বারবাডোজ যেখানে আলাদা
উৎপল শুভ্র
১৬ মে ২০২১
২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরের ডায়েরি, কিন্তু এখনো যা পড়লে নতুনই মনে হয়। পড়তে পড়তে আমার মন যেমন ক্যারাবিয়ানের এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়, আপনাকেও তা নিয়ে যাবে পৃথিবীর উল্টো দিকের একেবারেই ভিন্ন এক জগতে। এই পর্বে থাকছে `ক্যারাবিয়ানের প্রবেশদ্বার` বলে পরিচিত বারবাডোজের কথা। ছোট্ট একটা দ্বীপরাষ্ট্র, কিন্তু অনেক দিক থেকেই যা অনন্য।
প্রথম প্রকাশ: ৬ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।
অর্থনৈতিক এই মন্দার সময় সবাইকে এটা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো যে পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিসগুলো আমরা এখনো ফ্রি-ই পাই। চাঁদ সবার জন্যই ওঠে। পরিষ্কার নীল আকাশ থেকে চাঁদের আলো যখন সাগরের বুকে পড়ে; আহা, কী সুন্দরই না দেখায়!
বাণীটা কেমন লাগল? ভালো লাগলে বলে ফেলুন। আমি ভাব নিয়ে ফেলব, সেই ভয় নেই। কারণ কথাটা আমার নয়। বারবাডোজের যেকোনো হোটেল, গেস্ট হাউস, এক কথায় যেকোনো অতিথিশালার রুমে রুমে ‘ইনস অ্যান্ড আউটস অব বারবাডোজ' নামে আর্ট পেপারে সুমুদ্রিত ৩৮৪ পৃষ্ঠার যে বইটি পাবেনই, তা থেকে তুলে দিয়েছি কথাটা।
এটি অবশ্যই বারবাডোজের মাহাত্ম্য বোঝাতে। এমন নীল আকাশ, নীল সাগর, রুপালি সৈকত যে বিশ্বের আর কোথাও নেই এবং বারবাডোজ তা ফ্রি-ই পেয়েছে। আমোদপ্রিয় শিথিল সামাজিক সংস্কারের বাজানরা আবার খুবই ধর্মপ্রাণ । ঈশ্বর যে তাদের দুহাত ভরে দিয়েছেন, এই কৃতজ্ঞতা সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেয় তারা।
গত পরশু রাতে এক বাজানের মুখে বারবাডোজের আরেকটি যে সম্পদের কথা শুনলাম, সেটিও ফ্রি-ই। মানুষ! ‘ত্রিনিদাদের তেল আছে, জ্যামাইকারও অনেক খনিজ সম্পদ, বারবাডোজের এসব কিছুই নেই। তবে আমাদের সম্পদ হলো মানুষ'–বললেন কেএফসিতে খেতে গিয়ে পরিচয় হওয়া দার্শনিক চেহারার তরুণ। সেটি কীভাবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যাখ্যা দাবি করা হলো। উত্তর যা পাওয়া গেল, তা এ রকম বারবাডোজের প্রায় ১০০ ভাগ মানুষই শিক্ষিত। উচ্চ শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ ইংল্যান্ড-আমেরিকায় খুব ভালো চাকরি করেন। নাড়ির টানে যাঁদের সবাই কোনো না কোনোভাবে বারবাডোজের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন।
১ মার্কিন ডলার = ৭০ টাকা এমন এক দেশ থেকে বারবাডোজে এলে অবশ্য মনে হতে বাধ্য, কাজটা খারাপই হয়! বারবাডোজের অর্থনীতি এমন চাঙা বলেই তো এখানে সবকিছু এমন অগ্নিমূল্য। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হিসেবে লন্ডনের নামই বেশি শুনি। পাউন্ডের সঙ্গে টাকার বিনিময়মূল্যর কারণে আমাদের কাছে সেটি আরও বেশি সত্যি। কিন্তু বারবাডোজকে যে কখনো কখনো লন্ডনেরও বাবা বলে মনে হয়।
কোকোনাট কোর্ট নামে যে হোটেলে আছি, সেখান থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরের কেনসিংটন ওভালে যেতেই ট্যাক্সিভাড়া গুনতে হয় ৩৫ ডলার! ও হ্যা, এটা বারবাডোজ ডলার, কিন্তু এক মার্কিন ডলারে সেটিও যে দুটির বেশি মেলে না। প্রথম দিন এসে কোকোনাট কোর্টেই ফিশ অ্যান্ড চিপস খেলাম। কত লাগল, জানেন? মাত্র ৫৫ বারবাডোজ ডলার, টিপস দেওয়াটা এখানে অবশ্যপালনীয় ভদ্রতা বলে আরও ৫ ডলার যোগ হলো।
এক টুকরো মাছ আর কয়েক চিলতে আলু ভাজির দাম ২১০০ টাকা পড়ল হিসাব করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, বিকেল-বিকেল খেয়েছি, রাতে আর না খেলেও চলবে। কিন্তু শরীর কি মনের কথা মেনে চলে! ক্ষুধার কী দায় পড়েছে তুমি বাংলাদেশে আছো না বারবাডোজে আছো বোঝার! রাতেও তাই খেতে হলো। এবার বাইরে খেলাম বলে একটু কম পড়ল। সেই কমও তো বাংলাদেশের প্রায় ১৬০০ টাকা।
