প্রিয় এরিকসেন, আমি যে জীবন লিখতে জানি না...
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
১৭ জুন ২০২১
এরিকসেন আমার কাছে কেবলই আরেকজন ফুটবলার ছিলেন, কিন্তু সেদিন ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচের ৪২:১০ মিনিটের পর থেকে এরিকসেন `জীবন` হয়ে গেলেন। এরই মধ্যে কোথায় যেন পড়লাম, এরিকসেন আর ফুটবল খেলতে পারবেন না। যদি তা-ই হয়, তবে এই জন্মে আর তাঁকে নিয়ে লেখাও হলো না। খেলাধুলা নিয়ে দুয়েক লাইন লিখে-টিখে শুভ্রদার নজরে পড়েছি, কিন্তু `কী করে জীবন লিখতে হয়`--সেই কৌশলটা তো অন্তর্যামী কাউকে শেখান না।
'এরিকসেনকে নিয়ে লেখো।'
একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বক্তব্য রেখে শুভ্রদা কেবলই উঠেছেন। ইমরান ভাইয়ের কী একটা থিসিস যেন জমা দিতে হবে দিন দুয়েকের মধ্যে, তাঁকেও তাই তেমন করে পাওয়া যাবে না পরের দিনগুলোতে। পেজ কীভাবে চলবে, তারই নির্দেশনা পেতে ফোনে ধরেছিলাম শুভ্রদাকে। ঘটনাটা ঘটল তখনই, টিভির পর্দায় চোখ ছিল দেখে বলতে পারি, ঠিক চোখের সামনে। দাদা কথাটা বললেন এরপরই, 'তাহলে এরিকসেনকে নিয়েই লেখো।'
ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনকে আমি চিনতাম। শুনতে হাস্যকর শোনাবে, আমার ফুটবল-জ্ঞান নিয়ে প্রশ্নও হয়তো জাগবে, তবুও সত্য স্বীকারে দ্বিধা করতে নেই জেনেই বলছি, এরিকসেনকে আমি চিনেছিলাম গেম খেলতে গিয়ে। নতুন নতুন স্মার্টফোন হাতে পেয়ে 'ড্রিম লিগ সকার' বলে একটা গেম নামিয়েছিলাম প্লে স্টোর থেকে। ওই গেমেই আমার গড়া ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন এই এরিকসেনই।
গেমে তাঁর কল্যাণে ভুরি ভুরি গোল পেলেও বাস্তবের এরিকসেন কেমন, তা জানার আগ্রহ হয়নি তখন। যা হয়েছিল এর পরের বছর, বার্সেলোনার সৌজন্যে। দলবদলের মৌসুমে নানা খেলোয়াড়কে ঘিরে গুজব রটাটাই রীতি। সেই রীতি মেনে ২০১৭-১৮ মৌসুম শুরু হওয়ার আগে শুনি, এরিকসেনের পিছু ধাওয়া করছে বার্তোমেউ-বোর্ড, এর আগের মৌসুমেই টটেনহামের মৌসুম-সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন তিনি। গুগল ঘেঁটে আরও যে সব তথ্য পাই, তা মোটামুটি এমন: ফুটবল থেকে নাম্বার টেনদের হারিয়ে যাওয়ার যুগে তিনি এক ব্যতিক্রম। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের দায়িত্বটা তিনি এত সুচারুভাবে পালন করেন যে, 'মাইকেল লাউড্রপের উত্তরসূরি পেলো ফুটবল' বলেও শোর উঠেছে। আয়াক্সকে টানা তিন মৌসুম লিগ জিতিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল টটেনহ্যাম হটস্পারে, সেখানে প্রথম মৌসুমেই জিতেছিলেন ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার, জিতেছিলেন গুজব রটা ২০১৬-১৭ মৌসুমেও। এমন প্লেয়ার বার্সেলোনার জার্সিটা গায়ে চাপাবেন ভেবে যে শিহরিত হয়েছিলাম খুব, অস্বীকার করব না।
তবে আমার রোমাঞ্চই সার৷ 'এরিকসেনের বার্সা-আগমন' ঘিরে আরও বার দুয়েক গুজব রটলেও তা সত্যি হয়নি কখনোই। ২০১৯-২০ মৌসুমের মাঝামাঝি টটেনহাম ছেড়েছেন, তবে বার্সেলোনা নয়, গেছেন ইন্টার মিলানে। সেখানে গিয়ে স্কুডেটো জিতলেন দ্বিতীয় মৌসুমেই। এর আগে রঙ ছড়িয়েছিলেন টটেনহ্যামের জার্সিতেও। টটেনহ্যামকে তৃতীয় করা ২০১৭-১৮ মৌসুমে মাঠে ছিলেন ৩২২৬ মিনিট, করেছিলেন ১০ গোল আর ১১ অ্যাসিস্ট। জায়গা পেয়েছিলেন সেবারের প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা একাদশেও। ডেভিড বেকহামের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে প্রিমিয়ার লিগের টানা চার মৌসুমে ১০টি করে গোলে সহায়তার রেকর্ডও গড়েছিলেন।
তবে এ সমস্ত অঙ্কের বুলি গুবলেট পাকিয়ে গেল ১২ জুন রাতে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচের ৪২:১০ মিনিটে। ক্যামেরা ক্রু তাঁকে ক্লোজ-আপে ধরেছিলেন এর আগের মুহূর্তটাতেই, পেনাল্টি বক্স থেকে টাচলাইনের দিকে হালকা দৌড়ে আসতে দেখছিলাম তাঁকে। ইয়াওকিম মেহলের থ্রো-টা তাঁর গায়েই লাগল, তবে বল ঠেলে দেবার বদলে শরীরটাকেই যেন ঠেলে দিলেন মাটিতে। যেন স্লো-মোশনে এগোনো কোনো ভিডিওর মতো সবুজ ঘাসে লুটিয়ে পড়লেন এরিকসেন।
টুকটাক ফুটবল দেখার সুবাদে এমন আচমকা বসে কিংবা শুয়ে পড়ার এই মুহূর্তটা আমার চেনা খুব। কিছু হলেই শুয়ে যান বলে নেইমারকে তো গালমন্দও করলাম কত! সেদিনও কি এমন কিছুই ভেবেছিলাম প্রথমে? যদি ভেবেও থাকি, তো ভুলটা ভাঙতে এক লহমার বেশি লাগেনি। মাঠে পড়ে গেলে গগণবিদারী চিৎকারে সারা মাঠ মাথায় তোলাটাই নিয়ম, কিন্তু এ কি, এরিকসেনের মুখ থেকে সেদিন টুঁ শব্দটিও তো বেরোয়নি!
