এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত
উৎপল শুভ্র
১৫ মে ২০২১
২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর কাভার করতে যাওয়ার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ট্যুর ডায়েরিটা এবার নিয়মিত লিখব। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে অনেকগুলো দ্বীপরাষ্ট্রে খেলা, একেকটার একেক চরিত্র। সেই দ্বীপ, দ্বীপের মানুষ, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে এই ক্যারিবীয় কড়চা। সশরীরে না গিয়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে আসার এক বাহন। এই লেখা যেমন আপনাকে নিয়ে যাবে ব্রিজটাউনের অস্টিন ফিশ মার্কেটে। শুক্রবারের রাত যেখানে কখনো ঘুমায় না।
প্রথম প্রকাশ: ৫ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।
রাত কটা হলো? ১০টা, ১১টা, ১২টা? অস্টিনের জনকল্লোলে তা বোঝার উপায় নেই।
ব্রিজটাউন শহরের এক কোণে অস্টিন ফিশ মার্কেট। পাশেই সেই 'ফিশ' মহাসমারোহে গ্রিলড্ হচ্ছে। সঙ্গে মুরগি-গরু-শূকরও। ছোট ছোট চালার মতো সব খাবারের দোকান। সামনে হাইস্কুলের মতো বেঞ্চ। তাতে সার বেঁধে রসনাতৃপ্তিতে ব্যস্ত মানুষের সারি যেন বর্ণবাদবিরোধী পোস্টার! সাদার পাশে কালো, তার পাশে বাদামি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উপমহাদেশীয় রংও ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
এ-মাথা থেকে ও-মাথা এক মাইলমতো জায়গা। মাঝখানে বড় একটা মঞ্চ থেকে আধুনিকতম শব্দনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়ছে রক্তে দোলা লাগানো সংগীতের মূর্ছনা। পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীর কথা শুনতে মুখের কাছে কান পাততে হয়, অথচ একটু পরপরই শোনা যাচ্ছে ক্যারিবিয়ান 'হো হো' হাসি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে এত কিছু লেখা হয়েছে, তবে এই গগনবিদারী হাসিটা বোধ হয় এখনো তার প্রাপ্য মনোযোগ পায়নি!
দারুণ জায়গায় নিয়ে এসেছ, থ্যাংকিউ' প্রায় চিৎকার করে বলতে হলো কথাটা । রডনি ডেনজিলের স্বাভাবিক গলাই যেন মেঘমল্লার, ‘এর আগে এত দিন বারবাডোজে থেকেও তুমি অস্টিনে আসোনি! তুমি তো বারবাডোজের কিছুই দেখোনি হে ভায়া। ইউ আর আ শিট ম্যান!'
গত পরশু কেনসিংটন ওভালের প্রেসবক্সে পরিচয়। রডনি ডেনজিল বারবাডোজ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত স্কোরার। বয়স পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু দেখলে ত্রিশ-বত্রিশের বেশি মনে হয় না। পাশ থেকে মুখটা ঠিক ভিভ রিচার্ডসের মতো। ভাবলাম, বললে খুশি হবে। ও মা, এই ব্যাটা দেখি উল্টো রাগ করে! 'স্যার ভিভ? ইউ আর ইনসাল্টিং মি, ম্যান।” কথাটা শেষ হতেই হো হো হাসি বুঝিয়ে দিল, এটা ছিল রসিকতা।
বাংলাদেশ থেকে আসা একমাত্র সাংবাদিক সম্পর্কে ভীষণ কৌতূহলী। হোটেলে একা আছি, রাতের কর্মসূচিতে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একটা লেখা তৈরি করে ফেলা ছাড়া আর কিছু নেই জেনে খুবই আশ্চর্যান্বিত। মনে হলো একটু মর্মাহতও! *এটা কোনো কথা হলো? আজ রাতে তোমাকে আমি দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে যাব। জীবনে কি কাজটাই সব? রাতের অস্টিন দেখা এই জীবনদর্শনেরই বাস্তবায়ন।
রাত ১০টা, ১১টা, ১২টা জনারণ্য দেখি একই রকম আছে। রডনি জানাল, এটি শুক্রবার রাত, এই রাতে অসুস্থ আর শিশু ছাড়া ব্রিজটাউনের কেউ ঘুমায় না। বারবাডোজের লোকদের বলে বাজান, রডনি গর্ব মাখানো গলায় জানাল, সেই বাজানদের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো পার্টি করা। 'এক বেলা না খেলেও চলে, কিন্তু বাজানরা পার্টি ছাড়া বাঁচতে পারে না'–এ কথা বলে পার্টির আরও উদ্দাম রূপ দেখাতে রডনি নিয়ে গেল অস্টিন থেকে গাড়িতে মিনিট পনেরো দূরের কেবলস অ্যান্ড ওয়্যারলেস ক্লাবে। বারবাডোজের প্রথম বিভাগ ক্রিকেটের ক্লাব, যেটির সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান ‘বিগ বার্ড' জোয়েল গার্নার। বদলে যাওয়া পৃথিবীর প্রমাণ রেখে প্রবেশদ্বারে মেটাল ডিটেক্টর হাতে নিরাপত্তারক্ষী। ভেতরে বিশাল মধ্যে অক্লান্ত ক্যালিপসো-রেগে-সোকা গেয়ে যাচ্ছে জটাধারী গায়ক। সামনে নেচে যাচ্ছে শুক্রবার রাতের উদ্দামতা, যাতে তরল পানীয়র অবশ্যই বড় একটা ভূমিকা।
এক রাতেই কতজনের সঙ্গে যে পরিচয় করিয়ে দিল রডনি! সাংবাদিক বলে অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেও। কেউ বারবাডোজের পক্ষে ফার্স্ট ক্লাস খেলেছেন, কেউবা খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৯ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। সবার পরিচিতিতেই একটা জিনিস কমন থাকল–দারুণ প্রতিভা ছিল, পথ হারিয়ে ফেলেছে। যার সম্পর্কে বলা, তার প্রতিক্রিয়াতেও একটা কথা কমন—'আমি পথ হারিয়ে ফেলিনি। মূর্খ নির্বাচকদের গালে চড় মেরে খেলা ছেড়ে দিয়েছি।'
এর মধ্যে একজনকে পেলাম শীর্ণকায় মধ্যবয়সী। মাথায় লম্বা জটা, মুখের দাড়িও প্রায় জটাদর্শন– গুগলে 'বাজান' লিখে সার্চ দিলে যে ছবিটা পাওয়া যায়, ঠিক সেরকম। বারবাডোজ নামটাও কিন্তু ওই ছবিটারই শাব্দিক অনুবাদ। ইংরেজরা উপনিবেশ করে নেওয়ার আগে বারবাডোজ ছিল পর্তুগিজদের অধীনে। তারাই এই দ্বীপের নাম দিয়েছিল 'লস বারবাডোজ', অর্থ 'দ্য বিয়ার্ডেড ওয়ান'। বাংলা কী হবে–দাড়িওয়ালা একজন? বারবাডোজের বর্তমান মানবপ্রজাতি তখনো এখানে পা-ই ফেলেনি। এই নামকরণের সঙ্গে তাই তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। দাড়ির মতো লম্বা লম্বা ঝুরির ফিগ গাছের ছড়াছড়ি এই দ্বীপে। মনে করা হয়, এ থেকেই উৎপত্তি ওই 'লস বারবাডোজ' নামের।
বাজানদের কাছে শুক্রবার রাতে ঘুমোনো 'পাপ' হতে পারে, কিন্তু আমি তো নিরামিষ বাঙালি। আমাকে তো একটু ঘুমাতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেট কাভার করতে এলে 'আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ' যে অবশ্য পালনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাতে 'হ্যাপি, ওয়েলথি অ্যান্ড ওয়াইজ' হওয়ার নিশ্চয়তা হয়তো মেলে না, তবে সময় পার্থক্যের প্রতিবন্ধকতা জয় করে পত্রিকার লেখাটা সময়মতো পাঠানো যায়। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘর পেরোতেই আমি তাই হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছি, আর রডনি বলে যাচ্ছে 'আরে, কী বলো, পার্টি তো মাত্র জমে উঠছে।'
শেষ পর্যন্ত আমার পীড়াপীড়িতে পার্টিতে সাময়িক বিরতি দিতে রাজি হলো সে। আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আবার যাবে। রুমে ফিরে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে বিছানায় যেতে যেতে রাত দুটো। অথচ মোবাইলে কটায় অ্যালার্ম সেট করলাম, জানেন? ভোর সাড়ে পাঁচটায়।
কাল যে কলামে লিখেছিলাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশের সাংবাদিকের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা, সেটা এ কারণেই। সেই পরীক্ষার প্রশ্ন এবার আরও কঠিন বলে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে যাওয়ায়। বারবাডোজের সঙ্গে পার্থক্যটা এখন ১০ ঘণ্টার জায়গায় ১১ ঘণ্টা। এখানে ভোর সাড়ে পাঁচটা মানে বাংলাদেশে বিকেল সাড়ে চারটা। ঘুম থেকে ওঠার আগেই তো অফিস থেকে সহকর্মীর প্রশ্ন ছুটে আসে, আজ কী পাঠাচ্ছেন? খেলা শুরু হতে হতেই পত্রিকার প্রথম সংস্করণের ডেডলাইন শেষ!
ওয়েস্ট ইন্ডিজে যখন সন্ধ্যার ছায়া নামে, বাংলাদেশে তখন ভোরের আলো ফুটছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কি একটা কবিতায় এমন দুটি লাইন আছে না, এখানে নামল সন্ধ্যা/সূর্যদেব, কোন দেশে কোন সাগরপাড়ে তোমার প্রভাত হলো?' উনি কি ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসেছিলেন কখনো?
কবিতার লাইন দুটি কি ঠিক লিখলাম? ভুল হলে ক্ষমা করে দেবেন। ভোরবেলায় আমার কবিতা-টবিতা মনে থাকে না।
৪ জুলাই ২০০৯, বারবাডোজ
আরও পড়ুন: ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...