বারবাডোজ নিয়ে ডায়েরিতে কী লিখছি, নিয়মিতই জানতে চান হ্যারল্ড ইস্টমন্ড। ওই যে বিমানবন্দর থেকে আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়েছিলেন যে ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক। আজকের বিষয়টা তাঁর খুব একটা ভালো লাগল বলে মনে হলো না। ‘আরে, তুমি তো আমাদের ট্যুরিজমের বড় ক্ষতি করে দেবে। তুমি এসব লিখলে বাংলাদেশ থেকে আর কেউ বারবাডোজে আসবে না'– বলার পর মুদ্রার যে অন্য পিঠও আছে, সেটি বোঝাতে শুরু করলেন। বারবাডোজে ক্যারাবিয়ানের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, বাসে যেখানেই যাও, ভাড়া এক বারবাডোজ ডলার। হোটেলে না খেয়ে বাইরে খেলে অনেক কম লাগে ইত্যাদি জানিয়ে এক ধরনের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, এসবও যেন অবশ্যই লিখি। লিখব বলে কথা দিয়ে আমি বললাম, এটাও লিখব যে, আমার হোটেল থেকে দুই কিলোমিটার দূরের কেনসিংটন ওভালে যেতে দুবার বাস বদলাতে হয়, তারপরও হাঁটতে হয় মিনিট দশেক।
বাংলাদেশের বড়লোকেরা ইউরোপ-আমেরিকায় বেড়াতে যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসার কথা তো শুনি না। হ্যারল্ড ইস্টমন্ডও তাঁর ৪৫ বছরের জীবনে বারবাডোজে কোনো বাংলাদেশি পর্যটকের দেখা পাননি। তারপরও আমি ডায়েরিতে কী লিখলাম না লিখলাম, তা নিয়ে এমন উদ্বেগ থেকেই বুঝে নিন, পর্যটন এ দেশের জন্য কী! বারবাডোজের অর্থনীতির প্রাণভোমরাই পর্যটন এবং সেটি যে নীল সাগর-রুপালি বালির সৈকতের কল্যাণে, তা তো ফ্রি-ই পেয়েছে ওরা। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা তো জানানোই উচিত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপে ম্বীপে রেষারেষির কথা লিখেছিলাম। তবে বারবাডোজের সমুদ্র সৈকতের শ্রেষ্ঠত্বটা মোটামুটি তর্কাতীত। অ্যান্টিগায় ৩৬৫টি বিচ আছে, ওদের পর্যটন বিভাগ তাই বিজ্ঞাপন করে বছরের ৩৬৫ দিনের জন্য ৩৬৫টি বিচ! তবে তারপরও সৈকতের মোহনীয়তায় বারবাডোজ কেন এগিয়ে, সেটির ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেন ইস্টমন্ড। ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে একমাত্র বারবাডোজই প্রবাল দ্বীপ, বাকি সব কটির জন্ম আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে। সাগরের রং আর বালির শুভ্রতায় প্রবাল দ্বীপ তো একটু এগিয়েই থাকবে।
প্রতিদিন সকালে আমার হোটেলের বারান্দা থেকেই এর প্রমাণ পাই। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় দাঁড়াই। হাতছানি দেয় নীল সাগর-রুপালি সৈকত আর পেতে রাখা ডেক চেয়ারগুলো। কিন্তু কোনোমতে লেখা শেষ করে মাঠে দৌড়াতে হয় বলেই সেই ডাকে আর সাড়া দেওয়া হয় না। পরশু মাঠ থেকে রুমে ফিরে হোটেল কর্তৃপক্ষের পাঠানো চিঠি পেলাম আশা করি, আপনার ছুটি ভালো কাটছে। পড়ে মেজাজ খারাপ হয়। ছুটি? এটাকে বলে ছুটি?
ক্রিকেটের ওপর রাগ হয়। সকালে উঠেই মাঠে, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তিন দিনের অর্থহীন এক ক্রিকেট ম্যাচের কারণেই তো ওই ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে নীল সাগর দেখার শখটা অপূর্ণ থেকে গেল। ভাবি এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেই নিজের কান মলে দিই। ওরে অকৃতজ্ঞ, ক্রিকেট না হলে জীবনেও তোর বারবাডোজ আসা হতো রে?
৬ জুলাই ২০০৯। বারবাডোজ।
আরও পড়ুন:
ক্যারিবীয় কড়চা-১: আজি আঁখি জুড়াইল...
ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত