যাওয়ার আগে ডেভ হোয়াটমোর
উৎপল শুভ্র
২৯ এপ্রিল ২০২১
যখন এসেছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন ঘোর দুঃসময়। চার বছর পর যখন চলে গেলেন, একেবারে আলোয় উদ্ভাসিত না হলেও উন্নতির গ্রাফটা স্পষ্টই ঊর্ধ্বমুখী। ডেভ হোয়াটমোরের চার বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস একটু অন্য রকমভাবেই মনে রাখবে। হোয়াটমোরের আরও অনেক ‘প্রথম’-এর মতো এটাও আরেকটি প্রথম যে, এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেট কোচ ভালোভাবে বিদায় নিতে পারলেন। বিদায় নেওয়ার আগের দিন উৎপল শুভ্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে তাঁর চার বছরের অভিজ্ঞতা, এ দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে ভবিষ্যৎ করণীয় ছাড়াও এমন অনেক কথা বলেছেন, যা তিনি আগে কখনো বলেননি।
প্রথম প্রকাশ: ৩ জুন ২০০৭। প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: বাংলাদেশ-অধ্যায় তাহলে শেষ! বাংলাদেশে কাটানো চার বছরের দিকে ফিরে তাকিয়ে আপনার কী মনে হয়? বিদায়বেলার অনুভূতিটাও যদি বলেন।
ডেভ হোয়াটমোর: একটু তো খালি-খালি লাগছেই। চার বছর কম সময় নয়। এই চার বছর আমি এখানেই, এই একই ফ্ল্যাটে ছিলাম। যেকোনো সফর থেকে ফিরলে পরিচিত আবহ বলে নিজের বাড়িতে ফেরার মতো একটা অনুভূতি হতো। এত দিনের অভ্যস্ততা, কিছু ব্যাপার তো মিস করবই।
চার বছরের দিকে ফিরে তাকালে অনেক কথাই মনে পড়ে। যেটি আমার মূল কাজ ছিল, সেই ক্রিকেট নিয়ে আগে বলি। কিছুটা হলেও সফল হয়েছি, এটা বলা বোধ হয় বাড়াবাড়ি হবে না। যদিও টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতিটা হচ্ছে খুব ধীরে। তুলনায় ওয়ানডে দল অনেক ভালো করছে। এ ধরনের ক্রিকেট অনেক বেশি খেলা হয় বলে এতে উন্নতি করাটা সহজ। টেস্ট ক্রিকেটে তা নয়। তবে এর মধ্যেও আমরা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু টেস্ট ম্যাচ খেলেছি। একটি টেস্ট জিতেছি। তবে জয়ের চেয়েও এর পরই বিএনএসে যে টেস্টটি আমরা বাঁচিয়েছি, সেটিকে বলব আরও বেশি কৃতিত্বপূর্ণ।
শুভ্র:: চার বছর আগে প্রথম যেদিন বাংলাদেশে এলেন, সেদিনের স্মৃতি মনে পড়ে?
হোয়াটমোর: মনে আছে, আমার স্ত্রী ক্যাথরিন আমার সঙ্গে ছিল। ও এসেছিল সবকিছু গুছিয়ে-টুছিয়ে দিতে। প্রথম দিনের কথা ভাবলে প্রথমেই মনে পড়ে, কী ভালোবাসায় আমাকে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। এখানে পুরো চার বছরই আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। আসলে আমি যেমন সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারি, আমার সঙ্গেও বোধ হয় মানিয়ে নেওয়া সহজ।
শুভ্র: বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার সময় নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলেন। যাওয়ার সময় কি বলতে পারেন, ‘মিশন সুসম্পন্ন’?
