যে মাঠে সাগরে বল হারিয়ে যাওয়ার ভয়!

উৎপল শুভ্র

২০ মে ২০২১

যে মাঠে সাগরে বল হারিয়ে যাওয়ার ভয়!

এক পাশে সাগর, আরেক পাশে বিমানবন্দর। একটু পর পর বিমান উঠছে-নামছে। টেস্ট বা ওয়ানডে হয়েছে, এমন মাঠগুলোর মধ্যে বিমানবন্দরের সঙ্গে এমন নৈকট্য আছে আর শুধু নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউনেরই। সেন্ট ভিনসেন্টের মানুষ অবশ্য আপনাকে মনে করিয়ে দেবে, কুইন্সটাউন মাঠের পাশে তো আর সাগর নেই। এক সময় সাগরের দিকটা খোলা ছিল, বল হারিয়ে যেতে পারে ভয়েই কিনা সেদিকে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

পাঁচ বছর আগে প্রথম দেখায় আর্নস ভেল যেমন চমকে দিয়েছিল, এবারও তা-ই। তবে দুবার দু কারণে। এ মাঠেই দুটি ওয়ানডে দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। মাঠে গিয়ে তো মহা বিস্ময়। এ মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় কীভাবে!

জীর্ণ গ্যালারি, মাঠ কেমন যেন উপুড় করা বাটির মতো, সেটিও উঁচুনিচু। ড্রেসিংরুমের চেহারা দেখে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো নাকউঁচু দল এখানে কীভাবে খেলে গেছে তা নিয়ে বিস্ময় জাগতে বাধ্য। প্রেসবক্সের অবস্থা তো কহতব্য নয়। পাঁচ-ছয়জনের বসার জায়গা আছে।

তাতেও এমন ঠাসাঠাসি যে, একজন বেরোতে গেলে বাকিদের উঠে দাঁড়াতে হয়। ইন্টারনেট-টেট কিচ্ছু নেই।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঘটল লাঞ্চের সময়। সারা দিনের খেলা—আয়োজকেরাই সাংবাদিকদের খাওয়া-টাওয়ার ব্যবস্থা করবে, এটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ম। এখানে সেসবের তো প্রশ্নই নেই, নিজের পয়সা দিয়ে খাবার আনাব, তারও ব্যবস্থা নেই। মনে আছে, লাঞ্চের সময় বাইরে দর্শকের ভিড় ঠেলে কী একটা স্ন্যাকস-ট্যাকস্ কিনে পেটের আগুন নেভাতে হয়েছিল। আর্নস ভেল নিয়ে ডায়েরিতে কী লিখেছিলাম, সেটিও মনে আছে। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে চোখ জুড়াতে সুযোগ হলে আবার কোনোদিন বেড়াতে আসব সেন্ট ভিনসেন্টে, কিন্তু ক্রিকেট কাভার করতে অবশ্যই নয়।

সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে আবার এলাম। গতবারের ওই দুঃসহ স্মৃতির কারণে একটু ভয়ে ভয়েই পা রেখেছিলাম আর্নস ভেলে। গিয়ে চোখ চড়কগাছ। এ তো দেখি হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের কুৎসিত হাঁসের ছানার সুন্দরী রাজহংসীতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার মতো কাণ্ড!

লাল-নীল-হলুদ চেয়ারে সাজানো অত্যাধুনিক গ্যালারি। নতুন ড্রেসিংরুম, উল্টোদিকে চারতলা মিডিয়া সেন্টার। প্রেসবক্সও যেন প্রায় অবারিত প্রান্তর। সব ঝকঝক তকতক করছে। সবচেয়ে অবাক হলাম মাঠটা দেখে। ২০০৪ সালের আর্নস ভেলের সাক্ষী মাত্র তিনজন আছেন এবারের দলে। খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধু মোহাম্মদ আশরাফুল। বাকি দুজন সাপোর্ট স্টাফের সদস্য—সহকারী কোচ খালেদ মাহমুদ ও কম্পিউটার অ্যানালিস্ট নাসির আহমেদ। কার্পেটের মতো আউটফিল্ড দেখে তাঁরাও একই রকম বিস্মিত।

সেন্ট ভিনসেন্টের রাজধানী কিংসটাউনে সাগর আর এয়ারপোর্টের মাঝখানে আর্নস ভেল স্টেডিয়াম

খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু আমার একটু মন খারাপও হলো। কোনো যুক্তিই নেই, তারপরও মনে হলো, আগের আর্নস ভেলটাই যেন ভালো ছিল! খেলা যখন ছিল শুধুই খেলার আনন্দে, সেই সময়টা যেন মনে করিয়ে দিত পুরোনো আর্নস ভেল। সব যন্ত্রণার স্মৃতিই কি একসময় এমন একটু আনন্দও বয়ে আনে?

আর্নস ভেলের চেহারা বদলে দেওয়ার কৃতিত্বটা গত বিশ্বকাপের। ম্যাচ চেয়েও শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর তা পায়নি সেন্ট ভিনসেন্ট। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে স্টেডিয়ামটা ‘মানুষ’ হয়ে গেছে। ওয়ানডে হয়েছে ১৭টি, এর আগে টেস্ট হয়েছে মাত্র একটিই। ১২ বছর পর আবারও টেস্ট আয়োজনের সুযোগ, আর সেটির আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি। স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের লোকজনকে দেখলেই ‘হরিষে বিষাদ’ কথাটার অর্থ খুব ভালো বোঝা যাচ্ছে।

মাঠের এক পাশে সাগর। একটা সময় ওই দিকটা খোলাই ছিল। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো ফিল্ডারকে সাগরের সৌন্দর্যে বিভোর কোনো পর্যটক বলে ভুল করারও যথেষ্টই কারণ ছিল তখন। সেদিকটায় দেয়াল উঠেছে নাকি বল সাগরে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে!

এক পাশে সাগর, আরেক পাশে বিমানবন্দর। একটু পর পর বিমান উঠছে-নামছে। টেস্ট বা ওয়ানডে হয়েছে, এমন মাঠগুলোর মধ্যে বিমানবন্দরের সঙ্গে এমন নৈকট্য আছে আর শুধু নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউনেরই। কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে সেন্ট ভিনসেন্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তি লেনক্স জন হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাই বলে কুইন্সটাউন আর আর্নস ভেলকে মিলিয়ে ফেলো না। কুইন্সটাউনের পাশে তো আর সাগর নেই!’

তা নেই। তারপরও কুইন্সটাউন অনেক বেশি সুন্দর। সেটি আর লেনক্স জনকে বললাম না। এমন গর্বভরে ‘এমন মাঠটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গাইছেন, এত সত্যবাদী হওয়ার কী দরকার! ১২ বছর পর টেস্ট আয়োজনের আনন্দটা গেইলদের কাণ্ড, বৃষ্টি—সব মিলিয়ে হারিয়ে যেতে বসায় এমনিতেই বেচারার মনটা খুব খারাপ।

৯ জুলাই ২০২১। সেন্ট ভিনসেন্ট।

আরও পড়ুন:

ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...
ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত
ক্যারিবীয় কড়চা-৩: বারবাডোজ যেখানে আলাদ
ক্যারিবীয় কড়চা-৪: সোবার্স-উইকস সন্ধ্যা
ক্যারিবীয় কড়চা-৫: আহ্, সেন্ট ভিনসেন্ট!
ক্যারিবীয় কড়চা-৬: কার্নিভাল দর্শন

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×