সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম

এত সুন্দর গল ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে দিয়েছিল সুনামি। সেদিন এই মাঠে সাউদার্ন প্রভিন্স ও ইংল্যান্ডের হ্যারো স্কুলের মধ্যে অনূর্ধ্ব-১৯ একটা ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে নয়টায়। সুনামি এলো ৯টা ২৬ মিনিটে। আর মিনিট পাঁচেক পর ঘটনাটা ঘটলে ক্রিকেটাররা সব ভেসে চলে যেত। ভেসে যেত একটা যোগাযোগ-বিভ্রাট না হলেও।

প্রথম প্রকাশ: ৭ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

বিশ্বের সুন্দরতম ক্রিকেট মাঠ কোনটি? অস্ট্রেলিয়ানরা বলবে, অ্যাডিলেড ওভাল। দক্ষিণ আফ্রিকানরা কেপটাউনের নিউল্যান্ডস। না, এটিকে শুধু অস্ট্রেলিয়ান বা দক্ষিণ আফ্রিকানদের দেশপ্রেমের প্রমাণ হিসেবে দেখাটা ভুল হবে। তৃতীয় কোনো দেশের ক্রিকেট-দর্শকের প্রিয় মাঠ হিসেবেও এই দুটি নামই ঘুরেফিরে আসে। গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামও কি এর সঙ্গে যোগ হবে?

দুই পাশে সাগর, প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়িয়ে গলের বিখ্যাত দুর্গ—গল স্টেডিয়ামটা আসলেই চোখের জন্য এক প্রশান্তি। এবং একটা জায়গায় অ্যাডিলেড ওভাল বা নিউল্যান্ডসের চেয়ে গল এগিয়ে। এই মাঠের এমন একটা গল্প আছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো মাঠের নেই। পুনর্জন্মের গল্প!

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামি আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস করে দিয়েছিল এই মাঠ। ভেঙে দিয়েছিল জয়ানন্দ বর্ণবীরার হৃদয়ও। সুনামির পর ক্ষতবিক্ষত, ময়লা-আবর্জনায় ভরা মাঠ দেখে তিনি হাহাকার করে উঠেছিলেন, ‘সুনামি আমাকেও কেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল না!’

কাল দুপুরে গল স্টেডিয়ামে নিজের বিশাল অফিস রুমে এ কথা বলার সময়ও বর্ণবীরার মুখে সেই দুঃস্বপ্নের ছায়া পড়ল। সুনামির সেই ভয়াল দিনে তিনি স্টেডিয়ামেই ছিলেন। সাউদার্ন প্রভিন্স ও ইংল্যান্ডের হ্যারো স্কুলের মধ্যে অনূর্ধ্ব-১৯ একটা ম্যাচ শুরু হবে হবে, তখনই ধেয়ে এল সাগর।

 সাগরপাড়ের  গল স্টেডিয়াম। নয়নাভিরাম কথাটা এসব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হওয়া উচিত। ছবি: লুপিএলকে

যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। বর্ণবীরা এর মধ্যেও ‘মন্দের ভালো’ খুঁজলেন, ‘ম্যাচটা শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল সাড়ে নয়টায়। সুনামি এলো ৯টা ২৬ মিনিটে। আর মিনিট পাঁচেক পর ঘটনাটা ঘটলে ক্রিকেটাররা সব ভেসে চলে যেত।’

ভেসে চলে যেত একটা যোগাযোগ-বিভ্রাট না ঘটলেও। ম্যাচ শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল ১০টা। হ্যারো স্কুল থেকে তা নয়টায় শুরু করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু আম্পায়ারদের তা সময়মতো জানানো হয়নি বলে দুই দল মাঠে আসার পর সাড়ে নয়টায় খেলা শুরুর ব্যাপারে মতৈক্য হয়। নয়টায় খেলা শুরু হলে এই মাঠ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকত।

জয়ানন্দ বর্ণবীরার পরিচয়টা এখানে দিয়ে নেওয়া ভালো। গল মাঠের কিউরেটর পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর ক্রিকেটার সত্তা। অথচ গল থেকে টেস্ট খেলা প্রথম ক্রিকেটার এই অফ স্পিনার। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ১০টি টেস্ট ও ৬টি ওয়ানডে খেলেছেন। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন না উঠলে হয়তো আরও খেলতেন। তাঁর ব্যাখ্যা অবশ্য অন্য রকম। ১৯৯৩ সালে খেলোয়াড়ি জীবনেই নির্বাচন করে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাহী কমিটিতে ঢুকেছিলেন। ‘খেলোয়াড় এবং প্রশাসক’ যেকোনো একটা ভূমিকা বেছে নিতে বলায় খেলা ছেড়ে দেওয়াটাই তাঁর কাছে ভালো মনে হয়।

সুনামি এমন ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে দিয়েছিল গল ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে। ছবি: অ্যাসোসিয়েট প্রেস

গল ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ২৫ বছর। অধিনায়ক ছিলেন, সঙ্গে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে করেছেন কিউরেটরের কাজও। এখনো করেই যাচ্ছেন। অথচ এখন তিনি সাউদার্ন প্রভিন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের নির্বাহী কমিটিরও সদস্য। এখনো কিউরেটরের কাজটা তাহলে কেন করেন? বর্ণবীরার বড় বড় চোখ যেন আরও বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে, ‘কী বলেন! এটাই আমার জীবন। এই স্টেডিয়ামই আমার ঘরবাড়ি। সকাল সাড়ে ছয়টা-সাতটায় আসি, মাঝরাতে ফিরে যাই।’

সুনামির পর আবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানচিত্রে ফিরে আসতে যে অনেক অনিশ্চয়তা পাড়ি দিতে হয়েছে এই স্টেডিয়ামকে, সেই গল্পও বললেন। সুনামির ভয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা সাগরের কাছাকাছি কোনো স্থাপনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার পর সেটি তুলে নেন। তার পরও বাধা ছিল, স্টেডিয়ামের একটা অংশ ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গল দুর্গকে আড়াল করে দিচ্ছে বলে এটি নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব বাধা জয় করে আবার ক্রিকেট মানচিত্রে ফিরে এসেছে গল স্টেডিয়াম। শেন ওয়ার্ন ও ইয়ান বোথাম আর্থিক সহযোগিতা করেছেন, সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিলেন রাজাপক্ষে নিজেই। নতুন প্যাভিলিয়নটা তাই তাঁর নামেই হয়েছে।

শেন ওয়ার্ন বা মুত্তিয়া মুরালিধরনের নামেও কিছু একটা হতে পারত। এই মাঠেই ওয়ার্নের ৫০০তম টেস্ট উইকেট। মুরালির শেষ টেস্ট ও ৮০০তম উইকেটও।

৬ মার্চ ২০১৩। গল।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×