বাংলাদেশ-ভারত চট্টগ্রাম টেস্ট ২০০৭
মাশরাফি-শাহাদাত সামনে বলেই আড়ালে বৃষ্টি
টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক
উৎপল শুভ্র
১৮ মে ২০২১
ভারতের প্রথম ইনিংসের সাত উইকেট তুলে নিয়েছিলেন দুজনে মিলে, পরে ব্যাট হাতেও মাশরাফি-শাহাদাতকে নামতে হলো উদ্ধারকারীর ভূমিকায়। নবম উইকেটে বাংলাদেশের সে সময়ের রেকর্ড জুটিতেই ফলো-অন শঙ্কা এড়িয়েছিল বাংলাদেশ। সম্ভবত টেস্টটাও বেঁচে গিয়েছিল এই জুটিতেই, আর তাঁদের সাহায্য করার জন্য বৃষ্টি তো ছিলই।
প্রথম প্রকাশ: ২২ মে ২০০৭। প্রথম আলো।
চতুর্থ দিন শেষে
ভারত: ৩৮৭/৮ ও ৪৪/২ বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ২৩৮
ভারত শচীন-সৌরভের সেঞ্চুরির জন্য মনে রাখতে চাইলে রাখুক, বাংলাদেশের কাছে চট্টগ্রাম টেস্টের একটাই নাম। মাশরাফি-শাহাদাত শো। বোলিংয়ে তাঁরা নায়ক, ব্যাটিংয়েও তাঁরা! ভারতের প্রথম ইনিংসে দুজন মিলে ৭ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে শাহাদাতের আরও দুটি। ব্যাট হাতেও বাংলাদেশের উদ্ধারকর্তা নতুন বলের এই জুটি।
শাহাদাত যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন, স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৮ উইকেটে ১৪৯। ফলো অনের লজ্জা থেকে বাঁচতে তখনো চাই ৩৯ রান। টেন্ডুলকারের গুগলিতে শাহাদাত যখন বোল্ড হয়ে ফিরছেন, প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ রান যোগ হয়ে গেছে স্কোরবোর্ডে। দুই পেসারের ৭৭ রানের জুটি নবম উইকেটে বাংলাদেশের নতুন রেকর্ড।
২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে শাহাদাত প্রথম বাংলাদেশ দলে। মাশরাফি বিন মুর্তজাও সেই প্রথম ভালো করে চিনলেন তাঁকে। কেমন সে চেনা? লর্ডসে শাহাদাতের টেস্ট-অভিষেকের আগের দিন মাশরাফি বললেন, ‘আমি আর কী পাগলা! আমার চেয়ে বড় পাগলা এসে গেছে!’ যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর অস্থিরতার কারণে টিমমেটদের কাছ থেকে ‘পাগলা’ নিকনেম উপহার পেয়েছিলেন মাশরাফি, বয়স-বিয়ে-টিয়ে মিলিয়ে এর অনেকটাই এখন উধাও। বাংলাদেশ দল অবশ্য সেই শূন্যতা একদমই অনুভব করতে পারছে না। শাহাদাত যে তাঁর নিষ্পাপ সারল্য, কথাবার্তা, কাণ্ডকীর্তি দিয়ে ‘বড় পাগলা’ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন! বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় বিনোদনের নাম শাহাদাত হোসেন। নিজে অনুপস্থিত, এমন আড্ডারও বড় একটা অংশজুড়ে থাকে শাহাদাতের সর্বশেষ কোনো ‘কীর্তি’।
এর সবই হাস্যরস উৎপাদনকারী। তবে ৩১ রানের ইনিংসটি খেলার পর ড্রেসিংরুমে ফিরে শাহাদাত যদি নিজেকে অলরাউন্ডার বলে দাবি করে থাকেন, সেটি নিয়ে খুব বেশি হাস্যরস করা ঠিক হবে না। শাহাদাত যে মনে করিয়ে দেবেন, নবম উইকেটের মতো দশম উইকেটেও বাংলাদেশের পক্ষে রেকর্ড পার্টনারশিপটির অংশ তিনি। সেটি আবার বাংলাদেশের ঠিক আগের টেস্ট ইনিংসটিতেই এবং এই মাঠেই (গত বছর এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে ৬৯)।
শাহাদাতকে অলরাউন্ডার বলাটা নিছক রসিকতা। টেস্ট-সর্বোচ্চ ৩১ রান নিয়ে কেউ নিজেকে অলরাউন্ডার বলে দাবি করতে পারে না। তবে সেটি ৭৯ হলে বোধ হয় পারে। কদিন আগে ওয়ানডে সিরিজে পরপর চার বলে ছক্কা মারার পর কাল দমবন্ধ করা চাপের মধ্যে মাশরাফির ৯২ বলে ৭৯ ভারতীয় সাংবাদিকদের অনেককে কপিল দেবের কথা মনে করিয়ে দিল। এমন ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে তাঁকে যে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলো, ব্যাটসম্যানদের ওপর রাগ হয়নি? মাশরাফি হাসেন, ‘এভাবে দেখলে তো হবে না। একটা দিন ওদের খারাপ গেছে। আরেক দিন হয়তো আমার যাবে।’ সমস্যা একটাই, মাশরাফি বিন মুর্তজা বাংলাদেশ দলের জন্য এমনই এক ইচ্ছাপূরণের মাধ্যম হয়ে উঠেছেন যে, তাঁর ‘খারাপ দিন’-এ কী হবে, তা ভাবতেও ভয় করে।
যেমন ভাবতে ভয় করছে, প্রচণ্ড জ্বর অনিল কুম্বলেকে ড্রেসিংরুম থেকে হোটেলে ফেরত পাঠিয়ে না দিলে কী হতো! রাহুল দ্রাবিড় ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে একটা ‘ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পের’ সঙ্গে জড়িত কুম্বলে। কুম্বলেবিহীন ভারতীয় বোলিংয়ের যে দীনহীন চেহারা, তাতে ভারতীয় ক্রিকেটের এখন ‘কুম্বলে সংরক্ষণ প্রকল্প’ হাতে নেওয়া উচিত। দেশের বাইরে ভারতের টেস্ট জয় আর হ্যালির ধূমকেতু প্রায় একই বিরতিতে দেখা দেয়, কুম্বলে চলে গেলে দেশেই বা ভারত টেস্ট জিতবে কীভাবে?
থাক, এটা ভারতের সমস্যা। ভারত ভাবুক। তা ছাড়া কুম্বলেবিহীন বোলিং আক্রমণেই টপাটপ ঝরে পড়ে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা স্কোরবোর্ডকে ৮ উইকেটে ১৪৯ বানিয়ে দেওয়ার দিনে আলোচনাটা খুব একটা শোভনও নয়। জাভেদ ওমরের অবশ্য এই আলোচনা করার অধিকার আছে। তাঁর উইকেটটি যে কোনো বোলার নয়, নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আম্পায়ার বিলি ডকট্রোভ। ওভাল-কেলেঙ্কারিতে ড্যারেল হেয়ারের সঙ্গী লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ করা বলেও এলবিডব্লু দিয়ে দিয়েছেন জাভেদকে।
আরেক আম্পায়ার ড্যারেল হার্পারকেও তো কিছু করতে হয়! এই অস্ট্রেলিয়ান তাই ব্যাটে বল লাগার পরও খালেদ মাসুদকে এলবিডব্লিউ দিয়ে দিলেন! তাঁদের বাংলাদেশবিরোধী বলে ভাবার কোনো কারণ নেই, মানবীয় ভুলই। সমস্যা হলো, এই ‘মানবীয় ভুলগুলো’ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দুর্বলতর দলের ঘাড়েই পড়ে। প্রমাণ তো এই টেস্টেই আছে। এই দুই আম্পায়ারই তো শচীন টেন্ডুলকারের বিপক্ষে ৩৭ ও ৮০ রানে দু-দুটি নিশ্চিত এলবিডব্লিউ দেননি। গত বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বগুড়া টেস্টে ভারতীয় আম্পায়ার হরিহরন বাংলাদেশের বিপক্ষে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর ডেভ হোয়াটমোর রীতি ভেঙে সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। আম্পায়ারদের ভুলগুলো কেন ‘দুর্বলতর’ দলের বিপক্ষেই বেশি হয়, এ নিয়ে ভাবতে বলেছিলেন আইসিসিকেও।
আপাতত বাংলাদেশ দলের জন্য এর চেয়ে বড় ভাবনা হওয়া উচিত টপ অর্ডার ব্যাটিং। শাহরিয়ার নাফীসের ব্যাট ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছে। রাজিন ও সাকিবও যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন, ব্যাটিংটাকে এমন কঠিন কিছু মনে হয়নি। তবে তিনজনই সেট হওয়ার কঠিন কাজটি করে সেটিকে মূল্যহীন করে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী। ২৮ মিনিট উইকেটে থেকে ২০ বল খেলাটাকে যদি সেট হওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন, তাহলে মোহাম্মদ আশরাফুলকেও রাখতে পারেন তাঁদের দলে।
