ইউসুফ ইয়োহানার একান্ত সাক্ষাৎকার
শেষ বলে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরির নায়ক
২০০০ এশিয়া কাপ ক্রিকেট
উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা, বরং বলা ভালো, সবাইকে কাঁপাতে থাকা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ঢাকায় ২০০০ এশিয়া কাপের সেই ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে ইনিংসের শেষ বলে ছক্কা মারতে হতো ইউসুফ ইয়োহানাকে। তা-ই মেরে দিলেন। পরে দলের জয় আর ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি মিলে তিনিই ওই মহারণের নায়ক। পরদিন সাংবাদিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতেও তিনি। এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউটা অবশ্য শুধু আমিই পেয়েছিলাম। লাঞ্চ করতে করতে নেওয়া সেই ইন্টারভিউ চিনিয়ে দিয়েছিল মানুষ ইউসুফকেও।
প্রথম প্রকাশ: ৫ জুন ২০০০। প্রথম আলো।
গত পরশু পর্যন্ত অবস্থাটা ছিল অন্যরকম। ইউসুফ ইয়োহানাকে ঘিরে তখনো ভিড় জমেছে, অটোগ্রাফশিকারীরা প্রত্যাশাভরে বাড়িয়ে দিয়েছে খাতা। তবে গতকাল দুপুর দুটোর দিকে লিফট থেকে ইউসুফ ইয়োহানাকে বেরুতে দেখে হোটেল শেরাটনের লবিতে যে আলোড়নটা জাগল, সেটি একেবারেই নতুন।
আগের দিন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের নায়ক তিনি—তাঁকে ‘হিরো’ বানাতে যথেষ্ট ছিল এটিই। শেষ বলে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করাটা বলতে গেলে ‘রূপকথার নায়ক’ বানিয়ে দিয়েছে তাঁকে। পেস বোলার মোহাম্মদ আকরামের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে খেতে একান্ত সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় অবশ্য মোটেই সেরকম কিছু মনে হলো না তাঁকে। চেহারা, পোশাক-আশাকের মতো আচরণেও একদম সাধারণ; তারকাসুলভ যে অহম ঘিরে থাকে এই উপমহাদেশের ক্রিকেটারদের, তার সঙ্গে একদমই বেমানন। ইউসুফ ইয়োহানাকে বলতে হবে একটু ব্যতিক্রমই। সেরকমই হওয়ার কথা, কারণ তাঁর জীবনের লক্ষ্যই ‘আচ্ছা ইনসান’ হওয়া।
পাশে বসে থাকা মোহাম্মদ আকরাম সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘ সে লক্ষ্য তো পূরণ হয়েই গেছে। তুমি তো আসলেই খুব ভালো মানুষ।’ উত্তরে লাজুক হাসি হাসলেন ইয়োহানা, সঙ্গে ছোট্ট একটা প্রতিজ্ঞা, ‘আমি এরকমই থাকতে চাই চিরদিন।’ নাম-খ্যাতি-অর্থ এসব যেন তাঁকে বদলে না দেয়, নিজেই নিজেকে বারবার এ কথা মনে করিয়ে দেন ইয়োহানা। মানুষ হিসেবে এরকমই থাকতে চান, তবে ক্রিকেটার হিসেবে একটি পরিবর্তন চান খুব তাড়াতাড়িই। এই যে একদিন অসাধারণ ব্যাট করে তারপর অনেক দিন খোঁজ থাকে না তাঁর—বেরিয়ে আসতে চান এই ধারাবাহিকতাহীনতার চক্কর থেকে। সে পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন বলেও মনে করেন তিনি। সত্যিই তো, ওয়েস্ট ইন্ডিজে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরির পর ঢাকায় দুই ম্যাচে ৮০ ও অপরাজিত ১০০—এর চেয়ে ধারাবাহিকতা আর কী দেখাবেন তিনি?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যান্টিগায় তৃতীয় টেস্টে প্রায় একা লড়াই করে খেলা অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংসটিকে তাঁর ২১ টেস্টের ক্যারিয়ারে সেরা ইনিংস রায় দিলেন। একইভাবে ৫৯ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা বলে মানছেন গত পরশু (৩ জুন ২০০০) ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১০০ রানের ইনিংসটিকে, ‘আমি একেবারে আমার মনমতো খেলতে পেরেছি। ব্যাট করতে নামার পরই দুটি উইকেট পড়ে যাওয়ায় বেশি ঝুঁকি নিইনি, তারপরও কিন্তু মঈন ভাইয়ের সঙ্গে ওভারে ৫/৬ করে নিচ্ছিলাম। ঠিক করে রেখেছিলাম ৪০ ওভারের পর থেকেই মারব।’
তা না হয় ঠিক করে রাখলেন, কিন্তু ইনিংসের শেষ বলে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরিতে পৌঁছার আশা কি সত্যিই করেছিলেন তিনি? তাঁর সরল উত্তর, ‘শেষ বলটিতে আমি এমনিতেও চালাতাম। সেঞ্চুরির জন্য যখন ৬ রান প্রয়োজন, তখন তো একটা চেষ্টা করবই।’ সবার জানা সেই চেষ্টায় তিনি সফল। শেষ বলে ছক্কা মারার এই কীর্তি ১৪ বছর আগের একটি স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে ইয়োহানার মনে। ড্রেসিংরুমে ফেরার পর পিঠ চাপড়ে যলা যাঁর ‘সাবাস’ শব্দটিকে এই ইনিংস খেলার সবচেয়ে বড় পুরস্কার মনে করছেন, সেই জাভেদ মিয়াঁদাদ ১৯৮৬ সালে ভারতের অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে যখন শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতান, ইউসুফ ইয়োহানা তখন ১১-১২ বছরের কিশোর। এর অনেক আগে থেকেই তিনি জাভেদ মিয়াঁদাদ বলতে পাগল, শারজার বীরত্বের পর তাঁর আপ্লুত ভাব বেড়ে যায় আরও। এই এত বছর পরও, জাভেদ মিয়াঁদাদ যখন দলের কোচ, যখন তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ-কথাবার্তা হচ্ছে, তখনো সেই মুগ্ধতা একদমই কাটেনি ইয়োহানার। মুগ্ধ স্বরেই বললেন, ‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলব জাভেদ ভাইয়ের চেয়ে বড় কোনো ব্যাটসম্যান হতে পারে না। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি তাঁর ভক্ত, জাভেদ ভাইয়ের ব্যাটিংয়ের সময় আমাকে টিভির সামনে থেকে নড়ানো যেত না।’
জাভেদ মিয়াঁদাদের ব্যাটিংয়ের কোন দিকটি তাঁকে এত টানত? ‘জাভেদ ভাই অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। আমিও ওরকম হতে চাই। সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি ব্যাপার নয়, এই রেকর্ড করতে হবে, ওই রেকর্ড করতে হবে—এসবও একদমই ভাবি না। দল না জিতলে সেঞ্চুরি করে কী লাভ? যে কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অমন ইনিংস খেলেও আমার মন খারাপ হয়েছে, কারণ আমরা জিততে পারিনি। আমি শুধু চাই, আমার ব্যাটিংয়ে দল জিতুক। সেঞ্চুরি না হয়ে ৪০-৫০ রানের ইনিংস খেলে তা করতে পারলেও আমি খুশি।’ জাভেদ মিয়াঁদাদকে আবার কোচ হিসেবে ফিরে পেয়েও একই রকম খুশি হয়েছেন ইয়োহানা, ‘আমার জন্য এটি খুব ভালো হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে গুড লেংথ বলে আমার কিছু সমস্যা হচ্ছিল। জাভেদ ভাই আমাকে আলাদা করে নিয়ে কদিন প্র্যাকটিস করালেন, সেই সমস্যা এখন আর নেই।’
সমস্যা যে নেই, সেটি তো তাঁর সাম্প্রতিক স্কোর থেকেই স্পষ্ট। এবং তা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটি থেকেই। এ কারণেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটাকে দেখেছেন তাঁর ক্যারিয়ারের একটা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। ’৯৮-এর ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের সপ্তম টেস্টেই সেঞ্চুরির পর প্রায় দেড় বছরের বিরতি, টেস্টে আবার সেঞ্চুরি পেলেন গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে, ২০তম টেস্টে। তবে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পাওয়ার পর তৃতীয়টি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে মাত্র কয়েক দিন। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের আগে বেশি কিছুদিন আমি তেমন রান পাচ্ছিলাম না। ব্রিজটাউনে ওই সেঞ্চুরিটি তাই আমার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়। অ্যান্টিগার সেঞ্চুরিটি সেই আত্মবিশ্বাসেরই ফসল।’
