কার্নিভাল দর্শন
উৎপল শুভ্র
১৯ মে ২০২১
আগের রাতে সেন্ট ভিনসেন্টে পৌঁছেছি। স্যুটকেস সঙ্গে আসেনি। পরদিন তা আনতে এয়ারপোর্টে যাব বলে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়েছি। পাঁচ বছর আগের ট্যুরে পরিচিত ট্যাক্সিচালকের আমন্ত্রণে চলে গেলাম সেন্ট ভিনসেন্টের কার্নিভাল দেখতে। `ভিন্সি মাস` মানের সেই কার্নিভাল মানে রংয়ের উৎসব, বাহারি পোশাকের উৎসব। সব মিলিয়ে `কার্নিভাল`-এর অর্থ মনে হলো `মহোৎসব`!
প্রথম প্রকাশ: ৯ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।
ট্যাক্সি ডাকলাম বিমানবন্দরে যাব বলে। সোমবার বারবাডোজ থেকে সেন্ট ভিনসেন্টে এসেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘বিখ্যাত’ লিয়াট এয়ারলাইন্সের কল্যাণে যথারীতি স্যুটকেস আসেনি। ক্যারিবিয়ানের এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে লিয়াটই ভরসা। যেটি শব্দে কান ফাটিয়ে, গরমে সেদ্ধ করে আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে ঠিকই, কিন্তু লাগেজও আপনার সঙ্গে পৌঁছুলে বুঝতে হবে, আপনি খুব পুণ্যবান লোক!
পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে হাতের ব্যাগটাতে বাড়তি কিছু কাপড়-চোপড় নিয়েছিলাম বলে রক্ষা। কিন্তু আর সবকিছুই তো বড় স্যুটকেসটাতে। যতবার বিমানবন্দরে লিয়াটের অফিসে ফোন করি, চার-পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করানোর পর জানানো হয়, প্রার্থিত বস্তুটি এখনো পৌঁছেনি। পৌঁছুলেই ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হবে। ক্রিস্টাল হাইটস গেস্ট হাউসের স্বত্বাধিকারিণী ভার্জিনিয়া ফিলিপস এদের খুব ভালো চেনেন। তিনিই বললেন, ‘তোমার স্যুটকেস হয়তো বিমানবন্দরে এসে পড়ে আছে। এরা জানেও না। তুমি বরং সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যাও।’
বিমানবন্দর তো ক্রিস্টাল হাইটসের নিচেই। উঁকি দিলেই দেখা যায়। কিন্তু সেন্ট ভিনসেন্টকে প্রকৃতি এমনই বহুতল করে বানিয়েছে যে, ঘোরানো প্যাঁচানো পথে সেখানে যেতেও ট্যাক্সিতে মিনিট দশ-পনেরো লেগে যায়। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেখেই চিনলাম। কী আশ্চর্য, সে-ও আমাকে! ‘হাই মান, তোমরা এর আগেও তো এসেছিলে! বাকি দুজন কই?’
বিমানবন্দরে যাব শুনে সাম বলল, ‘আমি তো ভাবলাম, তুমি কার্নিভালে যাচ্ছ! সেন্ট ভিনসেন্টের সবাই তো আজ ওখানে।’ তাই নাকি, সেন্ট ভিনসেন্টে এখন কার্নিভাল হচ্ছে? ‘ইয়া মান, আজই তো ভিন্সি মাসের শেষ দিন। চলো তোমাকে ওখানে নামিয়ে দিই।’
ব্রাজিলের কার্নিভাল বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত, আর ক্যারিবিয়ানে সবচেয়ে বিখ্যাত ত্রিনিদাদেরটা। ক্যারাবিয়ানের চরিত্র অনুযায়ী অন্য কোনো দ্বীপ থেকে সেই স্বীকৃতি মেলার প্রশ্নই নেই। সামই যেমন বলল, ‘ত্রিনিদাদের কার্নিভাল নিয়ে লোকে এত কথা বলে, কিন্তু সেন্ট ভিনসেন্টেরটা অন্য রকম!’
