আফগান রূপকথা!
উৎপল শুভ্র
১৬ মে ২০২১
আফগানিস্তানের রূপকথাসম উত্থানের গল্প ক্রিকেটে আর নেই, আর কোনো খেলাতেও আছে কি না সন্দেহ! এই রূপকথার গল্পে অনেক মোচড়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বোধ হয় ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা। বিশ্বমঞ্চে আবির্ভারের আগের দিন আফগানিস্তানকে নিয়ে এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন কল্পনাও করিনি, আট বছর পরই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যাবে তারা, বছর না ঘুরতেই বাংলাদেশকে হারিয়ে পেয়ে যাবে প্রথম জয়ও।
প্রথম প্রকাশ: ১ মে ২০১০। প্রথম আলো।
এত দিন রূপকথা পড়ে এসেছেন। আজ চাইলে দেখতেও পারেন! সে জন্য শুধু সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় টেলিভিশন ছাড়লেই হবে। দেখবেন, ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামছে আফগানিস্তান। এটাকে যদি রূপকথা না বলেন, তা হলে এই উপমাটা আর কোথায় ব্যবহার করবেন?
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন নন, ইতিহাসের সেরা রূপকথার লেখক তো এই আফগান তরুণেরাই। পাকিস্তানের উদ্বাস্তু শিবিরে ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বের সেরা ১২ দলের এই বিশ্বকাপে—শুধু ক্রিকেট কেন, অন্য কোনো খেলাতেই কি লেখা হয়েছে এমন রোমান্টিক গল্প!
এই তরুণদের অনেকেই যুদ্ধে তাঁদের স্বজনকে হারিয়েছেন। সবারই শৈশব-কৈশোর গুলি আর বোমার শব্দে সচকিত। ভিনদেশে উদ্বাস্তু হয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। তাঁরাই আজ বিশ্বকাপের মঞ্চে এবং একটা জায়গায় মাঠে নামার আগেই বিজয়ী। ক্রিকেট পরাশক্তিদের ছাপিয়ে আফগানিস্তানই এই বিশ্বকাপে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। কবির খানকে যতবার মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, আর কোনো দলের কোচকেই তা নয়।
সাবেক পাকিস্তানি বাঁহাতি পেসার যে শুধু আফগানিস্তানের কোচই নন, মুখপাত্রও বটে। আফগান খেলোয়াড়েরা পশতু ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারেন না। পেশোয়ারের সন্তান কবির খানের আফগানিস্তানের কোচের দায়িত্ব পাওয়ায় বড় ভূমিকা ছিল এই ভাষাটা জানা। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে কোচিংয়ের চেয়ে দোভাষীর কাজই বেশি করতে হচ্ছে তাঁকে।
গত পরশু সংবাদ সম্মেলনেও যেমন করতে হলো। অধিনায়ক নওরোজ মাঙ্গালের চেয়ে কথাও বলতে হলো তাঁকেই বেশি। আফগান রূপকথার চমৎকার একটা ব্যাখ্যাও দিলেন, ‘এই ছেলেরা উদ্বাস্তু শিবিরে লড়াই করতে করতে বেড়ে উঠেছে। খাবারের জন্য লড়াই, কাপড়ের জন্য লড়াই, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে লড়াই। ওদের কাছে জীবনের আরেক নামই লড়াই। ওদের রক্তে তাই লড়াইটা ঢুকে গেছে। হার মানাটা ওদের স্বভাবেই নেই, ওরা শুধু জিততে চায়।’
শুধু জিততে চাইলেও তো আর হয় না। সে জন্য খেলোয়াড়ি দক্ষতাও লাগে। অনেক বছর ধরে ক্রিকেট খেলছে—এমন সব দেশকেও তাতে কীভাবে পেছনে ফেলে দিল ওরা? উত্তর—ইস্পাতদৃঢ় মানসিকতা আর ক্রিকেট-প্রেমে। কখনো কখনো প্রায় অশ্লীলতার রূপ নিয়ে ফেলা ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণ খেলাটির আসল সুরই যখন ভুলিয়ে দেওয়ার উপক্রম করছে, আফগানদের কণ্ঠে সেই সুর। নাম-খ্যাতি-বিশ্বকাপ—এসবের কথা ভেবে নয়, ওরা ক্রিকেট খেলছে মনের আনন্দে। ওরা ক্রিকেটের প্রেমে বুঁদ। কবির খান যেটিকে বলছেন, ‘ক্রিকেটের জন্য ক্ষুধা। নতুন কিছু শেখার ক্ষুধা।’
চাপ-টাপ জাতীয় কথাগুলো আফগানদের কাছে হাসির খোরাক। এত দিন না হয় আইসিসির ডিভিশন ফাইভ-ফোর-থ্রিতে মনের আনন্দে খেলা গেছে। কিন্তু এখন বিশ্বকাপের মতো সিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার। সংবাদমাধ্যমের এই বিপুল আগ্রহের সঙ্গেও তো কোনো পরিচয় নেই। এটিকে কি চাপ বলে মনে হচ্ছে না? নওরোজ মাঙ্গাল উড়িয়ে দিলেন, ‘এটা কোনো চাপ হলো নাকি? এর চেয়ে কত বড় চাপের মধ্যে বেড়ে উঠেছি আমরা। আমাদের জন্য এটা নতুন কিছু নয়।’
নতুন কিছু এই বিশ্বকাপ। নতুন কিছু এই প্রথম আফগানিস্তানের মানুষের তাঁদের হিরোদের টেলিভিশনে দেখার সুযোগ পাওয়া। এত দিন ইন্টারনেটে সাফল্যের কথা জেনেই ক্রিকেটারদের নায়কের আসনে বসিয়ে ফেলেছে আফগানরা। আজই প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হবে আফগানিস্তানের খেলা। নওরোজ মাঙ্গাল নিশ্চিত, পুরো দেশেরই চোখ থাকবে টিভির পর্দায়।
শুধুই খেলার সীমানা ছাড়িয়ে ক্রিকেট এখন দ্বন্দ্বমুখর আফগানিস্তানকে একতাবদ্ধ করার বিনি সুতোর মালাও। বাকি বিশ্বের কাছে অন্য পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বাহনও। তরুণ ফাস্ট বোলার হামিদ হাসান কদিন আগেই যেমন বলেছেন, ‘ক্রিকেট আফগানিস্তানকে বদলে দিচ্ছে। বদলে দিচ্ছে আফগানিস্তানের প্রতি বাকি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিও। পুরো দেশে এখন ক্রিকেটের জোয়ার। মানুষের মুখে মুখে ক্রিকেট। আমরা রাস্তায় বেরোলে লোকে আমাদের নাম ধরে চিৎকার করে। আমাদের সবাই চেনে।’
হামিদ হাসানের ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় পেশোয়ারের ধুলায় ধূসর রাস্তায়। উদ্বাস্তু শিবির থেকে দেশে ফেরার সময় হামিদ হাসানের মতো তরুণেরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ক্রিকেট। কিন্তু খেলবে কোথায়? মাঠ নেই, উইকেট নেই। এখনো পুরো কাবুলে একটাই ক্রিকেট মাঠ, টার্ফ উইকেটও একটাই। কবির খান তাই ভেবে থই পান না, ক্রিকেটে উন্নত দেশগুলোর মতো সুযোগ-সুবিধা পেলে এই স্বপ্নাতুর তরুণেরা কোথায় যাবেন!
খেলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বার্তাও বাকি বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে চান নওরোজ মাঙ্গালরা, ‘আমাদের সবাই যোদ্ধা-জাতি বলে জানে। আমরা বিশ্বকে জানাতে চাই, আমরা যুদ্ধ পছন্দ করি না, আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। আমরা চাই, আফগানিস্তানকে সবাই ভালো কারণেও চিনুক।’
সেই চাওয়া পূরণের পথে বড় একটা ধাপ এই বিশ্বকাপে উত্তরণ। এখানেও কি নতুন কোনো রূপকথা লিখতে যাচ্ছে আফগানিস্তান? ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামাটাই তো ওদের কাছে রূপকথার মতো। ভারতীয় সিনেমা আফগানিস্তানেও খুব জনপ্রিয়, সিনেমা দেখে দেখে হিন্দি মোটামুটি বুঝতেও পারেন অনেকে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের অনেকেই তাঁদের নায়কের আসনে। উইকেটকিপার মোহাম্মদ শেহজাদ যেমন মহেন্দ্র সিং ধোনির খুব ভক্ত। নামের আদ্যক্ষরে মিল আছে, ধোনির মতো তাঁকেও ‘এমএস’ বলে ডাকতে বলেছেন সতীর্থদের।
মহেন্দ্র সিং ধোনি শেহজাদের নামও শোনেননি কোনো দিন। শুধু শেহজাদ কেন, আফগানিস্তানের একজন খেলোয়াড়েরও নাম জানা নেই বলে স্বীকার করেছেন ভারতীয় অধিনায়ক। কবির খান এতে খুশিই, ‘ওরা আমাদের না চিনলে তো আমাদেরই সুবিধা। তবে আমি বলে দিচ্ছি, এই ম্যাচের পর ওরা আমাদের নাম জানবে।’
এই হুমকি মাঠে রূপায়িত না হলেই বা কি! ক্রিকেট তো শুধুই একটা খেলা। সেটি যখন এই সীমানা ছাড়িয়ে ‘জীবন’ হয়ে যায়, সেখানে তো আফগানিস্তান এরই মধ্যে ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!’