বিমূঢ় করে দেওয়া গিলক্রিস্টের সেই ‘ওয়াক’
উৎপল শুভ্র
১৪ মে ২০২১
অন্য কোনো ম্যাচে হলে হয়তো এত আলোচিত হতো না। কিন্তু বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আম্পায়ার আউট না দেওয়ার পরও `ওয়াক` করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অরবিন্দ ডি সিলভার বলে গিলক্রিস্ট `ওয়াক` করতেই পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্কের বিমূঢ় প্রেসবক্সের কথা এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে। ২০০৩ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে বাকি সব ছাপিয়ে শুধু ওই দৃশ্যটাই মনে গেঁথে আছে এখনো।
প্রথম প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০০৩। প্রথম আলো।
এক সময় যা ছিল ক্রিকেটের নিয়মিত চিত্র, সেটিই কাল বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দিল সেন্ট জর্জেস পার্কের ১৯ হাজার দর্শককে। পোর্ট এলিজাবেথে শ্রীলঙ্কার কলম্বোর উইকেট খুঁজে পাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা-সব কিছু ছাপিয়ে কাল ২০০৩ বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালের লাঞ্চের সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। মাত্র ২২ রান করার পরও!
ষষ্ঠ ওভারেই আক্রমণে আসা অরবিন্দ ডি সিলভার দ্বিতীয় বলটিতে সুইপ করতে গিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট। বাতাসে উঠে যাওয়া সেই বল নিয়ে শ্রীলঙ্কান উইকেটকিপার কুমার সাঙ্গাকারার তুমুল আবেদনে যোগ দিল পুরো শ্রীলঙ্কা দলই। দক্ষিণ আফ্রিকান আম্পায়ার রুডি কোয়ের্তজেন মাথা নাড়লেন। তাঁর মাথা নাড়া শেষ হতে না হতেই দেখা গেল এক বিস্ময়কর দৃশ্য, গিলক্রিস্ট ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন!
এক টানেই যেন ক্রিকেটকে কয়েক দশক পেছনে নিয়ে গেলেন গিলক্রিস্ট, যখন ক্রিকেট ছিল সত্যিকার জেন্টলম্যানস্ গেম, যখন আউট বুঝতে পারার পর ব্যাটসম্যানরা আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতেন না।
কিন্তু সেসব তো সুদূর অতীতের কথা, যখন ক্রিকেট ছিল শুধুই একটা খেলা, এমন দিগন্তবিস্তারি বিশাল বাণিজ্যের মাধ্যম নয়। এই বাণিজ্যমুখর ক্রিকেটে গিলক্রিস্টের 'ওয়াক' করার ঘটনাটা এতই অবাস্তব বলে মনে হলো যে, দর্শক তাঁকে ঠিকমতো অভিনন্দনও জানাতে পারলেন না। তাঁদের ঘোর কাটতে না কাটতেই গিলক্রিস্ট মাঠের বাইরে।
কাল 'ওয়াক' করে যাঁকে উইকেট দিলেন গিলক্রিস্ট, সেই অরবিন্দ ডি সিলভা এই বিশ্বকাপেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কট বিহাইন্ড হয়েছেন বুঝতে পেরে আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করেননি। কয়েক বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভারত সফরে ৯০-এর ঘরে থেকেও নিজে থেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন ব্রায়ান লারা। পেশাদারত্বের চাপে খেলোয়াড়ি মূল্যবোধগুলো এমনই চিড়েচেপ্টে গেছে যে, এগুলোকে ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হয় এবং ব্যতিক্রম বলেই মনে আছে এগুলো।
কিন্তু অ্যাডাম গিলক্রিস্টেরটির সঙ্গে তুলনা চলে না এগুলোর। প্রথমত এটি শুধুই আর একটি ম্যাচ নয়, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। দ্বিতীয়ত অ্যাডাম গিলক্রিস্ট অস্ট্রেলিয়ান, 'ওয়াক' করার ব্যাপারে যাদের এতটাই সুনাম যে, একটা রসিকতাই চালু হয়ে গিয়েছিল, 'দ্য অস্ট্রেলিয়ানস অনলি ওয়াক হোয়েন দেয়ার কার ব্রেকস ডাউন।'
