নর্দাম্পটনে বুলবুল-আকরাম-সুজনরা কেউ কাঁদেননি

নর্দাম্পটনে পাকিস্তান জয়

উৎপল শুভ্র

৩১ মে ২০২১

নর্দাম্পটনে বুলবুল-আকরাম-সুজনরা কেউ কাঁদেননি

জয় তখনো আসেনি, কিন্তু সুবাস তো পাওয়া যাচ্ছিল। নর্দাম্পটনে বাংলাদেশ দল। ছবি: এমপিক্স

পাকিস্তানের সঙ্গে জয়, তা-ও বিশ্বকাপ অভিষেকেই--বাঁধভাঙা উদযাপনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু জয়টা অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তা আর হয়নি। আইসিসি ট্রফিতে হল্যান্ডের বিপক্ষে জয় বা এই বিশ্বকাপেই স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর যা হয়েছিল, তেমন আবেগেও ভেসে যায়নি সবাই।

প্রথম প্রকাশ: ২ জুন ১৯৯৯। প্রথম আলো।

সাঈদ আনোয়ার, ইজাজ আহমেদ, ইনজামাম-উল-হক, সেলিম মালিক—বিশাল বিশাল সব ব্যাটসম্যান এভাবে ভেঙে পড়েই সর্বনাশটা করেছেন। শুধু পাকিস্তানের নয়, বাংলাদেশেরও। পাকিস্তানের সর্বনাশের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু বাংলাদেশেরটা কেমন?

পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা এত বেশি খারাপ খেলেছে যে, এমন একটা জয়ের পরও বাংলাদেশের আনন্দটা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে পরিণত হতে পারেনি সঙ্গে সঙ্গে। কোনো টেস্ট প্লেয়িং দেশের বিপক্ষে প্রথম জয়, এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিটদের বিপক্ষে জয়—এসব বিচারে গত পরশুর নর্দাম্পটনের সাফল্যের কোনো তুলনা নেই বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে। এই কীর্তিকে শুধু ক্রীড়াতেই বা সীমাবদ্ধ রাখা কেন, যেকোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সেরা অর্জন বিবেচিত হতে পারে বাংলাদেশের এই 'পাকিস্তান জয়'।

তবে গত আইসিসি ট্রফি কোয়ার্টার ফাইনালে হল্যান্ড কিংবা এই বিশ্বকাপেই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের মুহূর্তটিতে সবার বন্ধ আবেগ যেমন হঠাৎ করে শ্যাম্পেনের ফেনার মতো ছিটকে বেরিয়েছিল, সোমবার নর্দাম্পটনে ঠিক তা হয়নি। কারণ আবেগটা শুধু এক মুহূর্তের জন্য জমা হয়ে থাকেনি, পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের প্যাভিলিয়নে ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি বাংলাদেশের বোলাররা এত বেশি নিয়মিতভাবে করেছে যে, সাকলায়েন মুশতাকের রান আউটটি কোনো অনিশ্চয়তার অবসান ঘটায়নি, বরং শুধুই আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছে এর মাধ্যমে।

পাকিস্তানের তিন রান আউটের প্রথমটি। শিকার সাঈদ আনোয়ার

ওয়াসিম আকরাম আর আজহার মেহমুদের ৫৫ রানের পার্টনারশপটি ছাড়া বাংলাদেশকে তো ‘উইকেট নিতে হবে’—এই চিন্তাতেই পড়তে হয়নি কখনও। আজহার মেহমুদ যখন রান আউট হয়ে গেলেন, তখনই আসলে বিজয়োৎসব শুরু করে দিতে পারত বাংলাদেশ। ১৯৭৫ বিশ্বকাপে এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই শেষ উইকেট জুটিতে ৬৪ রান তুলে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়েছিলেন ডেরেক মারে ও অ্যান্ডি রবার্টস, সেই ইতিহাস মাথায় থাকায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ছিলেন বাড়তি সতর্ক। তাছাড়া অভিজ্ঞতাও বেড়েছে ওঁদের, শিখেছেন অনেক কিছু। উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ পাইলট যেমন বললেন, ‘ওয়াসিম আকরাম আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেভাবে নিশ্চিত হতে পারিনি। কারণ এর আগে বড় দলগুলোর বিপক্ষে তো শুরুতে ২/৩ উইকেট ফেলে দেয়ার পরও দেখেছি, কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে গেছে। তাই ভয়টা ছিলই।’

সুজন আবির্ভূত হয়েছিলেন ইংলিশ কন্ডিশনের আদর্শ সিম বোলার হিসেবে। এখানে এলবিডব্লিউর শিকার সেলিম মালিক

