টিকিট লাগে। ‘দেনা টিকিট দেক্কা’য় এখানেও জাদুমন্ত্রের মতো কাজ। তবে ভেতরে ঢোকার পর সঙ্গী সাংবাদিকের চেহারাছবি ও গায়ের রঙের কারণে একটু সমস্যা হলো। সামান্য বিব্রতকর ব্যাপার মিশে আছে বলে সেটি আর নাই-বা বলি!

২৩ মার্চ ২০১৩। হাম্বানটোটা।

আরও পড়ুন:

হাম্বানটোটার প্রেসবক্সে বৃষ্টির অবসরে

হাম্বানটোটায় কালুভিতারানার অতিথি

প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা

প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে

সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম

হনুমানের ফেলে দেওয়া টুকরো থেকে যেটির সৃষ্টি

তুমি সাগর অনন্ত মুগ্ধতার

বিশ্বের প্রথম সুড়ঙ্গ মন্দিরে বুদ্ধ শরণে

মাতারা হারিকেনের সঙ্গে মাতারায়

যত কাণ্ড মাতারায়

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×