`টেস্ট` শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো
উৎপল শুভ্র
২৬ জুন ২০২১
আইসিসি ট্রফি জয়ের সময় আমি ভোরের কাগজের সাংবাদিক, আর সাবের হোসেন চৌধুরী সে পত্রিকার মালিক। তবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এই তথ্য মনে রাখতে হয়নি কখনোই। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর তাঁর ইন্টারভিউ করতে গেছি, তিনি বলে বসলেন, `লক্ষ্য ২০০০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ`। শুনে তো আমি হেসে ফেলেছি। তবে তিনি নির্বিকার। বছর তিনেক পর তাঁর সেই স্বপ্নই সত্যি হয়েছিল, যে স্বপ্নপূরণে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল হক।
মাত্রই আইসিসি ট্রফি জিতে এসেছে বাংলাদেশ। ভোরের কাগজ থেকে সেই বিজয় নিয়ে আট পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা বেরোবে। বিশেষ সংখ্যার জন্য চাই অধিনায়ক আকরাম খান, কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ও বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর বিশেষ সাক্ষাৎকার। প্রথম ও শেষটা সহজেই হলো। অনুমিতভাবেই সমস্যাটা হলো গর্ডন গ্রিনিজকে নিয়ে। দেখা গেল, আইসিসি ট্রফি জয় তাঁর সাংবাদিকদের বিষবৎ এড়িয়ে চলা স্বভাবে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনতে পারেনি। মণখানেক কাঠ এবং তার চেয়েও বেশি খড় পুড়িয়ে সেই সাক্ষাৎকার অবশ্য নিয়ে ছেড়েছিলাম। উত্তরায় তাঁর ফ্ল্যাটে অতিথি সাংবাদিককে মিস্টার গ্রিনিজ মোটামুটি আতিথেয়তাও করেছিলেন বলে মনে পড়ে। ইন্টারভিউয়ে কী বলেছিলেন, তা পড়তে ইচ্ছা করলে সেই ইচ্ছা পূরণ করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। এই ওয়েবসাইটেও আছে গ্রিনিজের সেই ইন্টারভিউ ('আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে')।
আকরাম খান ও সাবের হোসেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার দুটির শিরোনাম করেছিলাম একজনের স্বপ্ন আর আরেকজনের লক্ষ্য নিয়ে। আশ্চর্যই বলতে হবে, দুটিই সত্যি হয়েছিল। আকরামের সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল: বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর স্বপ্ন দেখি। আর সাবের হোসেন চৌধুরীর 'টার্গেট ২০০০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস'।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আকরামের স্বপ্নের চেয়ে সাবের হোসেন চৌধুরীর লক্ষ্যটাকেই বেশি অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল। আমি সাংবাদিক, সাবের ভাই বোর্ড সভাপতি--এর বাইরেও আমাদের দুজনের সম্পর্কে আরেকটা সমীকরণ ছিল। আমি যে পত্রিকার সাংবাদিক, সাবের হোসেন চৌধুরী সেই ভোরের কাগজের মালিক। যদিও কখনোই আমার এটি মনে রাখার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ সাবের হোসেন চৌধুরী কখনোই মালিকসুলভ আচরণ করেননি। বরং আমাদের সম্পর্কটা ছিল দারুণ পেশাদার। হয়তো আমরা বেশ ক'জন সাংবাদিক একসঙ্গে কথা বলছি, আমার সঙ্গে ওনার কথাবার্তায় কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, উনি আমার পত্রিকার মালিক। সাংবাদিকতার জায়গাতেও ভোরের কাগজের ক্রীড়া বিভাগ ছিল 'স্বাধীন-সার্বভৌম'।
