‘আজি আঁখি জুড়াইল...’

উৎপল শুভ্র

১৪ মে ২০২১

‘আজি আঁখি জুড়াইল...’

২০০৯ সালে বাংলাদেশ দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর কাভার করতে যাওয়ার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম, ট্যুর ডায়েরিটা এবার নিয়মিত লিখব। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে অনেকগুলো দ্বীপরাষ্ট্রে খেলা, একেকটার একেক চরিত্র। সেই দ্বীপ, দ্বীপের মানুষ, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে এই ক্যারিবীয় কড়চা। সশরীরে না গিয়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে আসার এক বাহন।

প্রথম প্রকাশ: ৪ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

আদিগন্ত নীল সাগর, রোদে ঝিকমিক করছে রুপালি বালির সৈকত, সেটিতে দাঁড়িয়ে মাথা দুলিয়ে গান গাইছে নারকেল গাছের সারি...ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন একটা ছবিই আঁকা হয়ে আছে সবার মনে।

তাই বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পুরোটাই তো সাগর বা সৈকত নয়। ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট আছে, গগনচুম্বী না হলেও আছে বহুতল ভবনও। তবে শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে তো ওটাই। ওই সাগর, ওই রুপালি সৈকত, নারকেল গাছের সারি...

ক্যারিবীয় সাগরের বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য দ্বীপ, মানচিত্রে যেগুলোকে দেখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তোর মতো। সেই সব দ্বীপ, বলা ভালো দ্বীপরাষ্ট্র মিলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। খোলা সাগরে ঘুরতে ঘুরতে এই দ্বীপপুঞ্জের দেখা পেয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কেন যেন মনে হয়েছিল এটা ইন্ডিয়াই হবে, সে থেকেই উৎপত্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের। ক্রিকেট ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে যেটির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখানকার লোকজন এক কথায় বলে—ক্যারাবিয়ান। জাতি বোঝাতেও ক্যারাবিয়ান, অঞ্চল বোঝাতেও। আমরা ক্যারিবিয়ান বলে অভ্যস্ত, তা-ই না হয় বললাম, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে যখন লিখছি, ওদের মতো ক্যারারিয়ানই চলুক আপাতত।

সেই ক্যারাবিয়ানের প্রবেশদ্বার এই বারবাডোজ। ইংল্যান্ড-আমেরিকা থেকে জ্যামাইকাতে সরাসরি উড়ান আছে, ত্রিনিদাদেও থাকলে থাকতে পারে। এর বাইরে আপনি ক্যারাবিয়ানের যে দেশেই যেতে চান না কেন, নামতে হবে বারবাডোজের গ্র্যান্টলি অ্যাডামস বিমানবন্দরে। বারবাডোজের পর্যটন বিভাগ তাই স্লোগানই বানিয়ে ফেলেছে— বারবাডোজ, দ্য গেটওয়ে টু দ্য ক্যারাবিয়ান।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা সব কটি দ্বীপ একসঙ্গে খেলে। কীভাবে খেলে, সেটি একটা রহস্যই। দ্বীপে দ্বীপে এমন রেষারেষি যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে এক পতাকার নিচে খেলাটাকে মহা আশ্চর্যই মনে হয়। ক্রিকেটই এখানে একমাত্র বিনি সুতোর মালা। যেকোনো দ্বীপে পা রাখলেই সেখানকার লোকজন প্রথম সুযোগেই আপনাকে জানিয়ে দেবে, ক্যারিবিয়ানে একেকটা দ্বীপ একেক রকম, তবে তাঁর দ্বীপটাই সেরা। গত পরশু গ্র্যান্টলি অ্যাডামস বিমান-বন্দরের অভিবাসন ডেস্কের তরুণীও যেমন এই সফরে কোথায় কোথায় যাব শোনার পর (কপট) হতাশায় মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘বারবাডোজেই তো তুমি দেখি সবচেয়ে কম সময় থাকছ! সেন্ট ভিনসেন্ট-গ্রেনাডা-ডমিনিকা-সেন্ট কিটসও সুন্দর, কিন্তু বারবাডোজের মতো নয়।’

ক্যারাবিয়ানের বেশির ভাগ দেশই যেখানে ছোট-বড় দ্বীপ মিলিয়ে আসলে দ্বীপপুঞ্জ, বারবাডোজ তা নয়। দৈর্ঘ্যে ২০ মাইল, প্রশস্ততম অংশে এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত মাত্র ১৪ মাইল—ছোট্ট একটা দ্বীপ। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বাংলাদেশের সর্বশেষ সফরে হওয়া পরিচয় ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় আরও গাঢ় হওয়ার সুবাদে বারবাডোজের ফ্রি ল্যান্স ক্রিকেট লেখক হ্যারল্ড ইস্টমন্ড প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিমানবন্দর থেকে তাঁর গাড়িতে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। একাকী দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর পরিচিত সেই মুখটাই যে কী আনন্দ দিল, তা লিখে বোঝানোর নয়। মানুষ যদিও বিরহকামী, শেষপর্যন্ত কি তাহলে মিলনই মৌলিক? আবুল হাসান ঠিকই লিখেছেন!

হোটেলে আসার পথে বারবাডোজ প্রসঙ্গে ‘পুঁচকে’ শব্দটা ব্যবহার করায় ইস্টমন্ডের তীব্র আপত্তি, ‘যতটা ছোট ভাবছ অতটা নয়। এখান থেকে বারবাডোজের দূরতম প্রান্তে যেতে গাড়িতে দুই ঘণ্টা লাগে।’ আমি হাসলাম, তাহলে তো বারবাডোজ বড়ই! ইস্টমন্ডের কৌতূহলের জবাব দিতে হাসির কারণটা খুলে বলায় চারদিক সচকিত করে তোলা বিখ্যাত সেই ক্যারাবিয়ান হাসি। ‘আমি কখনো বাংলাদেশে যাইনি। একবার গিয়ে দেখব, বাংলাদেশ কত বড়!’ আমি হেসে বললাম, ‘ঢাকা শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতেই তো দু ঘণ্টার বেশি লাগে।’ আসল কারণটা যে যানজট, সেটি আর বললাম না। অন্তত একটি ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকি না!

 কোকোনাট কোর্ট হোটেল ও রিসোর্টে চেক ইন করে রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি এই দৃশ্য। ত্রিশ ঘণ্টার ভ্রমণক্লান্তি নিমেষেই উধাও। ছবি: পিন্টারেস্ট

বাংলাদেশ দলের হোটেল এবং তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচের ভেন্যু কেনসিংটন ওভালের সঙ্গে নৈকট্য বিবেচনায় ব্রিজটাউনের ঠিকানা হিসেবে কোকোনাট কোর্ট হোটেল অ্যান্ড রিসর্টকে আগেই পছন্দ করে রেখেছিলাম। রুমে ঢুকে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই আবারও টের পেলাম সাগরের অসীম ক্ষমতা। নীল সমুদ্র সাদা ফেনা হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ছে রুপালি সৈকতে। নারকেলগাছ তো আছেই, ঝাঁকড়াচুলো অন্য কী সব গাছও। আমার রুমের বারান্দা আর সৈকতের মাঝখানে শুধু সুইমিং পুল, সেটি আরও বেশি নীল। ঢাকার বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে বেরোনোর সময় থেকে হোটেল রুমে ঢোকা পর্যন্ত ত্রিশ ঘণ্টার ভ্রমণক্লান্তি নিমেষেই উধাও!

তবে উল্টো অনুভূতিটাও হলো। সৈকতে পেতে রাখা ডেক চেয়ারে এলিয়ে থাকা ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত পুরুষ আর সংক্ষিপ্ততম পোশাকের নারী ফিরিয়ে আনল ওয়েস্ট ইন্ডিজে কাজ নিয়ে আসার সেই বেসুরো অনুভূতিটা। এখানকার আকাশে-বাতাসে যে সব সময়ই নিরুচ্চারে অনুরণিত হচ্ছে—‘আজ কোনো কাজ নেই, আজ আমাদের ছুটি’র সুর। অথচ বাংলাদেশের সাংবাদিকের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষার জায়গা হলো এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কেন?

কারণটা কাল ব্যাখ্যা করি! এখনই যে মাঠে ছুটতে হবে। এই সফরে বাংলাদেশের একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচটি শুরু হলো বলে!

৩ জুলাই, বারবাডোজ।

আরও পড়ুন: ক্যারিবীয় কড়চা-২: এখানে সন্ধ্যা, ওখানে প্রভাত

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×