সোবার্স-উইকস সন্ধ্যা
উৎপল শুভ্র
১৭ মে ২০২১
ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে ট্যুর ডায়েরি, কিন্তু তা যেন কোনোদিন পুরেনো হওয়ার নয়। এই লেখাটাই যেমন, স্যার গারফিল্ড সোবার্স স্কুল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্যারি সোবার্স ও এভার্টন উইকসের সান্নিধ্য পাওয়ার স্মৃতি কি কখনো মলিন হয় নাকি! পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া উইকসের আমুদে চোখমুখ যেন এখনো দেখতে পাই, শুনতে পাই স্কুলছাত্রদের উদ্দেশে সোবার্সের দারুণ ওই বক্তৃতাটা।
প্রথম প্রকাশ: ৭ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।
পাশে বসে স্যার এভার্টন উইকস, পেছনে দাঁড়িয়ে স্যার গ্যারি সোবার্স। আমি খাব কীভাবে? কাঁটা চামচে খেতে এমনিতেই স্বস্তি পাই না। এখানে সমস্যা অন্য। শরীর-মন রোমাঞ্চিত, একবার পাশে তাকিয়ে উইকসকে দেখি, আবার পেছনে তাকিয়ে সোবার্সকে। জীবনে অনেক খাওয়া যাবে, এই দুজনকে আর কোনো দিন এত কাছাকাছি পাব কি না, কে জানে!
একজন প্রশ্নাতীতভাবে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। ৯৩ টেস্টে ৮০৩২ রান, ২৩৫ উইকেট ও ১১০ ক্যাচের তুলনা হয়তো জ্যাক ক্যালিসে পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটি শুধু ‘গাধা’ পরিসংখ্যানেই। গ্যারি সোবার্স নতুন বলে পেস বোলিং করতেন, বল পুরোনো হলে বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন ও চায়নাম্যান দুটোই। ব্যাটসম্যান হিসেবে অনেকেই শুধু স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেই তাঁর আগে রাখেন। মাঠের যেকোনো জায়গায় ছিলেন দুর্দান্ত ফিল্ডার। এই জিনিস ক্রিকেটে আর আসবে না বলে মোটামুটি মেনে নিয়েছেন সবাই।
এভার্টন উইকস মাত্র ৫৮ টেস্ট খেলেই সর্বকালের সেরাদের একজন। ৫৮.৬১ গড়ে ৪৪৫৫ রান, ১৫টি সেঞ্চুরি। টানা পাঁচ ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড এখনো অম্লান। বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লু’র একজন। অন্য দুজন, ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ও ক্লাইড ওয়ালকট গত হয়েছেন, এভার্টন উইকস সাড়ে চুরাশি হয়ে যাওয়ার পরও দারুণ প্রাণবন্ত। আমার যে খাওয়ার দিকে মনোযোগ নেই, সেটিও খেয়াল করলেন। ‘আমি বুড়ো মানুষ হয়েও খেয়ে যাচ্ছি, আর তুমি তরুণ হয়েও খাচ্ছ না, ঘটনা কী? বারবাডোজের খাবার কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?’—বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন উল্টো দিকে বসা সিমুর নার্সের। নার্স হাসলেন, ‘বাজান আতিথেয়তার এত সুনাম, তুমি তো দেখি তার বারটা বাজিয়ে দিচ্ছ!’
সোবার্স-উইকসের পাশে অবশ্যই ম্লান, তবে বারবাডোজে নার্সেরও ‘সর্বকালের সেরাদের একজন হতে পারত’ বলে পরিচিতি। ২৯ টেস্টে ৬ সেঞ্চুরি, ৪৭.০৬ গড়ে ২৫২৩ রান। জীবনের শেষ সিরিজে সেরা গড়ের রেকর্ড এখনো তাঁর। ৩ টেস্টে ১টি সেঞ্চুরি, ১টি ডাবল সেঞ্চুরি ও ১টি ৯০-এ ৫৫৮ রান—তার পরও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬৮-৬৯ সিরিজের পরই অবসর নিয়ে নিলেন কেন?
নার্সকে দেখে প্রায় ৭৬ ছুুঁইছুঁই বয়স বোঝারই কোনো উপায় নেই। এই প্রসঙ্গটা তুলতে তা একটু বোঝা গেল। নার্স যেন জীবনানন্দ দাশ, ‘কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’—‘বাদ দাও, এই আনন্দের সন্ধ্যায় ও সব কথা থাক!’
আনন্দের এই সন্ধ্যার উপলক্ষ স্যার গারফিল্ড সোবার্স স্কুল টুর্নামেন্ট উপলক্ষে আয়োজিত ডিনার পার্টি। ১৯৮৭ সাল থেকে হয়ে আসছে এই টুর্নামেন্ট, ক্যারিবিয়ানের বাইরের দেশ থেকেও অংশগ্রহণ থাকে যাতে। এবারই যেমন অংশ নিচ্ছে ইংল্যান্ডের তিন স্কুল।
স্থানীয় এক সাংবাদিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে স্যার গ্যারি আর এভার্টনের সান্নিধ্য পেতে অনুষ্ঠানে গিয়েছি আমি। বাংলাদেশ দলও যে আমন্ত্রিত, সেটি জানতাম না। এভার্টন উইকস আমাকে বাংলাদেশ দলেরই কেউ বলে ভুল করায় তা জানতে পারলাম। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা, ‘তোমাদের ক্যাপ্টেন, ওই যে ছোটখাটো ব্যাটসম্যানটি, ও কেমন আছে?'
-মোহাম্মদ আশরাফুলের কথা বলছেন, ও তো আর ক্যাপ্টেন নেই।
উইকস শুনলেন কি শুনলেন না, ‘ভালো ব্যাটসম্যান।’
কোথায় দেখলেন আশরাফুলকে?
‘গত বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে দেখেছি। খুব বেশি রান করেনি। কিন্তু জাতের ব্যাটসম্যান দেখলেই বোঝা যায়।’
একটু পর অনুষ্ঠানে আশরাফুলরাও এলেন। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার শফিকুল হক হীরা এসেই দারুণ একটা কাজ করলেন। সোবার্সকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ইতিহাসমনস্কতার পরিচয় কখনো পেয়েছি বলে মনে হয় না। কিন্তু সোবার্স তো সোবার্স। তাঁর সঙ্গে তাই ঠিকই ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল।
সোবার্সের বক্তৃতাতেও বাংলাদেশ এল। এই সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দলকে পেয়ে সোবার্স গর্বিত বোধ করছেন—এই সফরে এ কথাকেও বড় প্রাপ্তি বলে মানতে পারেন মাশরাফিরা। সোবার্সকে নিয়ে যখন কেউ কথা বলেন, শুধু রান আর উইকেটের কথা বলেন না। খেলাটা যে তিনি খেলার মতোই খেলেছেন, সেটিও অবশ্য উল্লেখ্য হয়ে থাকে। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাতেও তার প্রমাণ। স্কুল ক্রিকেটারদের উদ্দেশে বললেন, ‘স্নিক করলে ওয়াক করো। আমি যদি জানি যে, ২ রানে আউট ছিলাম, তা হলে সেঞ্চুরি করলে সেটি তো উল্টো লজ্জা দেবে।’
গানবাজনার আয়োজনও ছিল শেষে। আফ্রিকা থেকে আখ চাষের জন্য জাহাজ ভরে আনা ক্রীতদাসদের বংশধর আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। আফ্রিকাকে তাই ওরা বলে ‘দ্য মাদারল্যান্ড’, সেই মাদারল্যান্ডের উদ্দেশে নিবেদিত হলো একটি পর্ব। রণ পায়ে আকাশছোঁয়া তিন তরুণের অবিশ্বাস্য নাচকে মনে হলো সন্ধ্যার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। তবে এমন কিছুও হলো, যেটি আমাদের সংস্কৃতিতে অশ্লীল বলেই বিবেচিত হতো। সংক্ষিপ্ততম বসনা তিন তরুণীর ইঙ্গিতপূর্ণ নাচের পর সে ব্যাপারে উপস্থাপিকা আবার ইংল্যান্ডের স্কুল ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়াও জানতে চাইলেন। সবাই দেখলাম, এটাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করল।
যে দেশের যে রীতি!
৬ জুলাই,২০০৯। বারবাডোজ।
আরও পড়ুন:
ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...
ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত
ক্যারিবীয় কড়চা-৩: বারবাডোজ যেখানে আলাদা