হাম্বানটোটায় কালুভিতারানার অতিথি
শ্রীলঙ্কা ডায়েরি
উৎপল শুভ্র
১৫ এপ্রিল ২০২১
টিম হোটেলে জায়গা না পেলে দ্বিতীয় পছন্দ থাকে মাঠের কাছে কোনো হোটেল। সেটি যেহেতু নেই, তাই অন্তত টিম হোটেলের কাছাকাছি থাকি। এভাবেই বাংলাদেশ দলের লিয়াজোঁ চিত্রালালের কাছ থেকে কালুভিতারানার হোটেলের খোঁজ পেলাম। টিম হোটেলের সবচেয়ে কাছাকাছি হোটেল এটিই। যেটির নাম ‘কালুস্ হাইডঅ্যাওয়ে।’ আক্ষরিক অর্থ ‘কালুর লুকিয়ে থাকার জায়গা।’
প্রথম প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো
ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে কে আমাকে আতিথ্য দিচ্ছেন, জানেন? রমেশ কালুভিতারানা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, শ্রীলঙ্কার ওই বিধ্বংসী খুদে ওপেনারই বটে।
হাম্বানটোটায় কোথায় থাকব— মহা দুশ্চিন্তায় ছিলাম এটা নিয়ে। বাংলাদেশ দলের কোনো ট্যুরে এলে প্রথম পছন্দ থাকে ‘টিম হোটেল’। কাজের সুবিধা তো বটেই, ক্রিকেটারদের সঙ্গে উঠতে-বসতে দেখা হওয়াটা ভালোও লাগে। কাজের বাইরে অনানুষ্ঠানিক অনেক কথাবার্তা হয়। সময়টা খুব ভালো কাটে।
কলম্বোয় তাজ সমুদ্র হোটেলে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটা যেদিন শেষ হলো, সেদিন যেমন অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো তামিম-আশরাফুল-নাসির-রবিউলদের সঙ্গে। ওঁরা বিলিয়ার্ড খেলছিলেন, আমি আর সফরসঙ্গী ডেইলি স্টার-য়ের বিশ্বজিৎ রায় দর্শক। এসব সময়ে এমন সব বিষয় নিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা হয়, যা শুধু এমন ডায়েরি-জাতীয় লেখাতেই লেখা যায়। সেই রাতে নাসিরের কথাটা যেমন। সংবাদপত্র সম্পর্কে তাঁর অসীম কৌতূহল। প্রথম আলোয় কতজন সাংবাদিক কাজ করেন, স্পোর্টসে কয়জন, এমন নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। স্পোর্টসে নতুন একজন নেওয়া হবে, আপনি কি আগ্রহী—কথাটা শুনে এমন তাৎক্ষণিক একটা জবাব দিলেন যে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। গম্ভীর মুখে নাসির বললেন, ‘তাহলে আপনি খেইলেন।’
হাম্বানটোটায় এই প্রথম। তবে স্টেডিয়ামের ধারেকাছে যে কোনো হোটেল-টোটেল নেই, এখানে খেলা কাভার করে যাওয়া সাংবাদিকদের কাছে তা আগেই জেনেছি। টিম থাকছে গ্র্যান্ড উদাওয়ালে সাফারি রিসোর্টে। ৫৩ না ৫৪টা রুম, দুই দলকে জায়গা দিতেই যা শেষ। আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারিদেরই থাকতে হচ্ছে অন্য হোটেলে।
হাতির জন্য বিখ্যাত উদাওয়ালে ন্যাশনাল পার্ক খুব কাছে। ওয়াইল্ড লাইফপ্রেমী পর্যটকদের তাই খুব পছন্দও। হাম্বানটোটায় খেলা হলে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের নিয়মিত পদধূলি পড়ে এখানে। কালই যেমন পুরো শ্রীলঙ্কা দল ডিনার সারল কালুর হোটেলেই।
টিম হোটেলে জায়গা না পেলে দ্বিতীয় পছন্দ থাকে মাঠের কাছে কোনো হোটেল। সেটি যেহেতু নেই, তাই অন্তত টিম হোটেলের কাছাকাছি থাকি। এভাবেই বাংলাদেশ দলের লিয়াজোঁ চিত্রালালের কাছ থেকে কালুভিতারানার হোটেলের খোঁজ পেলাম। টিম হোটেলের সবচেয়ে কাছাকাছি হোটেল এটিই। যেটির নাম ‘কালুস্ হাইডঅ্যাওয়ে।’ আক্ষরিক অর্থ ‘কালুর লুকিয়ে থাকার জায়গা।’