ভোরের কাগজের শুরুর দিকে আবাহনীর সঙ্গে সাবের হোসেন চৌধুরীর খুব নিবিড় সম্পর্ক, আর সেটাও কোন সময়ে? যখন আবাহনী-মোহামেডানে বাংলাদেশ দুই ভাগ, পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া একটা লাইন নিয়ে পরদিন তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যায়, ভোরের কাগজের লেখা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু আমরা কখনো কখনো সমর্থক প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবলেও মালিক-প্রতিক্রিয়ার কথা আমাদের একবারও ভাবতে হয়নি। বিতর্কটা ফুটবল নিয়েই তখন বেশি হতো। কারও কাছে তথ্যটা একটু নতুন মনে হতে পারে ভেবে জানানো প্রয়োজন বোধ করছি, ঢাকার ক্লাব ফুটবলের ওই রমরমা সময়ে সাবের হোসেন চৌধুরী ছিলেন আবাহনীর ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান।
এত সব বলার কারণ হলো, বিশেষ সংখ্যার জন্য সাবের হোসেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সিদ্ধান্তটা ছিল সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত, মালিকের চাওয়া বা তাঁকে খুশি করার কোনো ব্যাপার তাতে নিহিত ছিল না। বরং ভোরের কাগজের শেষ দিন পর্যন্ত আমি বলে এসেছি, সাবের হোসেন চৌধুরী এই পত্রিকার মালিক বলে তাঁর প্রাপ্য প্রশংসাটা করতে পারছি না। পাছে লোকে সেটিকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে করে। এতে বরং অন্যায়ই হয়েছে তাঁর প্রতি। কারণ যৌক্তিক সমালোচনার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মালিক পরিচয় ভুলে গেছি এবং একটু অ্যান্টি-এস্টাবলিস্ট চরিত্রের কারণে সেই সমালোচনায় যথেষ্টই ঝাঁজ থেকেছে।
যা হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরি। সাবের হোসেন চৌধুরী সাক্ষাৎকার নিতে গেছি তাঁর পরীবাগের বাড়িতে। তাঁর কথা শুনতে বরাবরই দারুণ লাগে। এবারও সেটির ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ২০০০ সালের মধ্যে টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের লক্ষ্যের কথা বলতেই আমি হেসে ফেলেছি। হাসিটাকে রূপান্তরিত করেছি প্রশ্নেও, 'আপনি কি সিরিয়াস, নাকি রসিকতা করছেন?'
সাবের হোসেন চৌধুরী মুখে হাসি নেই, 'অবশ্যই সিরিয়াস। আপনি কী হেডলাইন করবেন, আমি জানি না। তবে এটা দিয়েও যদি হেডলাইন করেন, আমার আপত্তি নেই। আমি দায়িত্ব নিয়েই কথাটা বলছি।'
২০০০ সালের এই দিনে লর্ডস থেকে সুখবরটা পাওয়ার পর স্বপ্ন নিয়ে সেই সংজ্ঞাটার কথা মনে পড়ছিল...স্বপ্ন হলো সেটাই, যা শুনে বাকি সবাই পাগল বলে।
গ্রেট লিডারদের এমন স্বপ্নবাজই হতে হয়! নাকি এমন স্বপ্নবাজ হলেই গ্রেট লিডার হওয়া যায়!
জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী, আপনি আমার প্রণতি গ্রহণ করুন।
(প্রমাণ হিসাবে নিচে ভোরের কাগজের সেই বিশেষ সংখ্যায় সাবের হোসেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের স্ক্রিনশটটাও সংযুক্ত থাকল। সেন্টারস্প্রেড হয়েছিল বলে এক ছবিতে তা পাওয়া যায়নি)।
পাদটীকা: বলিউডের ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, যতীন-ললিত যেমন অবিচ্ছেদ্য; শুধু একজনের কথা বললে আরেকজনের প্রতি অন্যায় করা হয়, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্ন পূরণের নেপথ্যেও এমন এক জুটি। সাবের-আশরাফুল! নেতা হিসাবে সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রাপ্য তিনি পাবেন, পাচ্ছেনও; তবে এই যুদ্ধ জয়ে তাঁর 'প্রধান সেনাপতি'র কথা ভুলে যাওয়া অন্যায় হবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার অনেক আগে থেকেই সৈয়দ আশরাফুল হক ক্রিকেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে 'আন্তর্জাতিক' হয়ে গেছেন। সৈয়দ আশরাফুল হক না থাকলে সাবের হোসেন চৌধুরী একা পারতেন বলে মনে হয় না, সাবের হোসেন চৌধুরী না থাকলে সৈয়দ আশরাফুল হকও না। একজনের ছিল বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, অন্যজনের ক্যারিশমা। দুইয়ে মিলেই এই কবিতা: 'টেস্ট শব্দটি যেভাবে আমাদের হলো!'