যেভাবে এরিকসেন বেঁচে গেলেন...

উৎপলশুভ্রডটকম

১৬ জুন ২০২১

যেভাবে এরিকসেন বেঁচে গেলেন...

প্রথমার্ধের অন্তিম মুহূর্ত তখন, থ্রো-ইন রিসিভ করতে টাচলাইনের দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন, হঠাৎই পড়ে গেলেন মাটিতে। ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের এই ছবিটা চোখে ভাসে এখনো। জীবন-মৃত্যুর ওই সন্ধিক্ষণ থেকে এরিকসেন বেরিয়ে এসেছেন এরই মধ্যে। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে এরিকসেনকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা গেল, এরপর কীভাবে আবার ম্যাচ শুরু হলো, উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য সেই গল্প।

ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের সেই মর্মস্পর্শী ঘটনার প্রতিটা মুহূর্ত তো টিভিতেই দেখেছেন। দুঃসহ মুহূর্তগুলো কাটিয়ে (আসলেই কি কেটেছে?) স্বাভাবিক খেলা আবার শুরু হয়ে শেষ হয়ে যেতে দেখেছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে পরের দিন ঘটনার টুকিটাকি বিভিন্নভাবে অবগতও হয়তো হয়েছেন। এই লেখায় ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে আনব তাদের ভাষাতেই।   

শুরুটা করা যাক ডেনমার্ক দলের চিকিৎসক মর্টেন বোজেনকে দিয়েই, যিনি ঘটনাচক্রে ড্যানিশ ক্লাস এফসি কোপেনহেগেনেও একই দায়িত্ব পালন করেন। মর্টেনের ভাষায়, 'আমি যখন প্রথম ওর কাছে পৌঁছালাম, তখন ও উপুড় হয়ে ছিল এবং হালকা শ্বাস নিচ্ছিল। আমি কিছুটা সময়ের জন্য তার পালস পেয়েছিলাম, কিন্তু একটু পরেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা সাথে সাথে সিপিআর দিতে শুরু করি। কিছু সময়ের জন্য যখন ওর জ্ঞান ছিল না, ভেবেছিলাম ও আর নেই। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল বলে আমরা চেষ্টা করছিলাম তাঁর হৃদযন্ত্রের গতি ফিরিয়ে আনতে। ও মৃত্যুর কতটা কাছে চলে গিয়েছিল? আমি নিশ্চিত না। ডিফিব্রিলেটর একবার ব্যবহারের পরেই ওর জ্ঞান ফিরে আসে। বলতে হবে, সাড়াটা বেশ দ্রুতই পেয়েছিলাম। তবে সেই মুহূর্তে আসলেই বলা যাচ্ছিল না, পরিস্থিতি কতটা আশঙ্কাজনক ছিল।'

ঘটনার খুব কাছেই দর্শকসারিতে থাকা একজনের কাছ থেকে পাওয়া যায় আরও পরিষ্কার বিবরণ, “ওরা ক্রিস্টিয়ানের চারপাশে একটা বলয় তৈরি করল। দেখলাম, ওরা কাঁদছে। ফিনিশ খেলোয়াড়রা হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সে সময় সব কিছু যেন থেমে গিয়েছিল। স্টেডিয়ামে তখন প্রায় ১৬ হাজার দর্শক ছিল। কিন্তু চারপাশের নীরবতা যেন বুকে এসে বিঁধছিল। এর মধ্যেই কয়েকজন "ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন, ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন" বলে স্লোগান দিতে শুরু করেছিল, কিন্তু বাকিরা সাড়া না দেয়ায় সেটাও থেমে গেল। কেউই আসলে বুঝছিলাম না, আমাদের কী করা উচিত। আমাদের কি চুপ থাকা উচিত, নাকি তার নামে স্লোগান দিয়ে উৎসাহ দেয়া উচিত? সবাই খুব অসহায় বোধ করছিলাম। এত কাছ থেকে দৃশ্যগুলো দেখা খুব কঠিন ছিল।'

মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন এরিকসেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

ফিনল্যান্ডের অধিনায়ক টিম স্পার্ভ ব্রিটিশ দৈনিক ডেইলি মেইলকে নিজের অনুভূতি জানিয়েছেন এভাবে: 'আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তাকে (এরিকসেন) কেউ বাজে ট্যাকল করেছে। ৫-১০ সেকেন্ড পর সবাই দৌড়ে ওর দিকে গেল... ঘটনা কিছুটা বুঝে ওঠার পর আমরা ধীরে ধীরে আমাদের বেঞ্চের দিকে ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিলাম আর আশা করছিলাম, একটু পরেই হয়তো ভালো কোন খবর পাব। গ্যালারিতে দেখলাম কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চা ধীরে ধীরে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পুরো জিনিসটা হজম করা খুবই কঠিন ছিল। সহজে এটা মন থেকে মুছবে না।'

মাঠে থাকা আরেক ড্যানিশ দর্শক জানাচ্ছেন, 'আমরা অনেকক্ষণ ধরেই কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। বেশ কিছু সময়, প্রায় ৪০ মিনিট পর যখন লাউড স্পিকারে বলা হলো ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের অবস্থা স্থিতিশীল, তখন সবাই তুমুল করতালি দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। দেখলাম, কেউ কেউ গান গাইছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ফিনিশ ফ্যানদের প্রতিক্রিয়া, ওরা স্লোগান দিচ্ছিলো "ক্রিস্টিয়ান", আর আমরা চিৎকার করে গলা মিলাচ্ছিলাম "এরিকসেন"। ওই মুহূর্তটা দারুণ ছিল, প্রায় সবাই স্টেডিয়ামেই ছিলাম।'

ড্যানিশ এই দর্শকের বর্ণনায় অদ্ভুত একটা বিষয়ও উঠে আসে। তিনি বলেন, '(ঘটনার আগে) আমি কয়েকটা বিয়ার পান করেছিলাম। কিন্তু যখন সব কিছু ঘটে গেল, তখন আমার বন্ধু আর আমার মনে হলো একটা কফি খাওয়া দরকার। আমরা কফি কিনতে গিয়ে দেখলাম সব কফি শেষ। সবাই শুধু কফি খাচ্ছে।'

মাঠের এই দৃশ্যগুলো টিভিতে সরাসরি দেখানো নিয়েও বেশ শোরগোল হয়েছে। ব্রিটিশ দর্শকরা বিবিসিতে স্পর্শকাতর দৃশ্যগুলো সরাসরি দেখানো নিয়ে বিবিসি’র সমালোচনা করেছেন। জবাবে বিবিসি নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে ক্ষমাও চেয়েছে।

এরিকসেনকে ঘিরে ড্যানিশ খেলোয়াড়দের মানব-বলয়। ছবি: গেটি ইমেজেস

অপর দিকে ঘটনার কয়েক মিনিট পর স্ট্রেচারে করে এরিকসেনকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর জ্ঞান ফিরেছে এবং তিনি কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের মাধ্যমে শ্বাস নিচ্ছেন, এমন একটা ছবিও বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জার্মান আলোকচিত্রী ফ্রিডম্যান ভোগেল ছবিটা তুলেছিলেন এরিকসেনকে আড়াল করে রাখা ড্যানিশ খেলোয়াড়দের বলয়ের ফাঁক দিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটা ছেড়ে দিয়ে সেই আলোকচিত্রীর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী ফুটবলপ্রেমীদের কিছুটা আশ্বস্ত করা। ইন্সটাগ্রামে তিনি লেখেন, '...প্রাণের সংকেতবাহী এবং হাঁফ ছেড়ে বাঁচার এই মুহূর্তটার ছবি আমি বিশ্বের সকল সম্পাদকের জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম। আপনারা যেভাবে চান, ছবিটা ব্যবহার করতে পারবেন।'