এই যে কাল আমি সেঞ্চুরি করলাম, ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলাম। অথচ এই ঢাকাতেই প্রথম খেলতে নেমে আমি ক্যাচ ছেড়ে দিয়ে ভিলেন হয়ে গিয়েছিলাম। দেখ, ঈশ্বর আবার সেই মাঠেই এমন সফল করলেন আমাকে।’
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারির মুখোমুখি হওয়াটাকেও দারুণ এক অভিজ্ঞতা মানছেন ইয়োহানা। অ্যামব্রোস-ওয়ালশ-কিং-রোজ-ম্যাকলিনদের খেলে আসার পর ঢাকার ফ্ল্যাট উইকেটে কুমারন-ভান্ডারিদের খেলাও খুব সহজ বলে মনে হয়েছে তাঁর। এই প্রসঙ্গেই এল প্রশ্নটা, ‘ক্যারিয়ারে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে কোন বোলারকে?’ ইয়োহানার উত্তর, ‘ওয়ালশ। ওর বয়সে হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও এখনো ও ভয়ঙ্কর।’
মাঠেই হোক বা টিভি পর্দাতেই হোক, ইয়োহানাকে যাঁরা সেঞ্চুরি বা হাফ সেঞ্চুরি করতে দেখেছেন, তাঁদের সবারই জানা—এরকম কেনো ফাইলফলকে পৌঁছানোর পর সবার আগে ক্রুশচিহ্ন এঁকে স্মরণ করে নেন তিনি প্রভু যিশুকে। এই প্রসঙ্গ যখন তোলা হলো, দেখা গেল সেই ছেলেবেলায় কার কার উৎসাহ পেয়েছিলেন, জাভেদ মিয়াঁদাদ তাঁকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছেন, এখনও কতটা করছেন—এসব কিছুই গৌণ হয়ে যাচ্ছে ইয়োহানার কাছে, তাঁর চোখের সামনে ভাসছে শুধুই অদৃশ্য এক শক্তি। ঈশ্বরই তাঁর সব সাফল্যের নিয়ন্তা, তিনি চেয়েছেন বলেই এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন তিনি! ‘ঈশ্বরই আমাকে সব দিয়েছেন। এই বিশ্বাসই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি’—এটা বলে যুইসই উদাহরণও পেয়ে গেলেন হাতের কাছে, ‘এই যে কাল আমি সেঞ্চুরি করলাম, ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলাম। অথচ এই ঢাকাতেই প্রথম খেলতে নেমে আমি ক্যাচ ছেড়ে দিয়ে ভিলেন হয়ে গিয়েছিলাম। দেখ, ঈশ্বর আবার সেই মাঠেই এমন সফল করলেন আমাকে।’
ঢাকায় যে প্রথম খেলার কথা বললেন ইয়োহানা, সেটি ’৯৮-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ। সেই টুর্নামেন্টেই ইয়োহানা প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তান দলে। খেলার সুযোগ হয়নি এক ম্যাচেও। পরিবর্ত ফিল্ডার হিসেবে ফিল্ডিং করতে নেমেছিলেন ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে। রবিন সিংয়ের দেওয়া ক্যাচ ছয় হয়ে গিয়েছিল লং অনে দাঁড়ানো ইয়োহানার দুহাতের মাঝখান দিয়ে। এরপরই সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে দারুণ এক পার্টনারশিপ গড়ে ভারতেকে বিশ্ব রেকর্ড করা জয়ের দিকে নিয়ে যান রবিন সিং। এতদিন ঢাকা স্টেডিয়াম বলতে ইউসুফ ইয়োহানার চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই দুঃস্বপ্ন। এই শনিবারের পর থেকে সেই দুঃস্বপ্নের জায়গা নিয়েছে ইনিংসের শেষ বলে ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি করার আনন্দ, ঢাকার মাঠে সেই ভারতের বিপক্ষে ঠিক পরের ম্যাচটিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার হাতে হাসিমুখে ফটোগ্রাফারদের পোজ দেওয়ার সুখস্মৃতি—ঢাকা স্টেডিয়ামকে এখন বড় ভালো লাগছে ইয়োহানার!
আরও পড়ুন: