আপনি কি ক্ষমা করেছিলেন, হ্যারল্ড লারউড?
উৎপল শুভ্র
২২ জুলাই ২০২১
বডিলাইন সিরিজে হ্যারল্ড লারউডকে ব্যবহার করে অ্যাশেজ জেতার পর `বলির পাঁঠা` বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁকেই। বলা হয়েছিল ক্ষমা চাইতে। লারউড ক্ষমা চাইবার চাইতে টেস্ট ক্রিকেটকে বিসর্জন দেওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। তাঁর প্রতি এই অন্যায়ের জন্য আসলে তো ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল ইংল্যান্ডের। মৃত্যুর দশ মাস আসে এমবিই খেতাব দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে সেটিই হয়তো চাওয়া হয়েছিল।
১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে এমবিই (মেম্বার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার) খেতাবটি না পেলে বড় আক্ষেপ নিয়ে যেতে হতো হ্যারল্ড লারউডকে। ১৯৩৩ সাল থেকে মনে চেপে রাখা অভিমান ততদিনে রূপ নিয়েছিল জমাটবাঁধা বরফে। তাঁর প্রতিভা, তাঁর সামর্থ্যকে নিজেদের স্বার্থে নিংড়ে নিয়ে তাঁকেই 'বলির পাঁঠা' বানানোর যে চেষ্টা চলছিল বডিলাইন বিতর্কের পর, সেই যন্ত্রণাটা কখনোই ভুলতে পারেননি লারউড। এমবিই-টা তাই তাঁর কাছে শুধু একটা সম্মানই ছিল না, সেটা ছিল তার প্রতি করা অবিচারের জন্য অনানুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনাও।
এর বছর দুয়েক পর, ১৯৯৫ সালের ২২ জুলাই সিডনির এক হাসপাতালে যখন বাতাসে মিলিয়ে গেল তাঁর সময়কার তো বটেই, সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের অন্যতম লারউডের শেষ নিঃশ্বাস, তাতে ব্রিটিশ ক্রিকেট এস্টাবলিস্টমেন্টের প্রতি অভিমান এবং অভিযোগের বদলে পরিতৃপ্তির ছোঁয়াটাই বেশি ছিল বলে ধরে নেয়া যায়। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ একটি অধ্যায়, বডিলাইন সিরিজের নায়ক জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে মাত্র ২ রানের জন্য সেঞ্চুরি পাননি।
ক্রিকেটের মতো জীবনেও সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসেছিলেন। হ্যারল্ড লারউড মারা গেছেন ৯০ বছর বয়সে। ১৯২৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডসে প্রথম টেস্ট, পরবর্তী এক দশকেরও বেশি শুধু ইংল্যান্ডের নয়, ক্রিকেট-বিশ্বেরই দ্রুততম বোলার হিসেবে তাঁর অবস্থানের নড়চড় হয়নি কোনো। তবে বোলার হিসেবে তর্কাতীত সামর্থ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, বডিলাইন বিতর্কটাই ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্ব দিয়েছে তাঁকে। এ কারণেই ক্রিকেট ইতিহাসে সবসময়ই স্বতন্ত্র একটা অধ্যায় দাবি করে এসেছেন লারউড এবং বলাই বাহুল্য, সেই দাবি মেটাতেই হয়েছে। একটি মাত্র সিরিজ, ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজ সিরিজ, তাঁতে অনেকের মধ্যে একজন করে রাখেনি, লারউডকে পরিণত করেছে অনন্য একজন বোলারে। নইলে হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসে আরো অনেক স্পিডস্টারদের একজন হিসেবেই চিনতে হতো তাঁকে ।
