যত কাণ্ড মাতারায়

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

যত কাণ্ড মাতারায়

কানে মশককূলের গুনগুন সঙ্গীতে মশারির খোঁজ পড়ল। হোটেল বয় ‘সুসংবাদ’ দিল, মশারি বলে কোনো বস্তু এই হোটেলে নেই। ঠিক আছে, কী আর করা! অ্যারোসল-ট্যারোসল স্প্রে করলেই হবে। জানা গেল, সেটিও এই হোটেলে বাহুল্য বলে বিবেচিত। তাহলে উপায়?

প্রথম প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

ঢাকা-কলম্বো আকাশপথেই বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ভবিষ্যতে মিহিন লঙ্কায় কোথাও গেলে অবশ্যই খাবারদাবার নিয়ে উঠব। কারণ ভরদুপুরে ‘লাঞ্চ’ হিসেবে মিহিন লঙ্কা যা দেয়, সকালের নাশতা হিসেবেও সেটি অপর্যাপ্ত। ছোট্ট একটা প্যাকেটে দুই হাতা ভাত, সঙ্গে মুরগির সম্ভাব্য ক্ষুদ্রতম দু-তিনটি টুকরা। টুকরোগুলো বোধ হয় মেশিনে করা। হাতে অমন সূক্ষ্ম কাজ করা কঠিন।

ও হ্যাঁ, সঙ্গে একটা চকলেটও ছিল। মাঝখানে রক্তে শর্করার পরিমাণ একটু মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখে খাদ্যতালিকা থেকে যেটি অনেক দিনই বাদ। এখানে না খেয়ে উপায় থাকল না। কিন্তু চকলেটে কি আর পেট ভরে! তিন ঘণ্টার ফ্লাইটের মাঝপথে স্বল্পাহারের বিজ্ঞাপন ওই ‘লাঞ্চ’ খেয়ে গত পরশু বিকেলে তাই কলম্বোতে নামার সময় পেটে দাউদাউ আগুন। 

মাস ছয়েক আগে শ্রীলঙ্কায় ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি কাভার করতে আসার সময়ও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবে সেবার নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। এর আগে যতবার শ্রীলঙ্কা এসেছি, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর ঘুরে আসতে হয়েছে। এই বিড়ম্বনা থেকে মিহিন লঙ্কা মুক্তি দিয়েছে, সেটিকেই তখন বড় করে দেখেছিলাম। এবার তা না পারার একটা কারণ হলো, অন্যবারের মতো এবার কলম্বো নেমেই হোটেলের আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার কলম্বো থেকেই আসলে শুরু আসল জার্নি।

সফরে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ কলম্বো থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরের মাতারা। ঢাকা থেকেই গাড়ি ঠিক করা ছিল। তবে বিমানবন্দর নেমে সেই গাড়িতে উঠতে উঠতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল! ডলার ভাঙাও, মোবাইলের সিমকার্ড কেনো, ইন্টারনেটের মডেম কেনো—খেলা কাভার করাটা যদি ‘যুদ্ধ’ হয়, এসব হলো সেই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র। 

সেসবে সজ্জিত হওয়ার পর গাড়ি আবার থামাতে হলো পেটের আগুন নেভাতে। এয়ারপোর্ট কলম্বো শহরের এক দিকে, মাতারা উল্টো দিকে। এয়ারপোর্ট থেকে কলম্বো শহরই ৩৪ কিলোমিটার। শহরে ঢোকার আগেই পড়লাম অফিস টাইমের ভয়াবহ জ্যামে। সেটি পেরিয়ে কলম্বো-গল চোখ ধাঁধানো হাইওয়েতে উঠতেই তাই ঘণ্টা তিনেক লেগে গেল। মাতারা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১০টা পার। হোটেল একটা ঠিক করাই ছিল। কিন্তু রুমে ঢোকার পর আবার নতুন করে পুরোনো উপলব্ধিটা হলো, ছবিতে সবকিছুই সুন্দর দেখায়! 

ঢাকায় বাসা থেকে বেরিয়ে মাতারার হোটেল রুমে ঢুকতে ঢুকতে ১২ ঘণ্টা হয়ে গেছে। কাপড়চোপড় না পাল্টেই বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিতেই কর্ণকুহরে মশার গুনগুন সংগীত। স্বাভাবিকভাবেই মশারির খোঁজ পড়ল। হোটেল বয় ‘সুসংবাদ’ দিল, মশারি বলে কোনো বস্তু এই হোটেলে নেই। ঠিক আছে, কী আর করা! অ্যারোসল-ট্যারোসল স্প্রে করলেই হবে। জানা গেল, সেটিও এই হোটেলে বাহুল্য বলে বিবেচিত। তাহলে উপায়?

হোটেল বয় সমাধান বাতলে দিল, দরজা বন্ধ রাখলেই হবে। তাতে মশককুলের নতুন কোনো সদস্যের গৃহপ্রবেশ না হয় ঠেকানো গেল, কিন্তু এরই মধ্যে যাঁরা রুমে অননুমোদিত বোর্ডার হিসেবে চেক ইন করেছেন, তাঁদের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? যতই এই প্রশ্ন করি, প্রতিবার একই উত্তর, দরজা বন্ধ রাখলেই হবে। কিষান নামের ওই হোটেল বয়কে ইংরেজিতে কিছু বোঝানো ও ইংরেজিতে সেটির উত্তর দিতে ওর প্রাণান্তকর অবস্থা দেখে মশার কামড় খাওয়াটাকেই ভবিতব্য মেনে নিয়ে ওকে বিদায় করা হলো। সঙ্গে সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত—রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে সকালে প্রথম কাজ হবে ভালো একটা হোটেল খুঁজে বের করা।

হোটেল নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে মন ভালো করে দিয়েছিল মাতারার পলহেনা বিচ

আজ সকালটা তা করতেই গেল। তা-ও ভাগ্য ভালো, পাশেই মোটামুটি মানের একটা হোটেল পাওয়া গেল। রাতের আঁধারে গণ্ডগ্রাম মনে হওয়া জায়গাটাও দেখি সকালে ঝলমল করে হাসছে। সামনে পলহেনা বিচ। সোনালি বালুর সেই সৈকতে মেলা বসেছে। বাস ভরে পর্যটক এসেছেন। তবে বিদেশি কাউকে দেখলাম না। সৈকতে ও নীলাভ সাগরের পানিতে শ্রীলঙ্কানদেরই ভিড়।

মাতারা শহরটাও মুগ্ধ করার মতো। সেই শহরকে ক্রিকেটীয় মানচিত্রে তুলে দেওয়া বাঁহাতির বাড়িতেও ঘুরে এলাম দুবার। দ্বিতীয়বার সনাৎ জয়াসুরিয়ার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও দু-একটার বেশি কথা হলো না। ইংরেজি বলতে পারেন না। আশপাশে অনুবাদকের খোঁজও পাওয়া গেল না। দেখি, আজ কাউকে যদি জোগাড় করতে পারি, আবার না হয় যাব। 

পুনশ্চ: কলামটার নাম কী দেওয়া যায়, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর চূড়ান্ত হওয়া নামটা শুনে আমার কৈশোরকালীন ও কৈশোর-উত্তর কর্মকাণ্ডের সহচর এক বন্ধু হাসতে হাসতে বলেছে, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ’ কথাটা তোর ক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন হবে। এটা হওয়া উচিত ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় বান্দর!’ বলা বাহুল্য, আমি একমত হইনি।

২ মার্চ ২০১৩। মাতারা।

আরও পড়ুন...
মাতারা হারিকেনের সঙ্গে মাতারায়

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×