হোয়াটমোর: আমার মনে হয় না কোনো কোচই এভাবে বলতে পারেন যে, ‘মিশন সুসম্পন্ন’। হ্যাঁ, মনে মনে একটা লক্ষ্য তো ছিলই। তবে অপরিচিত একটা জায়গায় আগে থেকেই কোনো ধারণা করে কাজ করা কঠিন। এখানে আসার পর আমাকে অনেক কিছু জানতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে।
খেলোয়াড়দের মান কেমন, কারা বাংলাদেশের পক্ষে খেলার যোগ্য, ভবিষ্যতে কাদের খেলার সামর্থ্য আছে—এসব বুঝতে সময় লাগে। নির্বাচক কমিটি অপরিবর্তিত থাকাটা ছিল একটা বড় সুবিধা। একটা ক্রিকেট দলে কী চাই, সে ব্যাপারে আমি সব সময়ই পরিষ্কার ছিলাম। কখনো তা পেয়েছি, কখনো নয়। কখনোবা যে ফরমেশনে খেলতে চেয়েছি, সে অনুযায়ী খেলোয়াড় পাইনি। তবে শুরু থেকেই একটা তাড়না আমার সঙ্গী ছিল, জিততে হবে।
শুভ্র: সেই জয় আসছিল না বলে আপনাকে যেমন অধৈর্য দেখেছি, তাতে অনুমান করি, কাজটা কত কঠিন, আপনি তা বুঝতে পারেননি।
হোয়াটমোর: আসলেই তা-ই। শুরুর দিকে আমি বড় বেশি অধৈর্য ছিলাম। মরিয়া ছিলাম একটা জয় পাওয়ার জন্য। সব দল জিতছে, আর বাংলাদেশ জয় পাবে না—এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হতো। সেই জয়ের জন্য কম দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
শুভ্র: ওই সময়টা নিশ্চয়ই খুব যন্ত্রণায় কেটেছে। কোচ তো ওই যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার মতো কাউকেও পায় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের কোচের জীবন তো খুব নিঃসঙ্গ
হোয়াটমোর: কোচের জীবন শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব ক্লান্তিকর। একজন ক্রিকেট কোচের ম্যাচ শেষ বল হয়ে যাওয়ার পরই শেষ হয়ে যায় না, খেলোয়াড়দের সঙ্গে এটাই বড় পার্থক্য। খেলোয়াড়দেরও নানা রকম উদ্বেগ থাকে, দুশ্চিন্তা থাকে। তবে সেটা কোচের মতো নয়। কোচের জীবনটা খুব কঠিন। বেশির ভাগ সময় ফোনের ওপর নির্ভর করে বাঁচা। অনেক সময় ফোন লাইন ভালো থাকে না। হয়তো আপনজন কেউ ফোন করল বা নিজেই ফোন করলাম, দেখা গেল কেউ কারও কথা বুঝতে পারছি না। ওই সময়গুলো আরও কঠিন হয়ে যায়। আমার ভাগ্য ভালো, সব সময়ই আমার পরিবার আমাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
শুভ্র: কখনো কি মনে হয় না, অনেক হয়েছে আর নয়? এবার নিঃসঙ্গ এই জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই!
হোয়াটমোর: কখনো কখনো তো মনে হয়ই। কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আবার ক্রিকেট, তখন আর অত খারাপ লাগে না। জীবনটা কঠিন, কিন্তু এই কাজের এটাই নিয়ম।
শুভ্র: অর্থ-খ্যাতি এসব তো আছেই। তবে খেলাটির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা না থাকলে বোধ হয় বেশিদিন এই কাজ করে যাওয়া সম্ভব নয়।
হোয়াটমোর: ঠিক ধরেছেন। কোচিংয়ে টাকা-পয়সা ভালোই। সেটি যে গুরুত্বপূর্ণ, তাও অস্বীকার করছি না। তবে এটিই একমাত্র প্রেরণা নয়। শুধু টাকার কথা ভেবে কেউ এই পেশায় এলে সে বেশিদিন টিকতে পারবে না। নিয়োগদাতা, খেলোয়াড় সবাই সহজেই বুঝে ফেলবে এই লোক শুধু টাকার জন্যই কাজ করছে। কোচিংয়ের আসল প্রেরণা হলো, এক দল খেলোয়াড়কে আরও ভালো খেলতে দেখা। দল আগের চেয়ে ভালো করলে, জিতলে খেলোয়াড়দের মুখে খেলা করা জয়ের আনন্দটাই একজন কোচের জন্য সবচেয়ে পরিতৃপ্তি। কোনো খেলোয়াড়কে ভালো করতে দেখার যে আনন্দ, সেটিই আসলে এই পর্যায়ে কোচিংয়ের আসল পাওয়া।
শুভ্র: আপনি সব সময়ই বাংলাদেশে ক্রিকেট-প্রতিভার ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। যাওয়ার বেলায় সত্যিটা বলে যান তো, এটা কি সত্যিই বিশ্বাস থেকে বলা, নাকি মন ভোলানো কথা?
