রমন লাম্বাকে কীভাবে ভুলবেন অপি!

শুভ্র.আলাপ

৫ মে ২০২১

রমন লাম্বাকে কীভাবে ভুলবেন অপি!

সাইফুল্লাহ খান জেমের ডেলিভারিতে অপির সজোরে করা পুল শটে বল গিয়ে লাগল লাম্বার মাথায়, তিন দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে লাম্বা পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। আজ তেইশ বছর পরে অপি কী বলছেন সেই ভাগ্যাহত লাম্বাকে নিয়ে? এখন কিংবা তখন, আলাপটা উঠতই। তবে খুব বেশি স্পর্শকাতর বলেই শুভ্র.আলাপে উৎপল শুভ্র প্রসঙ্গটা তুললেন সবার শেষে। রমন লাম্বাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে গেলেন অপি।

২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে মুখোমুখি আবাহনী-মোহামেডান। ডিপিএলের নিয়মিত মুখ রমন লাম্বা আবাহনীর হয়ে ফিল্ডিংয়ে, মোহামেডানের ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন অপি পাঁচ চার মেরে পৌঁছে গেছেন ২০ রানে। বোলিং করছেন তখন বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জেম, ওভারের শেষ বল করার আগে হঠাৎ করেই লাম্বার মনে হলো, শর্ট লেগে এসে দাঁড়াবেন তিনি।

ঘটনার পরবর্তী অংশটা অপি বিবৃত করছেন এভাবে, 'আমি তখন সেট হয়ে গেছি। ওভারের লাস্ট বলের আগে হঠাৎ করেই (শর্ট লেগে) যখন তিনি (লাম্বা) দাঁড়ালেন, খালেদ মাসুদ পাইলট কিন্তু তাঁকে বলেছিলেন, "অ্যাবডোমেন গার্ড আর হেলমেটটা নিয়ে নাও।" তখন হেলমেট আর অ্যাবডোমেন গার্ডটা আনা হলো, কিন্তু হেলমেটটা না নিয়ে তিনি শুধু অ্যাবডোমেন গার্ডটা নিলেন। বললেন, একটা বলের ব্যাপার। কোনো সমস্যা নেই।'

মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনাটা ঘটনা ঘটে গেল সেই 'একটা বলে'ই'। শুনুন অপির মুখেই, 'সাইফুল্লাহ খান জেমের সেই শর্ট ডেলিভারিটা ভেরি আনফরচুনেট। বলটাই এমন ছিল, শুধু আমি কেন, আমার জায়গায় যেকোনো ব্যাটসম্যানই যদি থাকত, পুল শটই করত। আমার শরীরে যত শক্তি ছিল, সমস্ত শক্তি দিয়েই কিন্তু আমি বলটিকে আঘাত করেছিলাম। তাঁর কপালের বাম দিকে বলটি আঘাত করে।'

আবাহনী ক্লাবে রমন লাম্বার কফিনে সবার ফুল দেওয়া শেষ হওয়ার পর অপি এসেছিলেন সবার শেষে

তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্য বোঝা যায়নি ঘটনার ভয়াবহতা। ড্রেসিংরুমে ফিরে তাঁর সতীর্থ মনজুর এলাহি কাগজ-কলম বাড়িয়ে দিলে লাম্বা উল্টো লিখে দেন, 'আই ফেল্ট ফানি।' তাঁকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে যাওয়া হয় সে সময়ের পিজি হাসপাতালে, দেশের একমাত্র সিটি স্ক্যান মেশিনটা সেখানেই ছিল। সে সময় দেশের স্বনামধন্য নিউরোসার্জন ডাঃ রশিদউদ্দিন আহমেদ তাঁর অস্ত্রোপচারও করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে ক্রমশ। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে পরাজয় বরণ করেছিলেন লাম্বা। ধরা গলায় অপি বলেন, '(ঘটনার পর) আমি অল মোস্ট দুই মাস স্বাভাবিক ছিলাম না; স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারপরও পারছিলাম না। ঘুমাতে গেছি, ঘুম আসছিল না। এত বড় একটা দুর্ঘটনা আমার হাতেই ঘটে যাবে, খুবই আনফরচুনেট।' লাম্বার পরিবারের জন্য এখনো সমব্যথী শোনায় অপির কণ্ঠ, 'যার যায়, একমাত্র সে-ই বোঝে। তাঁর পরিবারের জন্য সমবেদনা সবসময়ই থাকবে।'

হিউজের মাথায় হেলমেট থাকার পরও সেটি তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কে জানে, লাম্বা হেলমেটটা পড়লে হয়তো তাঁকে এমন অকালে চলে যেতে হয় না। আর কারও যেন লাম্বার মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়, সে জন্য খেলোয়াড়দের পরামর্শও দিলেন অপি, 'এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রোটেকশন অবশ্যই নেওয়া উচিত। নট অনলি ক্রিকেট, যেকোনো খেলাতেই আপনার যদি প্রোটেকশন নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়, তা নিয়েই খেলা উচিত।'

এমন হেলমেট ছাড়াই ব্যাটসম্যানের নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্বে ফিল্ডিং করতেন অসমসাহসী লাম্বা। এটাই কাল হলো তাঁর জন্য। ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে পেসার শন অ্যাবটের বাউন্সার মাথায় লেগে ফিল হিউজের মৃত্যুর পর অপি বলছিলেন, অ্যাবট এখন কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা তিনি খুব ভালো বুঝতে পারছেন। হিউজের শোকে কাতর হবার পাশাপাশি ক্রিকেট বিশ্ব উদ্বিগ্ন হয়েছিল অ্যাবটের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও। এই দুঃস্মৃতি অ্যাবটের ক্যারিয়ারই ওলট-পালট করে দেয় নাকি, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন মাইকেল ক্লার্ক, স্টুয়ার্ট ক্লার্কের মতো অনেকেই। ২০১৮ সালে অ্যাবটেরই করা আরেকটি বল উইল পুকোভস্কির হেলমেটে আঘাত করলে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় শেন অ্যাবটকে।