জঙ্গলের ভেতরে যেখানে এই হোটেল, সেটি লুকিয়ে থাকার মতো জায়গাই বটে। কালুভিতারানা ২০০৭ সালের দিকে এটি বানিয়ে ছিলেন সেই উদ্দেশ্যেই। কলম্বোর নাগরিক জীবনে ক্লান্তি এসে গেলে কখনো বা পরিবার, কখনো বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে এখানে দু-তিনটি দিন কাটিয়ে যেতেন। আস্তে আস্তে বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বাড়ে, একটি থেকে দুটি রুম হয়, দুটি থেকে তিনটি। এসব দেখাশোনার জন্য লোক লাগে। ২০০৮ সালের দিকে তাই এটিকে হোটেলেরই রূপ দিয়ে ফেলেন। চারপাশের নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দোতলা একটা ভবন ছিল প্রথমে, পাশে আরেকটা তিনতলা হয়েছে পরে। ওটির ছাদে হানিমুন সুইটের কাজ চলছে। রুম মাত্র ১৩টি। হাতির জন্য বিখ্যাত উদাওয়ালে ন্যাশনাল পার্ক খুব কাছে। ওয়াইল্ড লাইফপ্রেমী পর্যটকদের তাই খুব পছন্দও। হাম্বানটোটায় খেলা হলে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের নিয়মিত পদধূলি পড়ে এখানে। কালই যেমন পুরো শ্রীলঙ্কা দল ডিনার সারল কালুর হোটেলেই।
হোটেলের নামের সঙ্গেই তিনি আছেন। সেটি কেউ না বুঝতে পারলেও এই ‘হাইডঅ্যাওয়ে’-তে ঢোকার পরই যে কেউ এটির মালিকানা নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে যাবেন। কালুভিতারানার খেলোয়াড়ি জীবনের নানা ছবি দিয়ে সাজানো ভেতরটা। ট্রফি ক্যাবিনেটটাও খুব সমৃদ্ধ। শ্রীলঙ্কান প্রায় সব গ্রেটের সঙ্গেই ছবি আছে। তবে শুধু শ্রীলঙ্কাতেই আটকে না থেকে ক্রিকেট ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনারও প্রমাণ আছে। লবি থেকে ভেতরে ঢোকার মুখেই বাঁ দিকের দেয়ালে বিশাল যে চারটি ছবি বাঁধানো, তার কোনোটিই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের নয়। তাঁদের নাম ডন ব্র্যাডম্যান, ডব্লু জি গ্রেস, গ্যারি সোবার্স ও ভিভ রিচার্ডস। ব্র্যাডম্যানের প্রতি বোধ হয় আলাদা একটা দুর্বলতা আছে কালুর। নইলে ট্রফি ক্যাবিনেটেও ডনের বাঁধাই করা আরেকটা ছবি থাকবে কেন!
জায়গাটা এমন নির্জন যে সন্ধ্যার পর হোটেলের সুইমিংপুলের ওপাশে একটু এগিয়ে গেলেই কেমন যেন গা ছমছম করে। ঝিঁঝি ডাকে, গত পরশু রাতে আরও কী সব ডাক শুনলাম, যেগুলোর উৎস সম্পর্কে ঠিক নিশ্চিত নই।
কালুর আতিথ্য নিয়েছি বললাম ঠিকই, তবে সামান্য একটু তথ্য যোগ করা দরকার। সেই আতিথ্য কড়কড়ে ডলারের বিনিময়েই। হ্যাঁ, কালু একটু ছাড় দিয়েছেন বটে। দ্বিতীয় টেস্টের আগে প্রেমাদাসায় শ্রীলঙ্কার প্র্যাকটিসের সময় দেখা হলো। তাঁর হোটেলে থাকতে যাচ্ছি শুনে খুব খুশি। ওয়াই-ফাই আছে কি না, খোঁজ নিতেই বললেন, ‘আছে। তবে এ জন্য চার্জ দিতে হয়। দাঁড়ান, আমি ওদের বলে দেব আপনার কাছ থেকে যেন তা না নেয়।’
এটুকু সৌজন্যই বা কম কী! পরশু সন্ধ্যায় এখানে এসে পৌঁছানোর পর হোটেলের ম্যানেজার জানালেন, তাঁর বস বেশ কয়েকবার খোঁজ নিয়েছেন আমি এলাম কিনা জানতে। বলতে বলতেই আবার কালুর ফোন। আমি সামনেই জেনে কথা বলতে চাইলেন। তাঁর ‘হাইডঅ্যাওয়ে’ কেমন লাগছে এসব জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করার পর বললেন, কোনোরকম সমস্যা মনে হলেই যেন তাঁকে ফোন করি।
ডলার দিয়েই না হয় থাকলাম, তারপরও এটিকে মূল্য দিতেই হয়। ‘কালুর আতিথ্যে আছি’ বলে সেটিই দিলাম আরকি!
২২ মার্চ ২০১৩। হাম্বানটোটা।
হাম্বানটোটার প্রেসবক্সে বৃষ্টির অবসরে
আরও পড়ুন:
হাম্বানটোটায় বৃষ্টি এবং প্রেসবক্সের সেকাল-একাল
হাম্বানটোটায় কালুভিতারানার অতিথি
প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা
প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে
সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম
হনুমানের ফেলে দেওয়া টুকরো থেকে যেটির সৃষ্টি
বিশ্বের প্রথম সুড়ঙ্গ মন্দিরে বুদ্ধ শরণে