অ্যাডাম গিলক্রিস্টের একান্ত সাক্ষাৎকার
`টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখি, তবে আপাতত লক্ষ্য বিশ্বকাপ জেতা`
উৎপল শুভ্র
২ মে ২০২১
সবর্কালের সেরা উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর নামটা একরকম ধ্রুব সত্যের রূপ নিয়েছে। টেস্ট ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞাও অনেকটাই বদলে দিয়েছেন তিনি। অথচ অবাক হতে পারেন এটা জেনে যে, এই অ্যাডাম গিলক্রিস্টের যখন প্রথম ইন্টারভিউ করি, টেস্ট ক্রিকেট তখন তাঁর স্বপ্নের নাম। ৬৫টি ওয়ানডে খেলা হয়ে গেছে ততদিনে। তবে টেস্ট করে খেলবেন জানেন না। সেই সময়ের গিলক্রিস্টকে বুঝতে ইন্টারভিউয়ের শুরুতে লম্বা ভূমিকা ওরকমই রেখে দিলাম।
প্রথম প্রকাশ: ১৩ জুন ১৯৯৯। প্রথম আলো।
অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দল থেকে যখন বাদ পড়লেন মার্ক টেলর ও ইয়ান হিলি, হইচই হয়েছিল ভালোই। ওয়ানডের জন্য ভিন্ন দল গড়ার চিন্তা থেকেই দলে এলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। কিছুদিনের মধ্যেই সবাই বলতে শুরু করল, একজনকে দিয়েই ওই দুজনের শূন্যতা পূরণ করে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া। হিলির মতো অতটা নিখুঁত না হলেও উইকেট কিপিংটা খুব খারাপ করেন না গিলক্রিস্ট, তবে ওয়ানডের ওপেনার হিসেবে তাঁর সঙ্গে মার্ক টেলরের কোনো তুলনাই চলে না। দুজনই বাঁহাতি–মিল বলতে এটুকুই।
গিলক্রিস্ট অনেক বেশি আক্রমণাত্মক, চোখ ধাঁধানো সব শট খেলার ক্ষমতা আছে তাঁর। গত কিছুদিনের রেকর্ড বিবেচনায় নিলে মার্ক ওয়াহর সঙ্গে তাঁর ওপেনিং পার্টনারশিপটির সঙ্গে তুলনা হতে পারে শুধু ভারতের শচীন টেন্ডুলকার-সৌরভ গাঙ্গুলী জুটিরই। স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেই যিনি খেলতে পারেন, এমন একজনকে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে পাওয়াটা যেকোনো দলের জন্যই সৌভাগ্যের ব্যাপার। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহও যা স্বীকার করেন নির্দ্বিধায়। এই বিশ্বকাপে (১৯৯৯) দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জীবন-মরণ ম্যাচের আগেই যেমন মার্ক ওয়াহর ফর্মে ফেরা প্রসঙ্গে গিলক্রিস্টকে টেনে আনলেন তিনি, ‘মার্ক রান পাচ্ছে, এটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার। তবে আমি বড় কিছু আশা করছি ক্রিস্টক্রিস্টের কাছ থেকে। হয় তো কালই তা পাওয়া যাবে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ও সব সময়ই রান করে।’
ইয়ান হিলি যখন উইকেটকিপার, তখন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলা গিলক্রিস্টের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার এই দলে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরি আছে শুধুই মার্ক ওয়াহর। মাত্র ৫১ ম্যাচে ৫টি সেঞ্চুরি নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বকাপে। এই পাঁচ সেঞ্চুরির মধ্যে এ বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর ১৫৪ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড। ওয়ানডে ইতিহাসে আর কোনো উইকেটকিপারের এর চেয়ে বড় স্কোর নেই।
গতকাল বিকেলে (১২ জুন ১৯৯৯) লিডসের হেডিংলি মাঠে প্র্যাকটিসের পর অ্যাডাম গিলক্রিস্টের এই একান্ত সাক্ষাৎকার। তাঁর প্র্যাকটিস তো অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি শ্রমসাধ্য। নেটে ব্যাটিংয়ের পর আলাদা করে আবার কিপিং প্র্যাকটিস। ইন্টারভিউ দিতে রাজি হবেন কি না, তা নিয়ে তাই যথেষ্টই সংশয়ে ছিলাম। অথচ আমাকে একটু অবাক করে দিয়ে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। বগলে প্যাড, কিপিং গ্লাস; হাতে হেলমেট-ব্যাট...এই অবস্থাতেই হেডিংলিতে দাঁড়িয়ে বললেন, 'ওকে, ইউ ক্যান স্টার্ট।'
উৎপল শুভ্র: এই বিশ্বকাপে তো বিশাল এক সুনাম নিয়ে এসেছিলেন আপনি। পারফরম্যান্স তো সে রকম হলো না এখনও... (তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে করেছিলেন ১৪৫ রান, সর্বোচ্চ ৬৩ বাংলাদেশের বিপক্ষে)
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট: হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। আমি তো রানই করতে পারলাম না এখনও। তবে সব ব্যাটসম্যানেরই এমন সময় আসে। এ নিয়ে বেশি ভাবছি না। আমি জানি, যেকোনো দিনই রান পেতে পারি।
শুভ্র: আপনার ব্যাটে খরার কারণটা কি ইংলিশ কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা?
গিলক্রিস্ট: শুরুতে আসলেই সমস্যা হয়েছিল। তবে গত এক-দুসপ্তাহে খুবই ভালো উইকেট পেয়েছি। যদিও সেভাবে তা কাজে লাগাতে পারিনি।
শুভ্র: আপনি তো ইনিংসের শুরুতে শট খেলার জন্যই বেশি বিখ্যাত। এই ইংলিশ কন্ডিশন কি ব্যাটিং স্টাইলে কোনো পরিবর্তন আনার কথা ভাবিয়েছে আপনাকে, কারণ এখানে তো ইংনিসের শুরুতে ওই স্টাইলে খেলা সহজ নয়।
গিলক্রিস্ট: হতে পারে. এ কারণেই আমি সেরকম রান পাইনি। তবে এই খারাপ সময় আমি তাড়াতাড়িই কাটিয়ে উঠব।
শুভ্র: যখন ইয়ান হিলিকে সরিয়ে স্পেশালিস্ট উইকেটকিপার হিসেবে ওয়ানডে দলে এলেন, এ নিয়ে তো অনেক হইচই হয়েছে। দারুণ চাপ মাথায় নিয়েই শুরু করতে হয়েছে আপনাকে…
গিলক্রিস্ট: হিলি অবশ্যই দারুণ এক খেলোয়াড়, টেস্টে যেমন, ওয়ানডেতেও তাই। তাঁর জায়গাটা পূরণ করা তাই সহজ ছিল না। তারপরও আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। দেখুন, এটা তো আসলে দলের স্বার্থেই করা হয়েছিল। হিলি এখনও টেস্ট দলে খেলছে এবং বিশ্বসেরা হিসেবেই খেলছে। আমার ব্যাটিংই হয়তো ওয়ানডে দলে তার চেয়ে একটু এগিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমিও মনে হয়, খুব একটা খারাপ করছি না। এই বিশ্বকাপে এখনও রান পাইনি, তবে এখনও তো ম্যাচ বাকি আছে কিছু, এটা পুষিয়ে দিতে চাই।
শুভ্র: যখন বাইরে বসে খেলা দেখতেন, তখন কোন ওপেনার সবচেয়ে ফেবারিট ছিল আপনার?
গিলক্রিস্ট: ভালো ওপেনার তো অনেক। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ওপেনাররা উপমহাদেশে যেভাবে খেলে, তা তো এক কথায় দুর্দান্ত। শচীন টেন্ডুলকার তো দারুণ!
শুভ্র: ওপেনিংয়ে পার্টনার হিসেবে কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকলে কাকে নেবেন?
গিলক্রিস্ট: মার্ক ওয়াহ।
শুভ্র: তাহলে তো আপনার স্বপ্নের পার্টনারকে বাস্তবেও পেয়ে গেছেন আপনি...
গিলক্রিস্ট: হ্যাঁ, আসলেই তাই। আমি মনে করি, আমরা দুজন একে অন্যের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে যাই। ও দারুণ এক পজিটিভ ব্যাটসম্যান। এই যে সেদিন লর্ডসে সেঞ্চুরিটা করল (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে), দুর্দান্ত এক ইনিংস। লোকে বলে আমি খুব মেরে খেলি। অথচ দেখবেন, মার্ক ওয়াহ স্কোরিং রেটে কারও চেয়েই পিছিয়ে নয়। আমি খুব খুশি যে, ওর মতো একজন পার্টনার পেয়েছি।
শুভ্র: অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি তো আপনার। এই রেকর্ডটি নিশ্চয়ই আপনার মনে গর্বের অনুভূতি জাগায়।
গিলক্রিস্ট: এই রেকর্ডটির মালিক হওয়া অবশ্যই দারুণ ব্যাপার। তবে ওয়ানডে খেলাটাই এমন। হয়তো এক দিন আপনি যা করতে চাইলেন, তা-ই হলো। আরেক দিন আউট হয়ে গেলেন প্রথম বলেই। কাজেই কী পেয়েছি, সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নতুন আরেকটা কিছু পাওয়ার চেষ্টাই করা উচিত।
শুভ্র: ১৫৪ রানের ওই ইনিংসটিই কি আপনার সেরা?
গিলক্রিস্ট: না, না, এটি সর্বোচ্চ। তবে তার মানে এই নয় যে, এটিই সেরা । অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলা আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসও এটি নয়। বরং অন্য আরও কিছু ইনিংস আছে, যাতে দল আরও বেশি উপকৃত হয়েছে। হ্যাঁ, ওর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে খেলা ইনিংসও আছে আমার।
শুভ্র: তাহলে সেগুলোর কথাই বলুন।
গিলক্রিস্ট: একবার পাকিস্তানে একটা ম্যাচে যখন আমরা ৩১৬ চেজ করেছিলাম, আমি সেঞ্চুরি করেছিলাম তাতে (১৯৯৮ সালের নভেম্বরে লাহারের ওই ম্যাচে গিলক্রিস্ট করেছিলেন ১০৪ বলে ১০৩)। আরেকটি সিডনিতে, ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজের দ্বিতীয় ফাইনালে, আমি সেঞ্চুরি করি, ম্যাচও জিতি (১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০৪ বলে ১০০)। এরপর তৃতীয় ফাইনালেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাই আমরা। এ কারণে এটি আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে।
শুভ্র: এখন স্বপ্ন তো টেস্ট দলে ঢোকা, তাই না? এখনও যে টেস্ট খেলা হলো না,আক্ষেপ হয় না তাতে?
গিলক্রিস্ট: এই মুহূর্তে স্বপ্ন একটাই–বিশ্বকাপ জেতা। তবে টেস্ট খেলার স্বপ্নটা তো আছেই, সেটিকে বলতে পারেন দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। তবে হিলস্ (ইয়ান হিলি) এখনও খেলছে এবং অসাধারণ খেলছে। তাই আপাতত বর্তমান ভূমিকাতেই মনসংযোগ করতে হবে। তবে একদিন না একদিন টেস্ট খেলব, এই স্বপ্ন তো আছেই।
শুভ্র: আপনার অলটাইম ফেবারিট ওয়ানডে ব্যাটসম্যান কে?
গিলক্রিস্ট: এটা বলা খুব কঠিন। আমি আগেই যেমন বলেছি, টেন্ডুলকার, মার্ক ওয়াহ...রাহুল দ্রাবিড়ও এই টুর্নামেন্টে খুব ভালো করছে।
শুভ্র: বর্তমান ব্যাটসম্যানদের কথা বলছি না। আপনার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান কে?
গিলক্রিস্ট: অবশ্যই ভিভ রিচার্ডস। অবিশ্বাস্য! শুধু তাঁর রেকর্ড নয়, যেভাবে তিনি রান করেছেন, তাতে আর কে আমার অলটাইম ফেবারিট হবে?