সবচেয়ে বড় প্রমাণটা দিতে পারেন অ্যালান ডোনাল্ড ও ডেভ রিচার্ডসন। ১৯৯২ বিশ্বকাপে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। ডোনাল্ডের করা ম্যাচের প্রথম বলটি এমনভাবেই জিওফ মার্শের ব্যাটের কানা নিল যে, উইকেটকিপার ডেভ রিচার্ডসনকে ডাইভ দিয়ে প্রায় প্রথম স্লিপের সামনে থেকে ধরতে হলো তা। তারপরও নিউজিল্যান্ডের আম্পায়ার ব্রায়ান অলড্রিজের আঙুল উঠল না আর জিওফ মার্শ এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন কিছুই হয়নি। এবারের বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের কোচ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে ১১ বছর পর স্থানীয় এক সাংবাদিকের কাছে জিওফ মার্শ স্বীকার করলেন যে, তিনি আউট ছিলেন। আউট ছিলেন, তারপরও বেরিয়ে আসেননি, কারণ তাঁরও যে বিশ্বাস সেই অস্ট্রেলীয় মতবাদে, যেটি বলছে, আউট কি না তা বিচার করার জন্য তো আম্পায়ারই আছেন মাঠে।
যে স্লেজিংয়ের ব্যাপারে অস্ট্রেলীয়দের এত নামডাক (!), সেই স্লেজিংয়ের মতো এই 'ওয়াক' না করার সংস্কৃতি চালু করার কৃতিত্বও দেওয়া হয় ইয়ান চ্যাপেলকেই । সত্তরের দশকে যখন হিপ্পি সংস্কৃতি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্বের তরুণ সমাজকে, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে সেই সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইয়ান চ্যাপেল। জিন্সের প্যান্ট, বুকখোলা টি শার্ট-ক্রিকেটারদের জেন্টলম্যান সুলভ ভাবমূর্তিটাই প্রবল নাড়া খেল তাঁর হাতে। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান যখন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান, একবার ডিসিপ্লিনারি কারণে তাঁর সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ পেয়ে হাতে বিয়ারের মগ আর মুখে সিগার নিয়ে হাজির হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ইয়ান চ্যাপেল।
অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত লড়িয়ে মেজাজের জনক বলেও মানা হয় এই ইয়ান চ্যাপেলকেই। তিনিই প্রথম দলকে বলেন, মাঠে নিয়মের মধ্য থেকে যতটা কঠিনভাবে খেলা যায়, আমরা তা-ই খেলব। যা বলেননি, তা হলো প্রয়োজনে নিয়মগুলোকেও একটু নেড়েচেড়ে দেখব। 'ওয়াক' না করার সংস্কৃতি চালুর পেছনে অবশ্য একটা গল্প আছে। এক টেস্ট ম্যাচে ইয়ান চ্যাপেলের ব্যাটে লেগে বল পেছনে যাওয়ার পর তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে গালির ফিল্ডারকে জিজ্ঞেস করলেন,' হ্যাভ ইউ কট ইট?'
উত্তরে 'ইয়েস' শুনেই চ্যাপেল হাঁটতে শুরু করলেন। ড্রেসিংরুমে ফেরার পর সতীর্থরা বলতে লাগল, তুমি করেছ কী, ও তো বলটা প্রথম বাউন্সে ধরেছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দিনের খেলাশেষে ওই ফিল্ডারকে ধরলেন চ্যাপেল, 'তুমি মিথ্যে বলেছ কেন?' নির্বিকার ভঙিতে জবাব এল, 'আমি মিথ্যে বলিনি তো! আমি তো বলটি ধরেছিই, প্রথম বাউন্সে ধরেছি কি না, তুমি তো তা জিজ্ঞেস করোনি। ইয়ান চ্যাপেল জানাচ্ছেন, 'সেদিন থেকেই আমার ওয়াক করার ইতি।'
বিশ্ব ক্রিকেট থেকেই 'ইতি' ঘটে গিয়েছিল। দেখা যাক, অ্যাডাম গিলক্রিস্টের মাধ্যমে তা আবার ফিরে আসে কি না!
আরও পড়ুন: অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সাক্ষাৎকার
আরও পড়ুন: অরবিন্দ ডি সিলভার সাক্ষাৎকার