অন্য রকম তো বটেই। কার্নিভাল ক্যারিবিয়ানের সব দ্বীপেরই সাংবাৎসরিক উৎসব। তবে প্রতিটিই নাকি আলাদা, কোনোটিই অন্যটির মতো নয়। পর্যটকদের জন্যও এটি বড় আকর্ষণ বলে আয়োজিতও হয় ভিন্ন সময়ে। বারবাডোজের কার্নিভাল যেমন আগামী ৩ আগস্ট। সেদিনই আমি সেন্ট কিটস থেকে দেশে ফেরার পথে বারবাডোজ হয়ে যাব শুনে অনেক বাজানই বলেছেন, এর চেয়ে আফসোস আর হয় না! কার্নিভালের দিন বারবাডোজে বাইরে থেকে অনেকেই আসে। কেউ বারবাডোজ থেকে বাইরে যায় না।
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা এমনিতে উৎসবপ্রবণ জাতি। শরীরে আফ্রিকান রক্ত, কোথাও একটু গান-টান শুনলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুলতে শুরু করে সেই শরীর। প্রাণভরে নাচ-গান করার জন্য কার্নিভালের মতো একটা কিছু যে তারা বানিয়ে নেবে, সেটি তো খুবই স্বাভাবিক। এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিকড় অবশ্য অনেক গভীরে লুকিয়ে। বারবাডোজের কার্নিভালের জন্ম যেমন আখ চাষের মৌসুমের সমাপ্তি উদযাপন করতে। একটা সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদিত হতো বারবাডোজে। সেই চিনিতে মিশে থাকত অসহায় শ্রমিকের ঘাম-রক্ত। আখ চাষের জন্য আফ্রিকা থেকে জাহাজ ভরে আনা হতো ক্রীতদাসদের, রক্ত জল করা পরিশ্রমের মৌসুম শেষ হওয়ার পর তাদের একটু আনন্দ-ফুর্তি করার সুযোগ হয়ে আসত এই কার্নিভাল।
আচ্ছা, ‘কার্নিভাল’ মানে কী? হাতের কাছে ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান নেই। থাকলে কার্নিভালের আভিধানিক অর্থটা একটু দেখে নেওয়া যেত। সেন্ট ভিনসেন্টের কার্নিভাল দেখার পর মনে হচ্ছে, অর্থটা ‘মহোৎসব’ হলে খুব ভালো হয়। রঙের মহোৎসব, প্রাণোচ্ছ্বাসের মহোৎসব।
‘ভিন্সি মাস’ নামের সেন্ট ভিনসেন্টের এই কার্নিভাল শুরু হয়েছে গত ২৬ জুন। গত পরশু সমাপ্তির দিন খাবাবের দোকান ছাড়া বাকি সব বন্ধ, সরকারি ছুটি বলে অফিস-আদালতও। গাড়ি-টাড়িও থেমে যাচ্ছে অনেক দূরে। কিংসটাউনের রাস্তা যে শুধুই কার্নিভালের জন্য। চূড়ান্ত দিনে সেখানে সাধারণের চলাচলেরও অধিকার নেই।
কার্নিভাল এখন আর শুধুই উৎসব নয়, প্রতিযোগিতাও। দল হয়ে এতে অংশ নিতে হয়। ‘পার্ক’ নামে একটা বড় খোলা চত্বরে নাচগান করার পর দলগুলো রাস্তায় মার্চপাস্টের মতো করে। বিচারকেরা সব দেখে-টেখে নির্ধারণ করেন বিজয়ী। বাণিজ্যিকীকরণের এই যুগে যথারীতি ‘ব্যান্ড’ নামে পরিচিত প্রতিটি দলেরও স্পনসর আছে। থাকতেই হবে। নইলে এই বিশাল ব্যয়ভার বহন করবে কে?
ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশটাই যায় পোশাকে। কী যে বর্ণিল, কী যে বিচিত্র সেই পোশাক! আর বিচিত্র অঙ্গসজ্জা তো আছেই। পেছনে ময়ূরের পেখম লাগিয়ে তরুণ, চাকা লাগানো আছে বলেই সম্ভব হচ্ছে বিশাল সেই ভার টেনে নেওয়া। এক তরুণী পরি সেজেছেন, তাঁর দুই পাখা রাস্তা ছাড়িয়ে প্রায় ফুটপাতে। প্রতিটি ব্যান্ডের সঙ্গেই সাউন্ড বক্সে সাজানো একটা করে ট্রাক। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া গানের এমনই আওয়াজ যে, কানে তালা লেগে যাওয়া কথাটার অর্থ হাতে-কলমেই জানলাম!
মিউজিক বাজছে আর তালে তালে নেচে যাচ্ছে বর্ণিল নারী-পুরুষ। শিশু থেকে শুরু করে প্রায় বুড়ো পর্যন্ত সব বয়সীই আছে তাতে। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি এবং তাদের পোশাক-আশাক দেখে মনে হলো, বস্ত্র সাশ্রয়ের কোনো মহাপরিকল্পনার প্রদর্শনী এটি। আর নাচের সব মুদ্রাই ফুটল তাদের শরীরে, যার কোনোটিরই বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
জীবনে প্রথমবারের মতো কার্নিভাল দেখার সুযোগ পেয়েছি। ছবি তুলতে তুলতে ডিজিটাল ক্যামেরার ‘মেমোরি ফুল’! অথচ ল্যাপটপে তা ডাউনলোড করে দেখি, বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপতে হলে শুধু শিশুদের ছবিটাই ছাপা যায়!
সংযোাজন: পত্রিকায় শুধু শিশুদের ছবিটাই ছাপা হয়েছিল। ওয়েবসাইটে আরও দুটি ছবি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
৮ জুলাই ২০০৯, সেন্ট ভিনসেন্ট।
আরও পড়ুন:
ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...
ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত
ক্যারিবীয় কড়চা-৩: বারবাডোজ যেখানে আলাদা
ক্যারিবীয় কড়চা-৪: সোবার্স-উইকস সন্ধ্যা
ক্যারিবীয় কড়চা-৫: আহ্, সেন্ট ভিনসেন্ট!