বাংলাদেশ-ভারত চট্টগ্রাম টেস্ট ২০০৭
অবধারিত ড্রয়ের আগে একটু বিনোদন
টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক
উৎপল শুভ্র
১৮ মে ২০২১
আগের চারদিনে খেলা হয়েছে মাত্র ১৮১.১ ওভার, চট্টগ্রাম টেস্টে ফল দেখার স্বপ্নটা তাই বাড়াবাড়িই হতো। তবে সেই অসম্ভব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চেয়েছিল ভারত, বাংলাদেশ দলকে ৪৩ ওভারে ২৫০ রানের লক্ষ্য দিয়ে ফেলেছিল টোপও। তবে বাংলাদেশ কোনো ফাঁদে পা দেয়নি, উইকেটে ২৮ ওভার কাটিয়ে ভারতকে বাধ্য করেছিল ড্র মেনে নিতে।
প্রথম প্রকাশ: ২৩ মে ২০০৭। প্রথম আলো।
ভারত: ৩৮৭/৮ (ডিক্লে.) ও ১০০/৬ (ডিক্লে.); বাংলাদেশ: ২৩৮ ও ১০৪/২; ফল: ড্র
টেস্টের পঞ্চম দিন শেষ বিকেলের উইকেট—এটা নিছক অঙ্কের হিসাব। চট্টগ্রাম টেস্টের আগের চার দিনে মাত্র ১৮১.১ ওভার খেলা হয়েছে বলে জাভেদ ওমর ও শাহরিয়ার নাফীস আসলে ব্যাট করতে নামলেন তৃতীয় দিনের উইকেটে।
উপমহাদেশের উইকেটে বল হাতে ভারতের সর্বকালের সেরা ম্যাচ উইনার প্রচণ্ড জ্বরে মিনিট কয়েক ব্যাটিং করা ছাড়া এই টেস্টে মাঠেই নামতে পারেননি। কাল মাঠে এলেও আম্পায়ারদের কাছ থেকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ বোলিং করার অনুমতি পাননি অনিল কুম্বলে।
এই দুটি ব্যাপার মাথায় রেখেও ৪৩ ওভারে ২৫০ রান করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়াটাকে ‘স্পোর্টিং ডিক্লারেশন’ ভেবে ভারতীয় প্রেসের বড় একটা অংশকে গদগদ হয়ে পড়তে দেখে ভারি আশ্চর্য লাগল। ৪৩ ওভারে ২৫০ রান মানে ওভারপ্রতি ৫.৮১ রান, অস্ট্রেলিয়াও কি পারত?
যে দলে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নামেন, তাদের জন্য হয়তো অসাধ্য কিছু নয়। কিন্তু এটা তো ওয়ানডে নয় যে, বল লেগ স্টাম্পের এক ইঞ্চি বাইরে গেলেই আম্পায়ার ওয়াইড দিয়ে দেবেন, বৃত্তের ভেতর ফিল্ডার রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবে, কোনো বোলার তাঁর জীবনের সেরা বোলিং করলেও তাঁকে দিয়ে ১০ ওভারের বেশি করানো যাবে না। তারপরও রিকি পন্টিংয়ের দল হয়তো চেষ্টা করত। তবে ‘হয়তো’ শব্দটা রাখতে হবে সেই চেষ্টার সম্ভাব্য ফলেও। অস্ট্রেলিয়া হয়তো পারত, হয়তো পারত না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো-টয়তো বলার প্রয়োজন পড়ছে না। এটা বাংলাদেশের সাধ্যের বাইরে। এক দলের কোনো সুযোগই না থাকলে সেই ডিক্লারেশনের আগে ‘স্পোর্টিং’ শব্দটা তাহলে বসে কীভাবে? দুপুর দুটোয় শুরু হওয়া পঞ্চম দিনের খেলায় ১০ ওভার ব্যাটিং করে রাহুল দ্রাবিড়ের ডিক্লারেশন বড়জোর দর্শকদের চূড়ান্ত বিরক্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সাধুবাদ পেতে পারে। আর কিছু নয়।
ক্রিকেট ইতিহাসে ‘স্পোর্টিং ডিক্লারেশন’-এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটির কথা মনে করুন। সেটির সুযোগ নিয়ে ২১৫ রান করে ম্যাচ জিততেও লেগেছিল ৫২.৪ ওভার। ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেন টেস্টে গ্যারি সোবার্সের সেই স্পোর্টিং ডিক্লারেশনের প্রতিক্রিয়াটা একদমই স্পোর্টিং থাকেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে যাওয়ার পর ক্যারিবিয়ানে সোবার্সের কুশপুতুল পর্যন্ত পুড়েছিল। সিরিজ-নির্ধারণী টেস্টে ইংল্যান্ডকে ১৬৫ মিনিটে (তখন ওভারের সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিল না) ২১৫ রানের টার্গেট দিয়ে ৭ উইকেটে হারই শুধু সোবার্সের একমাত্র সমালোচনা ছিল না। নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা দূরের কথা, কাউকে এ কথা আগে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। এমনকি আগের দিনের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যানকেও কিছু বলেননি। এরপর নামা দুজনকেও না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে ৯২ রান করতেই কামাচো-ক্যারু-নার্স-কানহাইরা তাই ৩০ ওভার লাগিয়ে ফেলেন।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে টস জিতে ভারতের ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটাও ভারতীয় ক্রিকেট মহলে একই অভিযোগে অভিযুক্ত। সহ-খেলোয়াড় দূরের কথা, রাহুল দ্রাবিড় নাকি কোচকেও না জানিয়ে ব্যাটিং নিয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। ডিক্লারেশনটা যে তা নয়, সেটি কাল শুরু থেকেই শচীন টেন্ডুলকার ও দীনেশ কার্তিকের চালানো দেখে বোঝা যাচ্ছিল। পরের ব্যাটসম্যানরাও তা-ই করেছেন বলেই ১০ ওভারে ৬৬ রান। এতে সবচেয়ে বড় লাভটা হয়েছে মোহাম্মদ রফিকের। কাল ৫ ওভারে ২০ রানে তাঁর ৩ উইকেট, যার দুটি যেকোনো স্পিনারের মনের মণিকোঠায় রেখে দেওয়ার মতো। শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলীর।