হোয়াটমোর: আমি যা বলেছি, তা বিশ্বাস থেকেই বলেছি। তবে প্রতিভা প্রসঙ্গে আমি বলব, বিশ্বের সব জায়গায়ই প্রতিভা প্রায় একই রকম। উপমহাদেশের খেলোয়াড়দের হয়তো একটু পেলব কব্জি, শর্ট বলে হয়তো ওরা অতটা ভালো না। এমন কিছু পার্থক্য আছে। তবে সহজাত প্রতিভা বিশ্বের সব জায়গায় একই রকম। এর একটা বড় কারণ হলো টেলিভিশন। এখন যেটা হয়, টেলিভিশনে ভালো খেলোয়াড়দের খেলা দেখে কিশোর-তরুণরা তা কপি করার চেষ্টা করে। এদিক থেকে চিন্তা করলে টেকনিক্যাল ব্যাপার-স্যাপারের অ আ ক খ শেখানোর জন্য এখন আর কোচের প্রয়োজন হয় না। শুধু একটু ফাইন টিউনিংই হয়তো লাগে।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, বিশ্বজুড়ে শিশু-কিশোরদের প্রতিভা মোটামুটি একই রকম। সেই প্রতিভা বিকাশে কী করা হচ্ছে, সেটিই আসলে পার্থক্য গড়ে দেয়। হার্ডওয়্যার একই রকম, পার্থক্য সফটওয়্যারে। উপমহাদেশের তুলনায় পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রিকেটাররা একটু বেশি আগে পরিণত হয়, মানসিকভাবে বেশি শক্ত হয়।
শুভ্র: এর একটা কারণ হয়তো ওই সব দেশে তরুণরা অনেক আগে স্বাবলম্বী হতে শেখে। মাঠের বাইরেও নিজের সিদ্ধান্তটা তাঁদের নিজেদেরই নিতে হয়।
হোয়াটমোর: এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হলো, ওসব দেশে ঘরোয়া ক্রিকেট অনেক বেশি শক্তিশালী। এখানে (বাংলাদেশে) যেমন ক্লাবভিত্তিক কোনো ইয়ুথ ক্রিকেট নেই বললেই চলে। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় শনিবার সকালে বয়সভিত্তিক ক্লাব ক্রিকেটের মেলা বসে যায়। সেখানে যে ক্রিকেটটা হয়, সেটাও খুব কঠিন। অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে আমার প্রথম ম্যাচটির কথা এখনো মনে পড়ে, প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে বড় সব ফাস্ট বোলারকে খেলাটা কেমন ভীতিকর ছিল! আমার বয়স তখন ১১, ব্যাট করছিলাম ১০ নম্বরে। তখন অনূর্ধ্ব-১৪ দিয়ে শুরু করতে হতো। এখন তো অনূর্ধ্ব-১২, অনূর্ধ্ব-১০ টুর্নামেন্টও আছে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের আগে আছে অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ প্রতিযোগিতাও। এসব দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। এসবে খেলতে খেলতে কিশোর-তরুণরা খুব তাড়াতাড়ি পরিণত হতে পারে। আমি যা বলছি, সেটি শুধু ভিক্টোরিয়ার একটি কাউন্সিলের কথা। অস্ট্রেলিয়ার কথা বাদ দিন, এক মেলবোর্নেও যে কত খেলা হয়, তার কোনো হিসাব নেই।
শুভ্র: বিশ্বকাপের সময় ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সাধারণ ক্রিকেটজ্ঞান নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণও দিয়েছেন দেখলাম। উইকেটের আড়াআড়ি বল করা কোনো বাঁহাতি পেসারকে যে পুল করাটা বিপজ্জনক, এই মৌলিক ব্যাপারটাও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বোঝে না।
হোয়াটমোর: হ্যাঁ, ক্রিকেটের মৌলিক কিছু বিষয়েও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অজ্ঞতা রীতিমতো বিস্ময়কর। উদাহরণ দিলে আরও দেওয়া যায়। তবে তা না বলাই ভালো। কারণ সিনিয়র খেলোয়াড়দেরও এমন সব ঘটনা আছে, যা ওদের জন্য খুব বিব্রতকর হবে।
শুভ্র: সুনির্দিষ্ট দু-একটা উদাহরণ দিন না!
হোয়াটমোর: না, আমি তা দেব না। কারণ এসব খুব বিব্রতকর। তবে এটা বলি, ক্রিকেটের মৌলিক কিছু বিষয় আছে, যা এই পর্যায়ে এসে শেখার নয়। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট, ঠিকমতো ‘কল’ করা, ক্লোজ-ইনে ফিল্ডিং করার সময় ব্যাট না দেখে ব্যাটসম্যানের পায়ের দিকে লক্ষ্য রাখা—এসব তো ছোটবেলাতেই শেখার কথা। আমি মনে করি, এই পর্যায়ে এসে খেলোয়াড়দের মাঠে তাৎক্ষণিক চিন্তা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। অধিনায়ক ও কোচের মুখ চেয়ে থাকলে চলবে না, মাঠে সবাইকে অধিনায়কের মতো চিন্তা করতে হবে। ম্যাচের গতিপ্রকৃতি, চারপাশে কী হচ্ছে—সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এই জায়গাটাতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বড় ঘাটতি আছে।
শুভ্র: বাংলাদেশের কোচ হিসেবে হতাশার অভিজ্ঞতা তো অনেকই হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রাখবেন কোনটিকে? সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ী মুহূর্তই বা কোনটি?
হোয়াটমোর: সবচেয়ে তৃপ্তির মুহূর্ত অবশ্যই জয়গুলো। বড় দলের বিপক্ষে সব কটি জয়ই ছিল খুব তৃপ্তিদায়ী। সবকিছুর আগে অবশ্য বিশ্বকাপই আসবে। আমাদের গ্রুপটাকে সবাই বলছিল ‘গ্রুপ অব ডেথ’, বলাবলি হচ্ছিল এই গ্রুপে আপসেট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব কথাবার্তা সব সময়ই বাড়তি একটা চাপ সৃষ্টি করে। সেটা সামলে ভারতকে হারানোটা ছিল দারুণ ব্যাপার। এটাকে আমি বিরাট এক অর্জন বলব।
শুভ্র: আর সবচেয়ে হতাশাজনক মুহূর্ত?
হোয়াটমোর: পাকিস্তানের কাছে মুলতানে হারাটা। এটা মেনে নেওয়া ছিল খুব কঠিন। ওই ম্যাচে জিততে যা করতে হতো, আমরা প্রায় তার সবই করেছিলাম। ম্যাচটা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এমন একটা অনুভূতি হয়েছিল। হ্যাঁ, ইনজামাম দারুণ এক ইনিংস খেলেছিল। অন্য কিছু বিষয়ও (আম্পায়ারিং) আমাদের পক্ষে যায়নি। তারপরও ওই টেস্টটা আমাদের জেতা উচিত ছিল। সে সময়ে ওই টেস্টটা জিতলে তা হতো দারুণ ব্যাপার। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে তা বড় একটা ধাপ হতো।
শুভ্র: বাংলাদেশের ক্রিকেটে সামনের সময়টা তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক পরিবর্তন হচ্ছে—নতুন কোচ, নতুন অধিনায়ক। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
হোয়াটমোর: হ্যাঁ, বেশ কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন হেড কোচ, নতুন ওয়ানডে অধিনায়ক... এদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমার মনে হয়, ওয়ানডে দলের আরও উন্নতি করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তবে টেস্ট ম্যাচে ভালো ফলাফলের জন্য অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। এতে অনেক সময় লাগবে। এই সময়টা কমিয়ে আনার একটাই উপায়, ঘরোয়া চার দিনের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মান আরও বাড়ানো। তা করা খুব কঠিন বলেও মনে করি না আমি। কারণ বাংলাদেশে দারুণ কিছু মাঠ আছে। বরিশাল আর সিলেটের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই, তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া সব অঞ্চলেই ভালো মাঠ আছে। খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে এই টুর্নামেন্টে আরও টাকা ঢালতে হবে, যাতে সবাই এটিতে খেলার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে। এখন তো সিনিয়র খেলোয়াড়রা পারতপক্ষে এতে খেলতেই চায় না। কেন চায় না, সেটিও আমি বুঝি। চার দিনের টুর্নামেন্টটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। তা নেওয়া হলে বাংলাদেশের টেস্ট পারফরম্যান্সেও এর প্রতিফলন দেখা যাবে।
শুভ্র: বাংলাদেশের ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাস টুর্নামেন্টের আরেকটা বড় সমস্যা হলো, সব বিভাগের খেলোয়াড়রা ঢাকায়ই থাকে। শুধু এই টুর্নামেন্টের সময় ছয় দলে ভাগ হয়ে খেলায় এটি হয়ে যায় আরেকটি ক্লাব প্রতিযোগিতার মতো। খেলোয়াড়দের মধ্যে দলীয় চেতনাবোধ সেভাবে কাজ করে না।
হোয়াটমোর: দলীয় চেতনার কথা বলছেন, আমি তো এখানে ক্লাব ক্রিকেটেও এর কোনো চিহ্ন দেখি না। কে কোন বছর কোন ক্লাবে খেলে, এটা মনে রাখাই তো কঠিন। কারও মধ্যে দলীয় আনুগত্যবোধ বলে কিচ্ছু নেই। সবাই যেন টাকার পেছনে ছুটছে। কেউ যদি তাঁর ক্যারিয়ারের শেষে এসে এমন করে, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুতে টাকার চেয়েও বড় কোনো কারণ থাকতে হবে খেলার।
চার দিনের ক্রিকেটের যে সমস্যার কথা বলছিলেন...হ্যাঁ, আমি জানি বাংলাদেশের ক্রিকেট ঢাকাকেন্দ্রিক। তবে যার যে অঞ্চলে জন্ম, তাকে সেই অঞ্চলের পক্ষেই খেলতে হবে—এই নিয়মটা খুব কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ওয়ানডে প্রতিযোগিতা নিয়েও আমার কথা আছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ওপর বিসিবির কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে, সে ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। টুর্নামেন্টটা ভালো, এতে প্রচুর টাকা আছে, সবই ভালো। কিন্তু এটা আজ খেলা হয় তো কাল বন্ধ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থাকলেই প্রিমিয়ার লিগের খেলা বন্ধ হয়ে যায়, এটা কেন হবে? দ্য গেম মাস্ট গো অন। তথাকথিত তারকা খেলোয়াড়রা নেই বলে লিগ বন্ধ থাকতে পারে না। বিসিবিকে এ ব্যাপারে শক্ত হতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, প্রিমিয়ার লিগ যেন নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয় এবং বিরতি ছাড়াই তা শেষ হতে পারে।
শুভ্র: সমস্যা হলো, প্রিমিয়ার লিগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিকও ক্লাবগুলোই। কোনো কিছু পছন্দ না হলেই ক্লাবগুলো না খেলার হুমকি দেয়।
হোয়াটমোর: ক্লাবের কথা কেন শুনতে হবে? ক্লাব বস, না বিসিবি?
শুভ্র: বিসিবি তো ক্লাবগুলোর কাছে জিম্মি। কথায় কথায় ক্লাবগুলো বলে, ‘আমরা এত টাকা খরচ করে দল গড়ি!’
হোয়াটমোর: তা হলে বিসিবি এটি বাতিল করে দিক। খেলা হতে হবে, খেলোয়াড়দের নিয়মিত খেলার সুযোগ দিতে হবে—এর কোনো বিকল্প নেই।
শুভ্র: হাবিবুল বাশার ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ায় অন্তত ওয়ানডেতে মোহাম্মদ আশরাফুলের অধিনায়ক হওয়াটা একরকম নিশ্চিত। কী মনে হয় আপনার, আশরাফুল কেমন করবে?
হোয়াটমোর: অধিনায়কত্ব করতে করতেই ও শিখবে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সোনারগাঁও ক্রিকেটার্স ও ঢাকা বিভাগের হয়ে অধিনায়কত্বের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভিন্ন ব্যাপার। বাংলাদেশ দলে এখন যারা আছে, তাদের মধ্যে আশরাফুলকে অধিনায়ক করার সিদ্ধান্তটাই যুক্তিযুক্ত। তবে ও যত তাড়াতাড়ি শিখবে, ততই ভালো। দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া বিরাট একটা দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ওকে সচেতন থাকতে হবে।
শুভ্র: মাঠের অধিনায়কত্বের চেয়ে মাঠের বাইরের নেতৃত্বগুণে বোধ হয় আশরাফুলকে আরও বেশি উন্নতি করতে হবে।
হোয়াটমোর: ঠিক বলেছেন। এটা অধিনায়কত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, বেশির ভাগ মানুষই যা বুঝতে পারে না। মাঠে মানুষ যা দেখে, তার বাইরেও অনেক কিছু থাকে। খেলার আগে-পরে অনেক ব্যাপার থাকে। প্রস্তুতি শুরু হওয়ার দিন থেকেই আসলে অধিনায়কের কাজ শুরু হয়ে যায়। আশরাফুলকে সেসব নিয়েও ভাবতে হবে।
শুভ্র: কোচ হিসেবে আপনার চার বছরের প্রায় তিন বছরই তো অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার। হঠাৎ তাঁর ‘স্বর্গ থেকে পতন’কে আপনি কীভাবে দেখছেন?
হোয়াটমোর: ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শেষে ও ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটা ওর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমি সেটিকে সম্মান করি। ওয়ানডে দলে ওকে আর নেওয়া হবে কি না, এটা নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার। তবে টেস্ট ম্যাচে হাবিবুল অবশ্যই আরও বেশ কিছুদিন খেলবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ও অনেক কিছু দিয়েছে, আমি মনে করি সেখানে ওর আরও কিছু দেওয়ার আছে।
শুভ্র: আপনি নিজেও তো নির্বাচক ছিলেন। হাবিবুলকে কি শ্রীলঙ্কা সফরে আপনার ওয়ানডে দলে রাখতেন?
হোয়াটমোর: এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। আমি কাল চলে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে হুট করে একটা কথা বলে গেলাম, এটা ভালো দেখায় না। তবে আমি যতটুকু বুঝি, কোন কারণে হাবিবুলকে ওয়ানডে দলে খেলানো হবে, নির্বাচকদের আগে সেই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। সেটি কি সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য? হাবিবুল নিজেও হয়তো এটা স্বীকার করবে যে, তার তুলনায় তার বদলি কেউ দলে এলে ফিল্ডিংয়ে সে আরও ক্ষিপ্রগতির হবে। ও বোলিংও করে না। ওয়ানডের জন্য এসব পরিষ্কার সীমাবদ্ধতা। তার পরও হাবিবুলকে ওয়ানডে দলে নেওয়া হবে কি না, এটা এখন নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার। যেসব কারণ বললাম, সেসবের জন্য ও ১০-এর মধ্যে বেশ কিছু পয়েন্ট হারাবে। আবার অভিজ্ঞতা আর মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ের জন্য কিছু পয়েন্ট পাবে। ওকে খেলালে ওই অভিজ্ঞতার কারণেই, নইলে চিন্তা করতে হবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। তবে যা-ই করা হোক, কেন তা করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে চিন্তাটা যেন পরিষ্কার থাকে।
শুভ্র: এবার একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গ। আপনার বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, কোনো খেলোয়াড় বাজে ফর্মের মধ্য দিয়ে গেলে আপনি নাকি পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে তাঁর প্রতি বিরূপ আচরণ করতেন।
হোয়াটমোর: সেটা যদি সাধারণ ধারণা হয়, তাহলে হয়তো এটিই ঠিক। তবে আমি ভালো করেই জানি, আমি আমার প্রতিক্রিয়া কখনোই চূড়ান্ত সীমায় চলে না যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। অন্য অনেকের মতো আমি আনন্দে একেবারে আত্মহারাও হয়েও যাই না, হতাশাতেও একেবারে ভেঙে পড়ি না। কোনো খেলোয়াড় ভালো-খারাপ যা-ই করুক, আমি সব সময় একই রকম আচরণ করতে চেষ্টা করেছি। যখন কারও খারাপ সময় গেছে, তখন হয়তো সে ভুল বুঝেছে যে, আমি একটু দূরত্ব রেখে চলেছি। কিন্তু ঘটনা হলো, কেউ ভালো করলেও আমি আবেগে ভেসে যাইনি। আমি সব সময়ই যথাসম্ভব নিরাসক্ত থাকতে চেয়েছি।
শুভ্র: শুনেছি, মাঝখানে কিছুদিন আপনি আশরাফুলের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটার কী ব্যাখ্যা? নাকি আশরাফুলকে অনুপ্রাণিত করার একটা কৌশল বলবেন এটিকে?
হোয়াটমোর: (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) আই ডোন্ট নো। আই ডোন্ট নো। রান না করলে তোমার সঙ্গে কথা বলব না, আশরাফুলকে আমি এমন কিছু বোঝাতে চেয়েছি বলে আমার মনে হয় না। আমি হয়তো আরেকটু স্নেহপ্রবণ পিতার মতো আচরণ করতে পারতাম। তবে আপনাকে এটাও জানাই, আশরাফুল যখন রান পেয়েছে, তখনো কিন্তু আমি উচ্ছ্বাসে ভেসে যাইনি। আমি সবসময়ই যতটা সম্ভব নিস্পৃহ থাকতে চেয়েছি। নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছি। কে জানে, সব সময় হয়তো পারিনি।
শুভ্র: বাংলাদেশে এই চার বছরে আপনার দেখা প্রতিভার সবচেয়ে বড় অপচয় বলবেন কাকে?
হোয়াটমোর: প্রতিভার বড় অপচয় মানে? নাম বলতে হবে!
শুভ্র: হ্যাঁ। অনেকের সম্পর্কেই তো আপনি বিভিন্ন সময় লম্বা-চওড়া সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এখানে এসেই আল-শাহরিয়ার, অস্ট্রেলিয়া সফরের পর হান্নান সরকার, এর পর অলক কাপালি। অথচ এঁদের কেউই আজ বাংলাদেশ দলে নেই।
হোয়াটমোর: এমন হয়ই। তখন দেখে আমার যা মনে হয়েছে, তা-ই বলেছি। এই তিনজনের মধ্যে অলক সম্পর্কে আমি এখনো বলি, ও দারুণ এক প্রতিভা, অসাধারণ ওর টেকনিক। আর ও এখনো হারিয়েও যায়নি, ওর সেরা সময় সামনেই পড়ে আছে। তবে সে জন্য অলককে ব্যাটিং ব্যাপারটা ভালো করে আত্মস্থ করতে হবে। বুঝতে হবে এই পর্যায়ে ব্যাটিং মানে দুর্দান্ত ২০-৩০ নয়, তিন-চারটি চোখ ধাঁধানো শট খেলা নয়; ব্যাটিং মানে দুই ঘণ্টা ব্যাট করা, তিন ঘণ্টা ব্যাট করা, চার ঘণ্টা ব্যাট করা। তা করতে হলে অমন মারমার-কাটকাট ভঙ্গিটা একটু বদলাতেই হবে। তাতে হয়তো ব্যাটিংটা অমন দেখনদারি হবে না, কিন্তু প্রয়োজন এটাই। আশরাফুলের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, আফতাবের ক্ষেত্রেও। এটা শিখতে পারলে ওরা সবাই দারুণ খেলোয়াড় হতে পারবে। ওদের সে সামর্থ্য আছে। এটি যে পরিপূর্ণতা পায়নি, তার কিছুটা দায় আমিও নিচ্ছি। ওদের যেমন রান পাওয়ার কথা, তা যখন পায়নি, আমারও খুব খারাপ লেগেছে। আমি আমার মতো করে ওদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছি, সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। তাতেও কাজ হয়নি বলে আমারও মন খারাপ হয়েছে।
শুভ্র: একটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাশরাফি বিন মুর্তজার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন দেখলাম।
হোয়াটমোর: আমি নাম বলতে চাইনি। নাম বলাটা আমি পছন্দ করি না। কিন্তু ওই সাংবাদিক এমন পীড়াপীড়ি করল যে...। হ্যাঁ, আমি মনে করি মাশরাফির সত্যিকার এক অলরাউন্ডার হওয়ার ক্ষমতা আছে। সত্যিকার অর্থেই অলরাউন্ডার, কারণ ওর ফিল্ডিং... ক্যাচিং, থ্রোয়িং—এসবও দারুণ। তবে ও যেন আর ইনজুরিতে না পড়ে, সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
শুভ্র: শ্রীলঙ্কা থেকে একবার বিদায় নিয়ে তো আবার তো ফিরে এসেছিলেন। বাংলাদেশে আবার ফেরার সম্ভাবনা আছে?
হোয়াটমোর: কেন নয়? কোথায় আপনি ফিরতে চাইবেন না? যেখান থেকে তিক্ততার মধ্য দিয়ে বিদায় নেবেন, মনে হবে এই জায়গা ছাড়তে পারলেই বাঁচি। বাংলাদেশের ঘটনা তো তা নয়। আসলে কোনো জায়গা থেকেই আমি ওভাবে বিদায় নিইনি। ল্যাঙ্কাশায়ারেও আবার ফিরে গেলে ওরা আমাকে স্বাগত জানাবে। সবকিছু মিলে গেলে বাংলাদেশে আবার ফিরে আসতেই পারি।
আরও পড়ুন:
হোয়াটমোরকে বিদায়-অর্ঘ্য
হোয়াটমোরের চোখে সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যান
হোয়াটমোরের চোখে সেরা পাঁচ বোলার