মাঝের এই ক'দিনে পরের মুহূর্তগুলো এক শবারের কম দেখিনি। তবে মাথায় গেঁথে আছে চক্রাকারে চালিয়ে দেওয়া কিছু মুহূর্তের ছবি। অ্যান্থনি টেলর বাঁশির নামে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজালেন যেন; সঙ্গে সঙ্গে মাঠের ওই দূর প্রান্তে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে একেকজনকে; বড়ি-বদ্যি নিয়ে ছুটে এলো ডেনমার্কের চিকিৎসক দল; ক্ষণিক বাদেই দেখলাম মানব-বৃত্ত গড়ে উঠল একটা; যাঁরা গড়েছেন, তাঁদের দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে দুর্বোধ্য এক বার্তা; যে বার্তা এর আগে গড়িয়েছিল অজি খেলোয়াড়দের চোখ বেয়ে। যেবার শেন অ্যাবটের বাউন্সারে পরাস্ত হওয়ার মূল্য ফিল হিউজ চুকিয়েছিলেন জীবন দিয়ে।
ফুটবল মাঠে অধিনায়কের বাহুবন্ধনী জিনিসটা ঠিক কোন কাজে আসে, জানা ছিল না আমার। ফুটবলে তো জানি, খেলোয়াড়েরা সব ম্যানেজারের পুতুল। সেদিন সাইমন কায়ের আমাকে জানালেন নেতার সংজ্ঞা। এরিকসেন যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, বাহুতে সবুজ ফিতা বাঁধা একজনকে দৌড়ে আসতে দেখেছিলাম আমি। গণমাধ্যম সূত্রে পরে জেনেছি, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাৎক্ষণিক ভয়টা থাকে জিহ্বা গিলে ফেলার। এরিকসেনের যে তা হয়নি, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কায়েরই নিশ্চিত করেছিলেন সেটা। ওই উদভ্রান্ত হওয়া সময়টাতেও সতীর্থদের সংগঠিত করা, এরিকসেনকে আড়াল করা মানব-বৃত্ত গড়ার বুদ্ধি বেরিয়েছিল তাঁরই মাথা থেকে।
করোনা-ভীতি কাটিয়ে দর্শকরা আস্তে-ধীরে মাঠে ফিরছেন এই ইউরো দিয়েই। সেদিন জানা হলো মাঠে দর্শক-উপস্থিতির মানেটাও। এরিকসেনকে সঙ্গে করে মাঠ ছেড়ে খেলোয়াড়েরা উঠে গেলেও পার্কেন স্টেডিয়াম ছাড়েননি দর্শকেরা। টুইটারে একটা ভিডিও ভাইরাল হলো খুব, যেখানে দেখা গেল, ফিনিশ সমর্থকেরা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, 'ক্রিস্টিয়ান', ড্যানিশ সমর্থকেরা এর চেয়েও উঁচু গলায় জবাব দিচ্ছেন, 'এরিকসেন'। বিল শ্যাঙ্কলি আরও বেশি করে সত্যি হয়ে উঠলেন ওই মুহূর্তটায়। ওই যে তিনি বলেছিলেন, ফুটবল জন্ম-মৃত্যুর কোনো ব্যাপার হতেই পারে না, ফুটবলটা এর চেয়েও বেশি কিছু--কথাটা বলেছিলেন সম্ভবত এমন কোনো মুহূর্তের সাক্ষী হয়েই।
এরিকসেনকে ঘিরে শঙ্কাটা কেটে গিয়েছিল এর আগেই। ফ্রিডম্যান ভোগেল তাঁর কৃতকর্মের ফলস্বরূপ স্বর্গে না নরকে যাবেন, তা বিধাতাই জানেন; তবে কোটি কৌতূহলী মানুষ সে মুহূর্তে খুঁজে ফিরছেন যে প্রশ্নের উত্তর, সেই অমূল্য উত্তর যিনি অবমুক্ত করে দিতে পারেন বিনা মূল্যে, তাঁকে দেবদূতের নিচে কিছু ভাবাটা মহাপাতকের কাজই হবে। এরিকসেনকে ঘিরে রাখা ড্যানিশ খেলোয়াড়দের বলয়ের ফাঁক দিয়ে তিনি যে ছবিটা তুলেছিলেন, তা-ই তো জানিয়েছিল এরিকসেন বেঁচে আছেন, অথচ ইনস্টাগ্রামে তিনি লিখলেন, '...প্রাণ ফেরানো এবং উৎকণ্ঠার অবসান ঘটানো এই মুহূর্তটার ছবি আমি তাবৎ বিশ্বের সম্পাদকমণ্ডলীর জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম।'
ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচটা শেষ হয়েছিল সেদিনই। টিভি-সূচির সঙ্গে সংঘাত বেঁধে যাবে বলে ম্যাচটা শেষ করতে হবে পরবর্তী দিনের খেলা শুরুর আগেই--উয়েফার এমন চাপাচাপিতে মাঠে নামতে রাজি হয়েছিলেন দু'পক্ষের ফুটবলাররা। এ দেশ-ও দেশ ঘুরে প্রাক মৌসুম, ৩৮ ম্যাচের লম্বা লিগ, মধ্যে মধ্যে লিগ কাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ কিংবা ইউরোপা লিগের ম্যাচ, সঙ্গে যোগ করুন জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ, আর উয়েফা তো বছর দুই হলো মাঠে নামিয়েছে নেশনস লিগ নামের প্রহসন, অর্থের ধান্দায় উয়েফা খেলোয়াড়দের যন্ত্রই ভাবতে শুরু করেছে কি না, তোলা যেত এমন প্রশ্নও।
অথচ, তাঁরাও যে রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, আবেগ-অনুভূতির উথাল-পাতাল ছুঁয়ে যায় তাঁদেরও--এর প্রমাণ তো মিলতে শুরু করেছিল ওই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই। বুকে পাথর চেপে মাঠে নেমেছিলেন এরিকসেনের সতীর্থরা, কিন্তু মনটা যে পড়ে আছে তাঁর কাছেই, তা ধরা পড়েছিল খেলাতেও। ঘণ্টাখানেক আগেই যিনি দেখিয়েছিলেন ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার নমুনা, সেই সাইমন কায়েরকে দ্বিতীয়ার্ধে তুলে নিতে বাধ্যই হন কোচ। ডেনমার্ক দল-সংশ্লিষ্ট একজনের বয়ানে আমরা জানতে পারি, ম্যাচের পর মাকে ফোন করে কায়ের বলেছিলেন, তাঁর পা সর্বশক্তি দিয়ে টেনেও তিনি এগোতে পারছিলেন না। ক্যাসপার স্মাইকেলও গোলটা ঠেকাতে পারেননি , অন্য সময় হয়তো আটকেই দিতেন হেডটা; পেনাল্টি থেকে ডেনমার্ককে সমতায় ফেরাতে পারেননি হজবার্গও। ধারাভাষ্যকার তো আগেই বলে দিয়েছিলেন কারণটা, 'জার্সির পেছনে ২৩ থাকলেও মনে তো ওর ১০ আছে'। এমন বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে শটে জোর পাওয়া যায়!
এমন ফুটবল মহোৎসবে শামিল হওয়ার অভিজ্ঞতা ফিনল্যান্ডের জন্য এবারই প্রথম, ম্যাচের ৫৯ মিনিটে গোল করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন জোয়েল পোহজানপালো, অথচ বাঁধভাঙা উদযাপনটাই সেদিন হলো না। বদলে হলো গোল করেই ক্যামেরার দিকে ছুটে আসা লুকাকুর 'ক্রিস, আমি তোমাকে ভালোবাসি' উদযাপন, গোল উৎসর্গ করলেন সন হিউন-মিং, আশরাফ হাকিমিও। বেলজিয়ামের খেলোয়াড়েরা এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ডেনমার্কের বিপক্ষে পরের ম্যাচে দশম মিনিটে বল খেলার বাইরে পাঠিয়ে পুরো মিনিটটাই এরিকসেনকে উৎসর্গ করবেন তাঁরা।
এরিকসেন আমার কাছে কেবলই আরেকজন ফুটবলার ছিলেন, কিন্তু সেদিন ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচের ৪২:১০ মিনিটের পর থেকে এরিকসেন 'জীবন' হয়ে গেলেন।
এরই মধ্যে কোথায় যেন পড়লাম, এরিকসেন আর ফুটবল খেলতে পারবেন না। যদি তা-ই হয়, তবে এই জন্মে আর তাঁকে নিয়ে লেখাও হলো না। খেলাধুলা নিয়ে দুয়েক লাইন লিখে-টিখে শুভ্রদার নজরে পড়েছি, কিন্তু 'কী করে জীবন লিখতে হয়'--সেই কৌশলটা তো অন্তর্যামী কাউকে শেখান না।
আরও পড়ুন: যেভাবে এরিকসেন বেঁচে গেলেন...