বাংলাদেশের বিপক্ষে আগের তিনটি টেস্টে ভারত যেবার সবচেয়ে কম রানে অলআউট হয়েছিল, সেবারও করেছিল ৪২৯। ৬ উইকেটে ১০০ হয়ে যাওয়ার পর কাল ১৫০ রানের নিচে শেষ হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু ছিল না। সেই ‘লজ্জা’য় ডোবার সম্ভাবনাও ঠেকিয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের ‘স্পোর্টিং ডিক্লারেশন’।
রাহুল দ্রাবিড় নিজে অবশ্য তাঁর ডিক্লারেশনকে স্পোর্টিং বলে মোটেও দাবি করেননি। তাঁর আশা ছিল একটাই, অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ যদি ভুল বুঝে এই অসম্ভব লক্ষ্যকে সম্ভব মনে করে চালিয়ে খেলতে গিয়ে শুরুতেই ৪-৫টি উইকেট হারিয়ে ফেলে, তা হলে কে জানে...। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের ২৮ ওভার পরই টেস্ট ম্যাচের যবনিকাপাতের সময় পর্যন্ত পড়েছে মাত্র দুটি উইকেট। চতুর্থ ওভারে শাহরিয়ার নাফীস লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে কট বিহাইন্ড হওয়ার পর ৭০ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই রাহুল দ্রাবিড়ের স্বপ্নের (যদি আসলেই দেখে থাকেন) সমাধি।
সেই জুটির একজন জাভেদ ওমর। যাঁর অপরাজিত ৫২ রানের ইনিংসের তৃপ্তিটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাঠ ছাড়ার সময় তাঁকে জড়িয়ে ধরে সৌরভ গাঙ্গুলীর অভিনন্দন। টেস্টে ৮২ বলে ৫২-ই যথেষ্ট খুশি হওয়ার মতো স্ট্রাইক রেট। জাভেদ আরেকটি অবিশ্বাস্য কাণ্ডও করে ফেলেছেন কাল। রমেশ পাওয়ারের বলে ছক্কা মেরে দিয়েছেন! ৩৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে জাভেদ ওমরের প্রথম ছক্কা!
দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে জাভেদের সঙ্গী বাংলাদেশ দলে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিজের হাফ সেঞ্চুরির চেয়ে বন্ধুর ৩৭-ও তাই তাঁকে কম আনন্দিত করার কথা নয়। সেই বন্ধুর নাম যে হাবিবুল বাশার! গত কিছুদিন যাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, ব্যাটিং করতে ভুলে গেছেন! একটা সময় বাংলাদেশের মোট টেস্ট রানের ২০ শতাংশেরও বেশি জোগান দেওয়ার অবিশ্বাস্য কীর্তি ছিল হাবিবুলের। এই টেস্টের আগেও বাংলাদেশের মোট টেস্ট-রানের ১৫.৭৪ শতাংশ তাঁর। অথচ সেই হাবিবুলই কাল যখন ব্যাট করতে নামলেন, শুধুই একটি রানের জন্য তাঁর সে কি আকুতি! প্রথম ইনিংসে শূন্য মেরেছেন, দ্বিতীয় ইনিংসেও মারলে টেস্ট ইতিহাসে দুটি ‘পেয়ার’ পাওয়া প্রথম অধিনায়ক হিসেবে রেকর্ডবুকে লেখা হয়ে যেত তাঁর নাম। হাবিবুল বোধ হয় নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছিলেন!
প্রথম বলেই সিঙ্গেল নিয়ে সেই অসহ্য চাপ থেকে মুক্তি। এরপরই যেন আবার ফিরে এলেন আগের হাবিবুল। বলতে পারেন টেস্ট ক্রিকেটের হাবিবুল। স্বচ্ছন্দ, জড়তাহীন, আত্মবিশ্বাসী। ওয়ানডেতে সর্বশেষ ফিফটি করেছেন ১০ ইনিংস আগে, সর্বশেষ টেস্ট ইনিংসটিতেও শুন্য— এসব ভুলে কাল ব্যাট করতে নামার সময় হাবিবুল হয়তো শুধু মনে রাখতে চেয়েছেন আগের দিনের শুন্যর আগে টেস্টে সর্বশেষ যে ৬ বার ব্যাট করতে নেমেছেন, তাতে তাঁর ৬৯, ৭৩, ৭৬ ও ৪৯ রানের ৪টি ইনিংস আছে। ৪৯ বলে ৩৭, এর ওপর ৩১ রানে একটি ‘লাইফ’—এমনিতে এমন কিছু নয়, কিন্তু অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরা চাপের মধ্যে এই ৩৭-ই হাবিবুলের কাছে অন্য রকম হয়ে থাকতে বাধ্য। ‘ব্যাটিংটা তাহলে ভুলে যাননি’—পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার পথে কথাটা শুনে হাবিবুল বাশার হাসলেন। অনেক দিন তাঁর মুখে এই হাসি দেখিনি।
আরও পড়ুন:
প্রথম দিন: ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন টেন্ডুলকার-সৌরভ!
দ্বিতীয় দিন: শচীন-সৌরভকে আরও মিলিয়ে দিল চট্টগ্রাম
চতুর্থ দিন: মাশরাফি সামনে বলেই আড়ালে বৃষ্টি