আলোকচিত্রী ফ্রিডম্যান ভোগেলের উদ্দেশ্যটা মহৎ হলেও ধন্যবাদের পাশাপাশি ভর্ৎসনাও তিনি কম পাননি। তাৎক্ষণিকভাবে যে ছবি ছড়িয়ে দিয়ে তিনি এরিকসেনের সাময়িক সুস্থতার খবর বিশ্ববাসীকে জানাতে চেয়েছিলেন, সেটাই হয়তো কারও কারও কাছে ভালো লাগেনি। ফ্রিডম্যান তাদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।

এদিকে ম্যাচ আবার শুরু করা নিয়েও হয়েছে তুমুল বিতর্ক। জানা গিয়েছে, এরিকসেনের অবস্থা স্থিতিশীল জানার পরেই উয়েফা দুই দলের খেলোয়াড়দের ম্যাচটি আবার শুরু করার জন্য চাপাচাপি করে। উয়েফার পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে, হয় সেদিনই ম্যাচটা শেষ করতে হবে অথবা পরের দিক স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় বাকি খেলা শুরু হবে। দুপুর ১২টায়, কারণ স্থানীয় সময় দুপুর ২টা, বিকেল ৫টা এবং রাত ৮টায় পরের দিনের নির্ধারিত ম্যাচ ছিল। টিভি শিডিউলের সাথে সংঘাত হবে বলে উয়েফা সেদিন খেলা না হলে পরদিন দুপুর ১২টার কথা বলেছিল।

সেদিনই ম্যাচটা শেষ হয়েছে, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ডেনমার্ক হেরেছে। ছবি: রয়টার্স

এর যে কোনোটার অর্থই ছিল, এরকম একটা হতবিহ্বল মুহূর্তের ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই খেলোয়াড়দের আবার খেলতে নামতে হবে।  

এরপরই ড্যানিশ খেলোয়াড়রা এরিকসেনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেন, যেখানে এরিকসেন নিজেই সতীর্থদের ম্যাচটা খেলতে অনুরোধ করেন। অন্যদিকে ফিনিশ খেলোয়াড়েরা বলেছিলেন, ড্যানিশ খেলোয়াড়েরা খেলতে চাইলে তাঁদের আপত্তি নেই।

কিন্তু আপত্তি এসেছে অন্য জায়গা থেকে; সাবেক ড্যানিশ গোলকিপার পিটার স্মাইকেল ক্ষোভ ছেড়েছেন তীব্র ভাষায়, 'আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে উয়েফা খুব বাজে একটা কাজ করেছে। এ রকম একটা মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থার মধ্যেও খেলোয়াড়দের খেলতে বাধ্য করাটা খুবই নিন্দনীয়। এটা কী ধরনের সমাধান? ওরা হোটেলে গিয়ে স্বস্তি পাবে? রাতে ঘুমাতে পারবে? তারপর সকাল ৮টায় উঠিয়ে আবার তাদের মাঠে পাঠিয়ে বলবেন ‘খেলাটা শেষ কর’!" উয়েফা অবশ্য অভিযোগের কোনো উত্তর দেয়নি।

ডেনমার্ক দলের ম্যানেজার স্বীকার করেছেন, তাঁর দলের খেলোয়াড়েরা খেলা শুরুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। বরং শিডিউল জটিলতা এড়াতেই তাঁরা কোনোমতে মাঠে নামতে রাজি হয়, 'আমি গর্বিত যে, খেলোয়াড়রা একতাবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্রিস্টিয়ানের ভালো কোনো খবর না পাওয়া পর্যন্ত তারা মাঠে নামবে না। এভাবে একটা ম্যাচ খেলা যায় না। কিন্তু এত দুশিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া, আবার সকালে মাঠে এসে খেলার ঝামেলা এড়াতে তারা খেলতে রাজি হয়।'