এদিন বাংলাদেশের উজ্জীবিত বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের সমানে আর দাঁড়াতে পারেননি কেউ। খালেদ মাহমুদ সুজন আবির্ভূত হয়েছেন ইংলিশ কন্ডিশনের আদর্শ সিম বোলার হিসেবে আর বাংলাদেশ এর চেয়ে ভালো ফিল্ডিং সম্ভবত করেনি কখনোই। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিনটি বিভাগই একই সঙ্গে জ্বলেও উঠল হয়তো এটাই প্রথম। ‘স্মরণীয় জয়’, 'ঐতিহাসিক জয়'—অনেকভাবেই বর্ণনা করা হচ্ছে এই সাফল্যকে। সেগুলো বাড়াবাড়িও কিছু নয়। ম্যাচের দিন সকালেও কল্পনা করা যায়নি এটি, লাঞ্চের সময়ও কি গিয়েছিল! তবে হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটির পর যা হয়েছিল, এমন একটা জয়ের পরও তা হয়নি। কাঁদতে দেখা যায়নি কাউকে!

হল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দুটিতে সকাল থেকে বাংলাদেশের সম্ভাবনার গ্রাফটিতে এত বেশি উত্থান-পতন হয়েছিল যে, খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকে জমে থাকা আবেগ-উদ্বেগ-আনন্দ সব কিছু এক ধাক্কায় বেরিয়ে এসেছিল উচ্ছ্বাস হয়ে। পাকিস্তানের বিপক্ষে তো সকাল থেকেই বাংলাদেশের দিন, দুশ্চিন্তার কালো মেঘ দেখা যায়নি এক মুহূর্তের জন্যও। এমন পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আগাগোড়া ভালো খেলে ছিনিয়ে আনা এই জয়ের মহিমা তাই অনেক বেশি।

ইনজামাম এলবিডব্লিউ খালেদ মাহমুদ ৭। ছবি: এএফপি

জয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মাত্রা নিয়ে যে এত কথা বলা হলো, তাতে ভুল বোঝার অবকাশ আছে। আনন্দ কিন্তু নর্দাম্পটনেও ভালোই হয়েছে এবং তা সবচেয়ে বেশি করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রথম বিশ্বকাপটা ঠিক জায়গাতেই খেলতে এসেছে বাংলাদেশ। মাঠ, কন্ডিশন হয়তো অচেনা ছিল, তবে গ্যালারির দিকে তাকিয়ে খেলোয়াড়দের মনে হয়েছে, হোমগ্রাউন্ডেই খেলছেন তাঁরা। ঢাকা স্টেডিয়ামেও এত লাল-সবুজের ছড়াছড়ি থাকে না সব সময়। ইংল্যান্ডে প্রবাসী পাকিস্তানিদের সংখ্যাও কম নয়। নর্দাম্পটনের আগ পর্যন্ত তাদের ৪টি ম্যাচে পাকিস্তানেরও হোমগ্রাউন্ডে খেলার অনুভূতিই হয়েছে, এদিনই প্রথম গ্যালারিতে পাকিস্তানিদের ছাড়িয়ে গেল প্রতিপক্ষ সমর্থকদের উপস্থিতি।

টিভি আম্পায়ার সাকলায়েনকে রান আউট না দিলে আবার খেলা শুরু করা কঠিনই হতো

মাঠে নিরাপত্তা নিয়ে তাই বাড়তি দুশ্চিন্তাও ছিল। এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ব্যাগ-ট্যাগ খুলে দেখা হলো সবার। মাঠের চারপাশ ঘিরে থাকল ১২০ জন নিরাপত্তারক্ষী। তবে তারপরও এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্যটিই পুনরাভিনীত হলো ম্যাচ শেষে। দলে দলে দর্শক ঢুকে গেল মাঠে, খেলোয়াড়েরা জয়-পরাজয়ের আনন্দ-বেদনা ভুলে নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ালেন উর্ধ্বশ্বাসে। ভাগ্য ভালো, সাকলায়েন মুশতাক সত্যিই রান আউট ছিলেন। নইলে মাঠের ওই দর্শকের দখল সরিয়ে আবার খেলা শুরু করতে বারোটা বেজে যেত। সংবাদ সম্মেলনে আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে একজন প্রশ্নটা করলেনও, যদি সাকলায়েনকে থার্ড আম্পায়ার রান আউট না দিত, তাহলে কী করতেন? ‘কী আর করতাম, মাঠে ফিরে যেত হতো আবারও’—বুলবুলের হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল ফিরে যেতে না হওয়ায় তিনি কতটা খুশি!

বাংলাদেশ অধিনায়কের সেই হাসি যেন প্রতীকী হয়ে জানিয়ে দিল, বাংলাদেশের ক্রিকেট আর কোথাও ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই রাজি নয়। এখন শুধু সামনে এগোনোর পালা!

আরও পড়ুন:

আকরাম-বিদ্যুৎ-সুজন গড়েছিলেন জেতার স্কোর
এই জয় পুরো ক্রিকেট কাঠামোকেই বদলে দেবে: বুলবুল

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×