প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা

কলম্বোর প্রাণকেন্দ্রের একটু বাইরে এই জায়গাটার নাম খেত্তারামা। শুরুতে স্টেডিয়ামটার নামও ছিল খেত্তারামা স্টেডিয়াম। ১৯৯৪ সালের জুনে এটির নতুন নামকরণ করা হয় রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। আগের বছরই আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা গেছেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট। তাঁর স্মৃতি অমর করে রাখতে স্টেডিয়ামকে বেছে নেওয়ার কারণ আছে। এই স্টেডিয়ামটা মূলত রানাসিংহে প্রেমাদাসার উদ্যোগেই নির্মিত। যে স্টেডিয়াম অনেক স্মৃতির সাক্ষী। বিশ্ব রেকর্ডেরও।

প্রথম প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

গলের প্রেসবক্সে বসে খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে সাগর-দর্শনও হতো। অভিজ্ঞতাটা ছিল নতুন। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের পাশে সাগর নেই। তবে এটিও উপহার দিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। গত পরশু সন্ধ্যার পর প্রেসবক্স ছাড়া বাকি স্টেডিয়ামে যখন আঁধার নেমে এসেছে, হঠাৎই হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া রব। আরে, এখানে শিয়াল এল কোত্থেকে!

প্রেসবক্সে বসে সাগর দেখার সঙ্গে শিয়ালের ডাক শোনা মেলানোটা একটু বিসদৃশই দেখায়। কিন্তু যেকোনো নতুন অভিজ্ঞতাই তো মনে রাখার মতো। প্রেসবক্সে বসে সাগর যেমন আগে দেখিনি, শিয়ালের ডাকও তো শুনিনি আগে। সফরসঙ্গী বাংলাদেশের সাংবাদিক অবশ্য দাবি করলেন, মাস ছয়েক আগে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির সময়ও নাকি শিয়ালের ডাক শুনে প্রেসবক্সে তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল। হতে পারে। কোনো কারণে হয়তো খেয়াল করিনি। করলেও ভুলে গেছি।

কলম্বোর প্রাণকেন্দ্রের একটু বাইরে এই জায়গাটার নাম খেত্তারামা। শুরুতে স্টেডিয়ামটার নামও ছিল খেত্তারামা স্টেডিয়াম। ১৯৯৪ সালের জুনে এটির নতুন নামকরণ করা হয় রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। আগের বছরই আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা গেছেন শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট। তাঁর স্মৃতি অমর করে রাখতে স্টেডিয়ামকে বেছে নেওয়ার কারণ আছে। এই স্টেডিয়ামটা মূলত রানাসিংহে প্রেমাদাসার উদ্যোগেই নির্মিত।

একসময় এখানে ছিল বিশাল জলাভূমি। এখনো স্টেডিয়ামের এক পাশে সেটির কিছুটা অংশ রয়ে গেছে। শিয়াল মামা সম্ভবত সেখানেই বাস করে। পরশু হুক্কা-হুয়া ডাকের বহুমাত্রিকতা দেখে (নাকি শুনে?) অনুমান করলাম, সঙ্গে ‘মামি’ এবং ‘মামাতো ভাই-বোন’রাও নিশ্চয়ই ছিল।

গত বৃহস্পতিবার প্রেমাদাসার পাশে প্র্যাকটিস মাঠে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনের সময় পাইপ থেকে একটা সাপ বেরিয়ে এসেছিল। সাপ-শিয়াল এসব শুনে মনে হতে পারে, স্টেডিয়ামটা বোধ হয় একেবারই বিরান জায়গায়। একসময় হয়তো তা-ই ছিল। এখন আর তা নয়। এক পাশের ফাঁকা জায়গাটা বাদ দিলে অন্য সব দিকে রাস্তাঘাট-বাড়িঘর আছে। তবে কলম্বোর মূল শহরের চাকচিক্যের সঙ্গে বড় বৈপরীত্য সবকিছুর দীনহীন চেহারা।

ক্রিকেট ইতিহাসে এই মাঠটার আলাদা একটা স্থান আছে। যে কারণে সেটি অবশ্য খুব সুখকর নয়। এই মাঠেই খেলা হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ইনিংসটি। রেকর্ড বইয়ে নাম উঠেছে তাতে, কিন্তু তা নিয়ে হাসাহাসিও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু ভারত ৮ উইকেটে ৫৩৭ করে ইনিংস ঘোষণার পর শ্রীলঙ্কা ৬ উইকেটে ৯৫২—এই দুই ইনিংসের ম্যাচের সঙ্গে ‘প্রহসনের টেস্ট’ কথাটাই ভালো যায়।

ওই টেস্টের পর একটা লেখা লিখেছিলাম। তা লিখতে গিয়ে কৌতূহল জেগেছিল, এর আগে ইংল্যান্ডের ৯০৩ রানের যে রেকর্ডটি ছিল, সেই টেস্ট নিয়ে কী লেখা হয়েছিল? ইংল্যান্ডের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ক্রিকেটের সেই আদিকাল থেকে প্রকাশিত সব লেখা নিয়ে একটা সংকলন আমার কাছে ছিল। সেখানে ওভালের ওই টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টের শিরোনামও দেখি ‘দ্য ফার্সিকাল টেস্ট’! আমার লেখাটার শিরোনাম করাটা তাই খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল—‘৫৯ বছর আগেও প্রহসন!’

প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের প্যাভিলিয়নে এবার যাওয়া হয়নি। তবে ২০০৭ সালে সর্বশেষ এসে দেখেছিলাম, সেখানে সনাৎ জয়াসুরিয়া ও রোশান মহানামার একসঙ্গে একটা ছবি বাঁধাই করা আছে। থাকারই কথা। দ্বিতীয় উইকেটে এই দুজন ৫৭৬ রানের জুটি গড়েছিলেন। জয়াসুরিয়ার কাছে ওই টেস্ট আনন্দ ও বিষাদ দুই অভিজ্ঞতারই নাম। চতুর্থ দিন শেষে ৩২৬ রানে অপরাজিত। কলম্বোতে সাজ-সাজ রব। ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে! পরদিন সকালে স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেওয়া হয়। তবে কিছুক্ষণ পরই তা দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করেন দর্শকেরা।

প্রেমাদাসায় সন্ধ্যা নামার মুহূর্ত... ছবি: গেটি ইমেজেস

ওই টেস্টের কথা মনে হলে আমার অবশ্য সনাৎ জয়াসুরিয়ার আগেও মনে হয় নিলেশ কুলকার্নির কথা। ভারতের এই বাঁহাতি স্পিনার টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছিলেন। তখন কল্পনাও করেননি, স্বপ্নের এই সূচনা কেমন দুঃস্বপ্নে শেষ হবে! এক বলে ছিল এক উইকেট, ৭০ ওভার বোলিং করেও ওই এক উইকেটই!

১৯৯২ সালে প্রথম টেস্ট। অথচ ২১ বছরে মাত্র অষ্টম টেস্ট হচ্ছে এই স্টেডিয়ামে। কলম্বোর অন্য দুটি টেস্ট ভেন্যুর মধ্যে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠের মালিকানা কার, সেটি তো নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে। পি. সারাভানামুত্তু মাঠটি তামিল ইউনিয়ন ক্লাবের। ৩৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামই শুধু শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের নিজস্ব সম্পত্তি। মূলত ওয়ানডে ভেন্যু হিসেবেই এর ব্যবহার।

মাঝে মাঝে ভাবি, এখনকার হুড়োহুড়ি আর সব কিছুকেই খবর বানিয়ে ফেলার সাংবাদিকতার চেয়ে ওই সময়টাই কি ভালো ছিল!

একটা প্রতীকী অর্থও কি আছে এর! ওয়ানডে ইতিহাসে সফলতম ব্যাটসম্যান যে এই মাঠেই তাঁর বহু আরাধ্য প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা পেয়েছিলেন। প্রেমাদাসায় এলেই যে সবার আগে আমার সেই স্মৃতি মনে পড়ে, সেটি তো কালই আপনাদের জানিয়েছি। এই স্টেডিয়াম তখন এমন সুন্দর ছিল না। এখন যেমন পাঁচতলা উচ্চতায় বিশাল প্রেসবক্স, তখন প্রেসবক্স মানে ছিল মাঠের সমতলে উইকেটের কোনাকুনি কয়েকটি চেয়ার আর বেঞ্চসদৃশ টেবিল।

ড্রেসিংরুমে ওঠার সিঁড়িটার দিকে চোখ যায় বারবার। শচীন টেন্ডুলকারকে ওখানেই থামিয়ে কথা বলেছিলাম। এখন এটা অবিশ্বাস্যই মনে হয় যে, অমন মহাআলোচিত সেঞ্চুরির পরও টেন্ডুলকারের আনুষ্ঠানিক কোনো সংবাদ সম্মেলন হয়নি। সে জন্য যে সাংবাদিকেরা খুব মন খারাপ করেছিলেন, তা-ও নয়। সিঁড়িতে টেন্ডুলকারকে থামিয়ে কথা বলেছিলাম চার বঙ্গসন্তান—আমি আর কলকাতার তিন সাংবাদিক!

মাঝে মাঝে ভাবি, এখনকার হুড়োহুড়ি আর সব কিছুকেই খবর বানিয়ে ফেলার সাংবাদিকতার চেয়ে ওই সময়টাই কি ভালো ছিল!

১৭ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×