সে হিসেবে লারউডের অমরত্বের বীজটা রোপিত হয়েছিল ১৯৩২ সালের শেষ দিকে লন্ডনের পিকাডিলি হোটেলের এক ডিনারে। সেখানে এক সন্ধ্যায় চারজন ভদ্রলোককে দেখা গেল নিমগ্ন হয়ে আলোচনা করতে। কৌতূহলী কেউ কান পেতেছিলেন কী-না, জানা নেই! তবে পেতে থাকলে 'লেগ-থিওরি', 'ডন’, ‘লারউড’, ‘ভোস’-এমন কয়েকটি শব্দ ঘনঘনই শুনতে পেতেন। আলোচনাটা হচ্ছিল একটা উদ্দেশ্য সাধনের উপায় নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যের শিরোনাম—বছরখানেক পর অস্ট্রেলিয়া থেকে 'ছাই' অর্থাৎ অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনা।
ওই চার ভদ্রলোকের নাম ডগলাস জার্ডিন, ডোনাল্ড কার, হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোস। ডগলাস জার্ডিন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ইংল্যান্ডের ইস্পাতদৃঢ় মনোবলের অধিনায়ক, নিয়মের মধ্যে থেকে যে কোনো উপায়ে জয় পাওয়ার চেষ্টা ছাড়া যিনি খেলার অন্য অর্থ বোঝেন না । হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোস ইংল্যান্ডের দুই ফাস্ট বোলার এবং ডোনাল্ড কার লারউডের কাউন্টি নটিংহ্যামশায়ারের অধিনায়ক। এই চারজনের আলোচনা থেকে যা বেরিয়ে এল, বছরখানেক পর তার প্রয়োগে একেবারে টালমাটাল ক্রিকেট বিশ্ব। ফিক্সিং যদি ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয়, বডিলাইন-ও খুব একটা পেছনে থাকবে না।সেই সিরিজ শেষে এক শতাব্দী ছুঁই ছুঁই সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও তা নিয়ে বিতর্কের যে তীব্রতা, নানা মত, তাতে কখনো কখনো তো এটিকে ফিক্সিংয়ের চেয়ে বড় বিতর্ক বলে মনে হয়।
দু'জন মানুষ না থাকলে এসবের কিছুই হতো না! ডগলাস জার্ডিনের মতো মানসিকভাবে এমন শক্তিশালী অধিনায়ক ছাড়া 'লেগ-থিওরি' বা বডিলাইন অ্যাটাকের পরিকল্পনা তীব্র সমালোচনার মুখে হয়তো অঙ্কুরেই ধ্বংস হয়ে যেত। এটা তো পরের কথা। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান নামের এক জিনিয়াস অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ব্যাট না ধরলে এই চিন্তাই আসত না জার্ডিনের মাথায়। টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভাবের পর থেকেই ডন সাহেব রান করাটাকে তাঁর একমাত্র পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ইংল্যান্ড সফরে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির ব্যাটসম্যান যা করলেন, সেটিকে একটু 'বাড়াবাড়ি' বলেই মানতে হয়। সেই সিরিজের পাঁচ টেস্টে ব্র্যাডম্যানের ৭টি ইনিংস ছিল এরকম: ৮ ও ১৩১, ২৫৪ ও ১, ৩৩৪, ১৪, ২৩২। ১৩৯.১৪ গড়ে মোট ৯৭৪ রান! ২-১ টেস্টে অ্যাশেজ জিতে অস্ট্রেলিয়ার দেশে ফেরা।
সেই 'অ্যাশেজ' ফিরিয়ে আনতে হলে যে ডনের ব্যাটকে স্তব্ধ করতে হবে, সেটা ভালোই বুঝেছিলেন জার্ডিন। এই রানমত্ততার মধ্যেও ব্র্যাডম্যানের একটি দুর্বলতা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন তিনি। লেগ স্টাম্পের ওপর পিচ পড়ে শরীরের দিকে ধেয়ে আসা দ্রুতগতির বলে একটু যেন নড়বড়ে মনে হয় তাঁকে। পরে অস্ট্রেলীয় এক সাংবাদিকের দেয়া 'বডিলাইন' নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া লেগ-থিওরির জন্ম এখান থেকেই । জার্ডিন জানতেন,ব্র্যাডম্যানের দ্রুত ফুটওয়ার্ক এবং বিদ্যুতের মতো রিফ্লেক্সের বিপক্ষে শুধু এই থিওরিতে কাজ হবে না। তা কার্যকর করতে বলে থাকতে হবে তুমুল গতি এবং একই সঙ্গে তা হতে হবে নিশানায় অব্যর্থ। জার্ডিনের সৌভাগ্য, তাঁর দলে ছিলেন হ্যারল্ড লারউড!
