বাংলাদেশ-ভারত চট্টগ্রাম টেস্ট ২০০৭

ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন টেন্ডুলকার-সৌরভ!

টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক

উৎপল শুভ্র

১৮ মে ২০২১

ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন টেন্ডুলকার-সৌরভ!

প্যাভিলিয়নে ফেরত আসছেন শচীন-সৌরভ। বাংলাদেশের শুরুর উচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছেন এই দুজনই। ছবি: এএফপি

ম্যাচের প্রথম বলেই `ড্রিম ডেলিভারি`তে ওয়াসিম জাফরকে ফিরিয়েছিলেন মাশরাফি। তবে সেই বলটা ভুল বার্তাই দিয়েছিল, নিখাদ ব্যাটিং উইকেটে এরপর পুরো দিনে উইকেট পড়ল আর মাত্র দুটি। ওয়ানডে সিরিজ থেকে `রেস্ট`-এর আবরণে শচীন আর সৌরভকে বাদ দিয়েছিলেন ভারতীয় নির্বাচকরা। সেই জ্বালা দুজনই জুড়ালেন বড় সংগ্রহের ভিত্তি গড়ে।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ মে ২০০৭। প্রথম আলো।

প্রথম দিন শেষে;

ভারত ১ম ইনিংস: ২৯৫/৩

অপরাজিত ১৬৩ রানের পার্টনারশিপটির সময় মধ্য-উইকেট সম্মেলনে দুজনের কী কথা হয়েছে, জানার উপায় নেই। তবে সেই আলোচনায় রেস্ট শব্দটা একবারের জন্য হলেও উচ্চারিত হওয়ার কথা। ওই রেস্ট-এর আবরণেই ওয়ানডে দল থেকে দুজনকে বাদ দিয়েছেন নির্বাচকেরা। পুরো বিশ্ব যখন সেই রেস্ট-এর আসল অর্থ বুঝে ফেলেছে, শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলী কি আর বোঝেননি? বুঝেছেন বলেই তাঁদের কাছে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটির অন্য অর্থ। বুকে আগুন নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছেন দুজনই। সেই আগুনে বাংলাদেশের বোলারদের পুড়ে মরার সব আয়োজনই এখন সম্পন্ন।

চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে শচীন টেন্ডুলকার অপরাজিত ৮০ রানে। ৮২ রানে সৌরভ গাঙ্গুলী। সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখছেন বললে আসলে কিছুই বলা হয় না। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামের মাঝখানের ওই ২২ গজী আয়তক্ষেত্রকে বোলারদের এমনই বধ্যভূমি বানানো হয়েছে যে, এখানে বড় কোনো ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি নয়, ডাবল সেঞ্চুরি না করতে পারলে সেটিকে ব্যর্থতা বলে ভাববেন। যেকোনো উইকেটে যেকোনো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের বোলিং সবচেয়ে বেশি যাঁর মুখ চেয়ে থাকে, সেই মাশরাফি বিন মুর্তজার সংবাদ সম্মেলনে বারবার উচ্চারিত হলো হার্ড, ডিফিকাল্ট শব্দ দুটি। চোখ-মুখ দেখে মনে হলো, এতেও পুরোটা বোঝানো যাচ্ছে বলে তাঁর মনে হচ্ছে না!

এই টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলটির পর যে অনুভূতিটা হয়েছিল, দিনশেষে সেটিকেও সুদূর কোনো অতীতের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল মাশরাফির কাছে। বোলার বল করলেন, আর ব্যাটসম্যান ব্যাট তুলে তা ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হলেনএই বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট অনুসারীদের মন চলে যায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে। বালবিন্ধার সিং সান্ধুর ইনসুইঙ্গার না বুঝে ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হচ্ছেন গর্ডন গ্রিনিজ। সেই দৃশ্যেরই পুনরাভিনয় হলো কাল চট্টগ্রামে। মাশরাফির প্রথম বলটি ব্যাট তুলে ছেড়ে দিলেন ওয়াসিম জাফর। অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে পড়া সেই বল একটু ভেতরে ঢুকে নাড়িয়ে দিল অফ স্টাম্প। স্বপ্নের সূচনা বোধ হয় একেই বলে!

ব্যাট তুলে আউট ওয়াসিম জাফর। ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের ৪৫ ম্যাচের টেস্ট ইতিহাসে এমন সূচনা এবারই প্রথম। তাতে সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা হান্নান সরকারের! প্রায় তিন বছর বাংলাদেশ দলের বাইরে থাকা ওপেনারের সঙ্গে মাশরাফির টেস্টের প্রথম বলে উইকেট পাওয়ার কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে। ১৮৩২তম টেস্ট ম্যাচে প্রথম বলে উইকেট পড়ার মাত্র ২৫তম ঘটনা এটি। সর্বশেষ তিন বার তাঁর শিকার হান্নান সরকার। টেস্টের প্রথম বলে সবচেয়ে বেশিবার আউট হওয়ার বিশ্বরেকর্ডটিতে তিনি সুনীল গাভাস্কারের অংশীদার। রেকর্ডবইয়ের ওই পাতাটি এখন আর হান্নান সরকারকে দিয়ে শেষ নয়। সেখানে এখন ওয়াসিম জাফর। হান্নান তো একটু খুশি হতেই পারেন।

প্রথম বলটির পর কাল সারা দিনে বাংলাদেশের খুশি হওয়ার মতো ঘটনা আর দুটিই। দুটিই দ্বিতীয় সেশনে। ১২ বলের মধ্যে দ্বিতীয় উইকেটে ১২৪ রানের জুটি গড়ে স্বপ্নের সূচনার আনন্দ মুছে দেওয়া দীনেশ কার্তিক ও রাহুল দ্রাবিড় আউট। লাঞ্চের পর মাশরাফির দুর্দান্ত স্পেলটির (৪-৩-৩-১) শিকার কার্তিক। মিড অফে যাঁকে ক্যাচ দিলেন, অসুস্থ হাবিবুল বাশারের বদলে সেই আশরাফুলই তখন প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্ব করছেন বাংলাদেশের। মাশরাফি উইকেট পাওয়ার পরও তাঁকে সরিয়ে শাহাদাতকে আক্রমণে আনার সিদ্ধান্ত একটু চমকে দেওয়ার মতোই ছিল। শাহাদাত প্রথম বলেই বাড়তি বাউন্সে দ্রাবিড়কে কট বিহাইন্ড করে উল্টো চমক দিলেন। বৃষ্টির কারণে ৫৫ মিনিট দেরিতে শুরু হওয়া দ্বিতীয় সেশনের পুরোটাই অধিনায়কত্ব করেছেন আশরাফুল। ওটুকুর মধ্যে দেখা গেছে তাঁর ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের ঝলক।

আগেই বলেছি, এটা এমন উইকেট বড় ব্যাটসম্যানরা যাতে সেঞ্চুরি নয়, ডাবল সেঞ্চুরির কথা ভাববেন। ৬১ রানে আউট হয়ে গিয়ে দ্রাবিড়ের তাই মন খারাপ করাটাই স্বাভাবিক। তবে ওই ৬১ রানই দারুণ দুটি অর্জনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তাঁর নাম। শূন্য রানে প্রথম উইকেট পড়ার পর নেমে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপের অংশ হলেন চতুর্থবারের মতো। আর কারও চারবার এই কীর্তি নেই। বডিলাইন সিরিজের অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুলের ছিল তিন বার।

ওই ৬১টি টেস্ট ক্রিকেটে দ্রাবিড়ের ৭০তম পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস (২৩টি সেঞ্চুরি ও ৪৭টি হাফ সেঞ্চুরি)। এত দিন শুধু সুনীল গাভাস্কার (৩৪+৪৫) ও শচীন টেন্ডুলকারেরই (৩৫+৪৪) ছিল এই কীর্তি।

টেন্ডুলকারের ৪৪তম হাফ সেঞ্চুরিটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আম্পায়ার বিল ডকট্রোভের অবদান দেখতেই পারেন মোহাম্মদ রফিক। তাঁর যে আবেদনটিতে ডকট্রোভ সাড়া দেননি, এলবিডব্লিউর ক্ষেত্রে টিভি রিপ্লেকে সামান্যতম নির্ভরযোগ্য ভাবলেও সেটিকে আউট ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। টেন্ডুলকার তখন ৩৭, ভারত ১৮৩।

সৌরভকেও হাফ সেঞ্চুরির আগে ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছিল। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ থেকেও স্টাম্পে বল লাগানোর ওই ব্যর্থতা আজ আরও কতক্ষণ রাজিন সালেহকে পুড়িয়ে মারে কে জানে! বাংলাদেশের বিপক্ষে সৌরভের আগের ৩টি টেস্ট ইনিংসের ইতিহাস অবশ্য রাজিনকে একটু আশা জোগাতে পারে। ৮৪, ৭১, ৮৮ রানের পর ৮২... সৌরভের তো এবার থামা উচিত। কিন্তু এই টেস্টের আগেই যে জানিয়ে দিয়েছেন, ৬০-৭০কে সেঞ্চুরি বানানোর পণ করেই এবার মাঠে নামছেন তিনি।আরও একটি রান নিতে ছুটছেন শচীন-সৌরভ। ছবি: এএফপি

শুধু ভাষার নৈকট্য নয়, সৌরভের কাছে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে থাকে এখানেই টেস্ট অধিনায়কত্বে তাঁর অভিষেক বলে। শচীন টেন্ডুলকারেরও বাংলাদেশকে মনে না রেখে উপায় নেই। টেস্ট-সর্বোচ্চ ২৪৮ রানের ইনিংসটি যে বাংলাদেশের বিপক্ষেই। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফিল্ডারদের অশেষ আনুকূল্যধন্য সেই অপরাজিত ২৪৮ বাদ দিলে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেন্ডুলকারের রেকর্ড কিন্তু বিস্ময়কর রকম বিবর্ণ। বাকি দুটি টেস্ট ইনিংস ১৮ ও ৩৬ রানের। ৯টি ওয়ানডে ইনিংসে একটিও সেঞ্চুরি নেই, হাফ সেঞ্চুরিও মাত্র দুটি।

সমস্যা হলো, শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলী কারও জন্যই এই টেস্টে মূল প্রতিপক্ষের নাম বাংলাদেশ নয়। তাঁদের লড়াইটা আরও অনেক বড়। নির্বাচক, বোর্ড... প্রতিপক্ষ হিসেবে এর পর যদি আসে বাংলাদেশের নাম। শচীন-সৌরভকে রেস্ট দিয়েছেন বলে বাংলাদেশের না দিলীপ ভেংসরকারকে অভিসম্পাত দিতে হয়!

(সংযোজন: ওয়াসিম জাফরের পর টেস্টের প্রথম বলে আউট হওয়ার রেকর্ডে যোগ হয়েছেন আরও আটজন। সর্বশেষ আফগানিস্তানের আবদুল মালিক।)

আরও পড়ুন:

দ্বিতীয় দিন: শচীন-সৌরভকে আরও মিলিয়ে দিল চট্টগ্রাম

চতুর্থ দিন: মাশরাফি সামনে বলেই আড়ালে বৃষ্টি

পঞ্চম দিন: অবধারিত ড্রয়ের আগে একটু বিনোদন

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×