অপির অভিজ্ঞতাও অনেকটা অ্যাবটেরই মতো, বিনা অপরাধেই নিজেকে দোষী মনে হয় যেন। শুভ্র.আলাপে নিজে থেকেই অপি জানান, রমন লাম্বার ওই দুর্ঘটনা এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে এবং আজীবনই তা বেড়াবে। 'আমাকে অনেক সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, কিন্তু কখনো আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারি নাই। আমার ক্রিকেটিং লাইফের খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা এটা। সারা জীবনই টানব এই স্মৃতি।'

অপি টানলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট অবশ্য টানেনি লাম্বার স্মৃতি। যে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে লাম্বার মৃত্যু, কিংবা যে আবাহনী ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা; কোথাও লাম্বার কোনো স্মৃতিচিহ্নই নেই। অথচ ক্রিকেটমহলের পেছনের বেঞ্চের এক ছাত্র নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছে রমন লাম্বাকে। উৎপল শুভ্রই জানালেন, সেই কোন জন্মে বেলফাস্টের যে নর্থডাউন ক্লাবে খেলে গিয়েছেন লাম্বা, অথচ ২০১২ সালে সেখানে গিয়ে শুভ্র অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলেন, সেই ক্লাবঘরের দেয়ালে ঝুলছে রমন লাম্বার ছবি। কেবলমাত্র অনেক বছর ওই ক্লাবে খেলেছেন বলে লাম্বার ছবি টাঙানো রাখা আছে ক্লাবঘরে। অন্য সব ছবিতে কীর্তিমানের নাম-ধাম উল্লেখ থাকলেও লাম্বার ছবির নিচে লেখা নেই কিছু। যার একটা ব্যাখ্যাই খুঁজে পেয়েছেন শুভ্র, 'ক্লাব কর্তারা বোধহয় ভেবেছেন, লাম্বাকে কে না চেনে!'

ছবি: উৎপল শুভ্র

টাইটানিকের নকশাকারের প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবের সঙ্গে অনেক বছর জড়িয়ে থাকা কিউরেটরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লাম্বাকে নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসটা ঠিকই স্পর্শ করে যায় শুভ্রকে। লাম্বার কল্যাণেই যে ফিজিক্যাল ট্রেনিং ও আধুনিক প্র‍্যাকটিসে নানা কিছুর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ওই ক্লাবের অন্য খেলোয়াড়দের। শুভ্র তো এমনও বললেন, লাম্বা নাকি ক্রিকেট সংস্কৃতিটাই বদলে দিয়েছিলেন উত্তর আয়ারল্যান্ডের ওই ক্লাবের।

প্রশ্নটা হচ্ছে, কেবল আমরাই কেন পারলাম না লাম্বার স্মৃতিকে ধরে রাখতে? লাম্বা মারা যাওয়ার পর বলা হয়েছিল, যে ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ওই দুর্ঘটনা, সেটির একটা বোলিং প্রান্ত রমন লাম্বার নামে নামকরণ করা হবে। ওই স্টেডিয়ামে যখন আর ক্রিকেটই খেলা হয় না, তা হয়তো করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু লাম্বার স্মরণে কোথাও একটা অন্তত একটা ফলক তো থাকতে পারত বলে দুঃখ করলেন শুভ্র। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের হোম ড্রেসিংরুমের বাইরে যেমন আছে ফিল হিউজের। যা নিজেই দেখে এসেছেন শুভ্র। অপি বললেন, আমাদের খেলাধুলার সংস্কৃতিটাই এখনো ওই পর্যায়ে যায়নি বলেই আমরা লাম্বাকে ভুলে গেছি। 'হয়তো আমরা পারতাম। কিন্তু আমাদের স্পোর্টস কালচারটাই এখনো ওরকমভাবে তৈরি হয়নি। আমরা ইংল্যান্ডের কথাই যদি বলি, প্রতিটা ক্লাবে খেলোয়াড়দের আলাদা সম্মাননা দেওয়া হয়, বেনিফিট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। আমাদের দেশে কোনো স্পোর্টসেই কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এখন পর্যন্তও না। আমরা যতদিন না খেলোয়াড়দের সম্মান দিতে পারব, আমার মনে হয় না, ততদিন পর্যন্ত আমরা এ ধরনের অ্যাক্টিভিটিজ করতে পারব।'

কথাটা বলতে বলতে অপির মুখটা ম্লান হয়ে আসে। আমাদের ক্রীড়া সংস্কৃতির দীনতার কথা ভেবে যেমন, তেমনি রমন লাম্বার কথা ভেবেও। এই একটা নাম চিরদিনই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়াবে তাঁকে।

আরও পড়ুন: 
লাম্বার সেই নেশাই এমন প্রাণঘাতী হলো!
আবাহনী লাম্বাকে ভুলে গেছে, বেলফাস্টের নর্থডাউন ক্লাব ভোলেনি
অপির চোখে তাঁর সময়ের অন্য তিন ওপেনার বিদ্যুৎ-জাভেদ-রোকন

 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×