হাবিবুল বাশারকে অন্তত এই ‘অপরাধে’ কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না! বিশ্বকাপ-পারফরম্যান্সে চারদিকের সমালোচনায় অতলস্পর্শী চাপে পড়ে যাওয়া অধিনায়ক যে দ্বিতীয় বলেই আউট! টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সন্দেহাতীত সেরা ব্যাটসম্যান ইনিংসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে নড়বড়ে ব্যাটসম্যানও। হাবিবুলের ইনিংসের প্রথম মিনিট পনেরো পুরো ড্রেসিংরুমই টেনশনে থাকে। কাল অবশ্য বেশিক্ষণ সেই টেনশনে ভোগাননি। চাপ থেকে বেরোনোর উপায় মানলেন দ্বিতীয় বলেই ‘যা আছে কপালে’ বলে চালিয়ে দেওয়াকে। স্লিপে ক্যাচ! টেস্ট ক্যারিয়ারে সপ্তম ‘ডাক’।
অধিনায়ক হাবিবুলের কাছে ক্রিকেটটা এখন যেমন দুঃসহ চাপ বলে মনে হচ্ছে, ক্যাপ্টেনসি ক্যারিয়ারে আর একবারই মনে হয়েছিল এমন। যখন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক টেস্টেই ‘পেয়ার’ পেয়েছিলেন। ক্রিকেট ইতিহাসে অধিনায়কের ‘পেয়ার’ পাওয়ার ঘটনা মাত্র ১৯টি। হাবিবুল ছাড়া ‘পেয়ার’ দিয়ে অধিনায়কত্বে অভিষেক শুধু মার্ক টেলর আর রশিদ লতিফের। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেলে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দু'বার ‘পেয়ার’ পাওয়ার চোখরাঙানিও উইকেটে যাওয়ার পথে হাবিবুলের সঙ্গী হবে।
মহা আলোচিত একটি ‘পেয়ার’ অবশ্য এরই মধ্যে পেয়ে গেছে চট্টগ্রাম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে প্রথম বলে আউট হয়েছিলেন ওয়াসিম জাফর। দ্বিতীয় ইনিংসেও শূন্য, এবার তৃতীয় বলে। দু দিনই মাঠে বসে এই ঘটনা দেখলেন তাঁর স্ত্রী। ভবিষ্যতে তাঁর হার্বার্ট আয়রনমঙ্গারের স্ত্রী হয়ে যাওয়াটা একদমই অস্বাভাবিক হবে না। অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতি স্পিনারের ফার্স্ট ক্লাস ইনিংসের এক-চতুর্থাংশই ছিল শূন্য। একবার এক টেস্ট ম্যাচে তাঁর স্ত্রী ড্রেসিংরুমে ফোন করে জানলেন, আয়রনমঙ্গার ব্যাট করতে নেমেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি লাইনে থাকছি। ও এখনই ফিরবে।’
দ্বিতীয় ইনিংসে হাবিবুলের ব্যাট করার সুযোগ পাওয়া নিয়ে সংশয়ের কথা লিখেছি। কারণ এই টেস্ট ম্যাচের পঞ্চম দিনে আদৌ খেলা হওয়া নিয়েই এখন সংশয়। কাল খেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পর শুরু প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া মাঠ সামনে রেখেই লেখা হচ্ছে এই ম্যাচ রিপোর্ট। অনাগত ভবিষ্যৎ শচীন-সৌরভের সেঞ্চুরি, মাশরাফি-শাহাদাতের অলরাউন্ড কীর্তিকে ছাপিয়ে বৃষ্টিটাকেই না শুধু মনে রাখে!
আরও পড়ুন:
প্রথম দিন: ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছেন টেন্ডুলকার-সৌরভ!
দ্বিতীয় দিন: শচীন-সৌরভকে আরও মিলিয়ে দিল চট্টগ্রাম
পঞ্চম দিন: অবধারিত ড্রয়ের আগে একটু বিনোদন