১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ‘ওটারান্টো' জাহাজে ওঠার আগে লারউডের টেস্ট রেকর্ড ছিল খুবই সাধারণ, ১৬ টেস্টে ৪৫ উইকেট। ১৯৩২-৩৩ 'বডিলাইন' সিরিজের ৫ টেস্টেই সেই লারউডের ৩৩ উইকেট (গড় ১৯.৫১)। লেগ সাইডে ৬/৭ জন ফিল্ডার রেখে লেগ স্টাম্পের লাইনে শরীর লক্ষ্য করে ক্রমাগত শর্ট পিচ বল করার ব্যাপারে ক্রিকেটে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু তারপরও ইংল্যান্ডের এই বোলিং ট্যাকটিক্স নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠল। অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুল ও উইকেটকিপার বার্ট ওল্ডফিল্ড লারউডের বলে আহত হওয়ার পর ঘৃতাহুতি হলো আগুনে। লারউডের বাউন্সারে হুক করতে গিয়ে মাথায় বল লাগল ওল্ডফিল্ডের, হাড়ে সূক্ষ্ম চিড়। তবে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর ওল্ডফিল্ড প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন, তা হলো—এত লারউডের কোনো দোষ নেই, আঘাতটা পেয়েছেন তিনি নিজের ভুলেই।
অস্ট্রেলীয় দর্শকের তা শুনতে বয়েই গেছে। উত্তপ্ত গ্যালারি থেকে জার্ডিন ও লারউডের উদ্দেশে যে যথেষ্ট প্রীতিসম্ভাষণই হয়েছিল, সেটা হয়তো বলারই প্রয়োজন নেই। অ্যাডিলেডের ওই ঘটনার পরই অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড লর্ডসে ঐতিহাসিক ক্যাবল, যাতে 'অখেলোয়াড়সুলভ' বলে দাবি করা হলো ইংল্যান্ডের এই বোলিং কৌশলকে। দু'দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে হালকা একটা হুমকিও ছিল তাতে। এমসিসি অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে ক্রিকেটের মূল্যবোধ মেনে চলায় জার্ডিনের দলের সদিচ্ছার প্রতি তাদের আস্থার কথা জানিয়ে দিল।
দুই বোর্ডের মধ্যে ক্যাবলবার্তার আদান-প্রদান চলতে থাকল নিয়মিতই, আর মাঠে রাজত্ব করে গেলেন জার্ডিন আর লারউড। অসুস্থতার কারণে ব্র্যাডম্যান সিরিজের প্রথম টেস্টে খেলতে পারেননি। বাকি চার টেস্টে তার স্কোর : ০ ও ১০৩, ৮ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪, ৪৮ ও ৭১। ৫৬.৬৭ গড়ে ৩৯৬ রান। অন্য যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই বেশ ভালো; কিন্তু ব্র্যাডম্যানের জন্য সেটিই 'ব্যর্থতা'। শুধু দ্বিতীয় টেস্টটিই জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া, হার বাকি চারটিতেই। ৪-১ টেস্টে সিরিজ জিতে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করল ইংল্যান্ড, অথবা বলা ভালো, অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করলেন লারউড।
পরে কৃতজ্ঞ অধিনায়ক লারউডকে যেটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে নটিংহ্যামশায়ার ও সারের মধ্যে একটি ম্যাচ চলার সময় ২০ হাজার দর্শকের সামনে জার্ডিন ঘোষণা করলেন, লারউডের জন্যই অ্যাশেজ জিতেছে ইংল্যান্ড। লারউডের হাতে তুলে দিলেন একটি রূপার তৈরি অ্যাশট্রে (ছাই জেতার জন্য ছাইদানিই তো উপযুক্ত উপহার), যাতে উৎকীর্ণ ছিল এই কথাগুলো: 'To Harold for the Ashes 1932-33 from a grateful skipper'.
মাঝখানে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়া থেকেই তাসমান সাগরের ওপারের নিউজিল্যান্ডে গিয়েছে ইংল্যান্ড দল। অস্ট্রেলিয়ার শক্ত উইকেটে ক্রমাগত শর্টপিচ বল করার ধকলটা তাঁর বাঁ পায়ের পাতায় ভালোই চিহ্ন রেখে যাওয়ায় সেখানে থেকেই দেশে ফিরে আসতে হয়েছে লারউডকে। ওই 'ওটরান্টো’ জাহাজে করেই। যা থেকে নেমে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখতেই লারউড দেখলেন, তাঁর অপেক্ষায় সাংবাদিকদের ভিড়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তো চাই-ই তাঁদের, অনেকে এসেছেন বড় প্রস্তাব নিয়েও। সিরিজ সম্পর্কে লারউডের স্টোরি কিনে নিতে আগ্রহী ইংল্যান্ডের প্রায় সব পত্রিকা।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে লারউড জানিয়েছেন কিছু অফারের কথাও। যেমন—“ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড’ প্রতি ৩০০ শব্দের জন্য দিতে চেয়েছিল ১০০ পাউন্ড করে। লন্ডনেরই আরেকটি পত্রিকা শব্দপিছু এক পাউন্ড। সময়টার কথা মনে পড়লে অফারটাকে লোভনীয় বললে কম বলা হয়। কিন্তু সফর শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না—এমসিসির সঙ্গে এই চুক্তির সম্মান রাখতে সবাইকেই নিরাশ করলেন লারউড। নিউজিল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ড দল দেশে ফিরে আসার পর বোমাটা ফাটালেন 'সানডে এক্সপ্রেস'-এ। এতে তিনি বললেন, তাঁর বোলিংয়ে ব্র্যাডম্যান ছিলেন ভীত, উডফুল ছিলেন ধীরগতির এবং অস্ট্রেলীয় দর্শকরা উচ্ছৃংখল, খেলা সম্পর্কে অজ্ঞ ও শুধুই নিজেদের দলের জয় দেখতে আগ্রহী। দাবি করলেন, তিনি কখনোই কোনো ব্যাটসম্যানকে আহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বল করেননি। হ্যাঁ, ভয় দেখাতে, তাঁকে নড়বড়ে করে তুলতে তো করেছেনই।
লারউডের এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর এরই মধ্যে তেতে থাকা দু'দেশের ক্রিকেট সম্পর্কে রীতিমতো দাউদাউ আগুন। পরে তো যা প্রমাণিত লারউডের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তিসূচক বলেও। ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড সফরে আসার আগে 'বডিলাইন বোলিং আর হবে না' বলে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ডগলাস জার্ডিনের মতো কৃতজ্ঞতাবোধ সবার থাকে না। ইতিমধ্যে রাজনীতিবিদরাও ঢুকে পড়েছেন এর মধ্যে। দু'দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলায় ব্যগ্র এমসিসি লারউডকে তাঁর বোলিংয়ের জন্য ক্ষমা চাইতে বলল।
এটা শোনার পর লারউডের অনুভূতিটা তাঁর আত্মজীবনী থেকেই তুলে দেয়া ভালো: “যা শুনলাম, তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার পাকস্থলীতে কী যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। আমার মনে পড়ল, অধিনায়কের নির্দেশে কিভাবে অস্ট্রেলিয়ায় আমার শরীর ব্যথায় জর্জর না হওয়া পর্যন্ত, পায়ের পাতায় রক্ত না বেরোনো পর্যন্ত বোলিং করে গেছি আমি। আমার মনে পড়ল, বোলিংয়ের প্রচণ্ড ধকলের পর আমার পাকস্থলী যেকোনো খাবারের বিরুদ্ধেই কেমন বিদ্রোহ ঘোষণা করতো। আমার মনে পড়ল, ক্লান্ত-শ্রান্ত না হয়ে পড়া পর্যন্ত কিভাবে লম্বা স্পেল করে গেছি আমি, অথচ এরপরও জার্ডিন এগিয়ে এসে বলেছে, 'আর একটা ওভার হয়ে যাক, হ্যারল্ড'। অস্ট্রেলিয়ায় আমাকে পাঠানো এমসিসি'র ক্যাবলগুলোর কথা মনে পড়ল আমার। তিনটি ক্যাবলেরই নিচে ছিল মেরিলিবোর্নের স্বাক্ষর। প্রথম টেস্ট চলাকালীন সিডনির হোটেল অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো প্রথম ক্যাবলটি ছিল: 'ওয়েল বোলড, নটস্।' ব্রিসবেন টেস্টের পর দ্বিতীয়টি ছিল : ওয়েল বোলড্, কনগ্রাচুলেশনস্। শেষ টেস্টের সময় শেষ হয়েছিল 'ব্র্যাভো' দিয়ে।"
কোনো অপরাধ না করেও ক্ষমা চাওয়ার চাইতে টেস্ট ক্রিকেটকে বিসর্জন দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন লারউড। এরপরও ক্ষমা চাইবার কোনো তাগিদ বোধ করেননি কোনোদিন। কারণ যাদের সঙ্গে ছিল মাঠের শত্রুতা, তাঁরাই যে সে সবকে ‘খেলার অংশ' ভেবে আপন করে নিয়েছিলেন তাঁকে। ১৯৫০ সালে স্ত্রী ও পাঁচ কন্যা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান লারউড, সেই 'ওটারান্টো' জাহাজে চড়েই। সিডনিতে পৌঁছার পর যাঁরা স্বাগত জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম জ্যাক ফিঙ্গলটন, বডিলাইন সিরিজে লারউডের প্রতিপক্ষ এবং পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়নি, তবে শত্রুতা আর ছিল না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যে ছিলই।বডিলাইন সিরিজ নিয়ে যে ব্র্যাডম্যানকে 'ভীতু' বলেছেন, তাঁকে নিয়েই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'লোকে বলে, বল হাতে আমি নাকি এক খুনী। কিন্তু ওরা এটা মনেই রাখে না, ব্যাট হাতে ব্র্যাডম্যান হলো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো খুনী।'
১৪ বছর বয়স থেকে তিন বছর কয়লার খনিতে কাজ করা যে কিশোরটিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল ক্রিকেট, তাঁর কাছে ক্রিকেট শুধু খেলা ছিল না, তা ছিল জীবনেরই একটা অংশ। ১৭ বছর বয়সে জো হার্ডস্টাফ নটিংহ্যামশায়ারের ট্রায়ালে নিয়ে গিয়ে কয়লার খনির অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দেন লারউডকে। এরপরের গল্প নানকারগেট গ্রামে জন্ম নেয়া এক হাড় লিকলিকে কিশোরের বিশ্বে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ বোলার হয়ে ওঠার এক রোমাঞ্চময় কাহিনি।
আত্মজীবনীতে সেই কাহিনি তো আছেই। এর বাইরে আত্মজীবনীর অনেকটা জুড়ে রয়েছে এমসিসি’র প্রতি তাঁর ক্ষোভ। তবে নিজে কোনোদিনই অন্যায় কিছু করেছেন ভেবে অনুতাপে ভোগেননি। নিয়মের বাইরে কিছু করেননি এবং ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কের নির্দেশ মানতেই হবে, তাই মেনেছেন—এই বিশ্বাস আমৃত্যু মাথা উঁচু করে চলার সাহস দিয়েছে তাঁকে। লারউড কখনোই ক্ষমা চাননি। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় সংস্করণের শেষটাও হয়েছিল মাথা না নোয়ানোর এই গর্ব দিয়ে। তাঁর হতাশা, ক্ষোভ—এসব জানানোর পর লারউড বলেছেন, 'বডিলাইনের ৫০ বছর পর এ সংক্রান্ত কোনো কিছুই আর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। শুধু একটি জিনিস ছাড়া। আমি এখনও খুব পরিতৃপ্ত যে, আমি কখনো ক্ষমা চাইনি।'
লারউড ক্ষমা চাননি। কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাধর এক বোলার, যাঁকে সমসাময়িক অন্য অনেক ক্রিকেটারই মনে করেন সর্বকালের দ্রুততম, তাঁকে ব্যবহার করার পর মানবিক আবেগ-বিবর্জিত রক্তপিপাসু এক বোলার হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা যারা করেছিলেন, তাদেরই উল্টো লারউডের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।
হ্যাঁ, ক্ষমা চাওয়া হয়েছিল। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে পাওয়া এমবিএ খেতাবটাই ছিল লারউডের কাছে সেই ক্ষমা প্রার্থনা। আপনি কি ক্ষমা করেছিলেন, হ্যারল্ড লারউড?
আরও পড়ুন:
বডিলাইনের 'নায়ক' লারউডের গ্রামে