মাঠে ড্যানিশ খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? দলের সাথে ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, 'আমি নিশ্চিত গ্যালারিতে থাকা কেউই চাইছিল না, খেলাটা আবার শুরু হোক। যেভাবে আমাদের মাঠে নামতে বাধ্য করা হলো, সেটা অন্যায়। আমরা শারীরিক বা মানসিক কোনভাবেই খেলার জন্য তৈরি ছিলাম না।'

দলের সাথে থাকা আরেকজন জানিয়েছেন অধিনায়ক সাইমন কায়েরের অবস্থা, 'দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সাইমন ধাতস্থ হতে পারছে না, ও খেলার মতো অবস্থায় কোনোমতেই ছিল না। পুনরায় ম্যাচ শুরুর আগে আমরা যখন ওয়ার্ম আপ করতে নামলাম, দেখলাম সাইমন চুপচাপ হাঁটছে। দুজন কোচ ওর কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। সাইমনের চোখ খুঁজছিল গ্যালারির সেই অংশটা, যেখানে ক্রিস্টিয়ানের স্ত্রী বসেছিল। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। খেলা শুরু হবার কিছুক্ষণ পরেই সাইমনকে মাঠ থেকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় কোচ।'

ক্রিস্টিয়ানের স্ত্রী ভেবেছিলেন, তিনি মারা গেছেন।

ম্যাচ শেষ হবার পর সাইমন কায়ের তাঁর মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেন। জানা গেছে, সাইমন তাঁর মাকে বলেছিলেন, তাঁর পা দুটো চলতে চাইছিল না। সাইমন ও ক্রিস্টিয়ান দীর্ঘদিনের বন্ধু। দুজনই ইতালির মিলান শহরে ক্লাব ফুটবল খেলেন, ক্রিস্টিয়ান ইন্টার আর সাইমন এসি মিলানে। দীর্ঘদিন পর ডেনমার্কে এরকম বড় একটা আসর বসেছিল বলে খেলোয়ারদের পরিবার-পরিজন অনেকেই গ্যালারিতে উপস্থিত ছিল। তাঁদের সবার সামনেই পুরো ব্যাপারটা ঘটল।

খেলা শেষে ড্যানিশ টিম ম্যানেজার এরিকসেনের সাথে দেখা করে কথা বলেছেন, 'ক্রিস্টিয়ান আমাকে বলল, ওর (মাঠের ঘটনা) তেমন কিছু মনে পড়ছে না। ও বরং দলের বাকিদের কথাই ভাবছিল, সবাই কেমন আছে খোঁজখবর নিচ্ছিল। এটাই টিপিক্যাল ক্রিস্টিয়ান। ওর মুখে হাসি দেখে স্বস্তিবোধ করছিলাম।'

শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ ক্রিস্টিয়ান তাঁর ক্লাব দল ইন্টার মিলানের খেলোয়াড়দের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও মেসেজ দেন, 'আই অ্যাম গুড।'

সব মিলে খুব বিধ্বস্ত একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলেও, মানতেই হবে, ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন আসলে খুবই সৌভাগ্যবানদের একজন। এমন সময় এমন জায়গায় তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলো, যেখানে হাতের নাগালেই ছিল প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, ডিফিব্রিলেটর এবং জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সামগ্রী। পার্কেন স্টেডিয়ামের মেডিকেল রুমটাও যথেষ্ট সুযোগসুবিধা সম্পন্ন। একাধিক অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত ছিল এবং ডেনমার্কের অন্যতম সেরা হাসপাতাল রিগসহস্পিতালেটও ছিল স্টেডিয়াম থেকে গাড়িতে মাত্র চার মিনিটের দূরত্বে।

*'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর:  আজহারুল ইসলাম

​​​​​​আরও পড়ুন: কিন্তু এরিকসেন, আমি যে জীবন লিখতে জানি না...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×