অন্ধকারে আলো হয়ে এলেন নাসির
২২ জুন ২০২১
ওয়ানডে অভিষেকে বিপর্যয়ের মধ্যে আট নম্বরে নেমে ৬৩ রান করেছিলেন। ওয়ানডেতে নাসির হোসেনের প্রথম সেঞ্চুরিটাও প্রায় একই রকম পরিস্থিতিতে। সেটিও ওয়ানডেতে তাঁর সপ্তম ইনিংসে। ৭৬ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত দলের এক ব্যাটসম্যান ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, এটাই আসলে বুঝিয়ে দিচ্ছে নাসির হোসেনের সেদিনের ইনিংসটাকে।
প্রথম প্রকাশ: ৪ ডিসেম্বর ২০১১। প্রথম আলো।
পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ২৬২/৭। বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ১৮৬/৭। ফল: পাকিস্তান ৭৬ রানে জয়ী
বাংলাদেশ ইনিংসের ৪৯তম ওভারে মিরপুরের গ্যালারিতে যে গর্জনটা উঠল, তাতে কারও মনে হতেই পারত, বাংলাদেশ বুঝি ম্যাচ জিতে গেছে!
অথচ বৈদ্যুতিক স্কোরবোর্ডে দেখানো রান আর বলের সমীকরণটা তখন রীতিমতো রসিকতা বলে মনে হচ্ছে। জয়ের জন্য প্রয়োজন ৮ বলে ৮৩ রান! কিন্তু জয়-পরাজয় নিয়ে তখন কে ভাবতে যায়! সেটির মীমাংসা যে বাংলাদেশের ইনিংসের দশম ওভারেই হয়ে গেছে। যখন স্কোরবোর্ডে ১৯/৪।
ওই গর্জনকে বলতে পারেন নাসির হোসেন নামের সাহসী এক তরুণের নামে জয়ধ্বনি। মিনিট পনেরো পর এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসা দর্শকদের মধ্য থেকে আবারও এই ধ্বনিটা উঠল। ম্যান অব দ্য ম্যাচ হিসেবে যে মাত্রই ঘোষিত হলো নাসির হোসেনের নাম।
অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে এটি উপমহাদেশীয় ব্যক্তিচিন্তার আরেকটি উদাহরণ হয়ে হাসাহাসির কারণ হবে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতিতে ৮৬ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে কারও সেঞ্চুরি নিয়ে মাতামাতিটা ‘অপরাধ’ বলে গণ্য। কিন্তু নাসিরের সেঞ্চুরির পর মিরপুর স্টেডিয়ামেই যে এক অস্ট্রেলিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে করতালি দিলেন!
কারণ, স্টুয়ার্ট লর তখন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা নয়। সব ব্যাটসম্যানের একসঙ্গে ব্যাটিং ভুলে যাওয়ার ঘোর অন্ধকারে নাসিরের এই সেঞ্চুরি এমনই বিদ্যুচ্ছটা হয়ে এসেছে যে, এটি তাঁর কাছে মরণাপন্ন রোগীর জন্য কোরামিন ইনজেকশন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা ২১তম ওয়ানডে হারের দিনে ম্যাচ রিপোর্টের শুরুটা নাসিরময় হয়ে থাকার আরেকটি কারণ আছে। সেঞ্চুরিটা যে নাটকীয়তাময়। ম্যাচের ৫ ওভার বাকি থাকতে নাসিরের রান ৬৯। বলই বাকি আছে মাত্র ৩০টি, নাসির তো আর সব খেলার সুযোগ পাবেন না। বাকি ৩১ রান তো তাহলে অসম্ভবই। ম্যাচও তখন বৃহত্তর ছবি হারিয়ে শুধুই নাসিরে কেন্দ্রীভূত। সেঞ্চুরিটা কি হবে?
হলো। সেটিও আট বল বাকি থাকতেই। বাকি ৩১ রান করতে ১৭ বল লাগল নাসিরের। সেঞ্চুরিটা এলও খুব নাটকীয়ভাবে। ৮৬ থেকে আফ্রিদির চার বলে ৬ ৪ ০ ৪। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুর দিন থেকেই নাসির ভয়ডরহীন একটা চরিত্রের প্রমাণ দিয়ে এসেছেন। ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরিটা এল সেটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয়ে।
জিম্বাবুয়েতে ওয়ানডে অভিষেকেই হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। সেঞ্চুরিটা আরও বেশি চাপে। বালির বাঁধের মতো ধসে পড়েছে বাংলাদেশের টপ অর্ডার। ১৯ রানে প্রথম চার ব্যাটসম্যান নেই। সাকিবের সঙ্গে যখন উইকেটে যোগ দিলেন, জয়-টয়ের কথা ভুলে মান বাঁচানোর প্রশ্ন। ম্যাচের সর্বোচ্চ ১০৬ রানের জুটিতে সেটি বোধ হয় বাঁচল। সিরিজে প্রথমবারের মতো এক শ করার পর প্রেসবক্সে ওঠা বিদ্রূপের করতালিটা ১৮৬-কে অনেক বড় মনে করাচ্ছে।
পাকিস্তানি ফিল্ডারদের উদার সহায়তা ছিল। সাকিব ৯ রানে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন। নাসির তো দু-দুবার। প্রথমবার কোনো রান করার আগেই, এরপর আবার ৯ রানে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটি মনে করিয়ে দিয়েছে সেই পুরোনো আপ্তবাক্য—ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে। ধৈর্যশীলদের পক্ষেও। সাকিব ৯০ বলে ৩৪ রানের ইনিংসে মাত্র একটি চার। এত বলের ইনিংসে মাত্র একটি চার সাকিবের ক্যারিয়ারে আর নেই। এর আগে একটি চারের ইনিংসে সর্বোচ্চ ৭৫ বল খেলেছিলেন ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দলের বিপর্যয়ে আবার সাকিবের প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো কিন্তু একটা প্রশ্নকে আরও বড় করে দিল। প্রতি ম্যাচেই যদি তাঁকেই কাজটা করতে হয়, তাহলে কেন তিনি আরও আগে নামবেন না?
সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল মিরপুরের কালো মাটির উইকেট। কাল উইকেটের রং বদলের সঙ্গে চরিত্র বদলও। ধূসর রঙের উইকেটে শুধু স্পিনার নয়, পেসারদের জন্যও কিছু থাকল। ব্যাটসম্যানদেরও সিরিজে প্রথম হাত খুলে খেলার সুযোগ দিল তা। তবে আগের দুই ম্যাচের কথা ভেবে পাকিস্তান পুরোনো দিনের ওয়ানডেই খেলল। সাবধানে খেলে একটা ভিত্তি গড়ো, হাতে উইকেট থাকলে শেষ ১০ ওভারে চালানো যাবে। প্রথম ২৫ ওভারে ২ উইকেটে ৯৩, তাই ৫০ ওভার শেষে ২৬২ হয়েও গেল। উমর আকমলের ৫৪ বলে ৫৯ রানের ইনিংসটিই পাকিস্তানের ইনিংসের মেরুদণ্ড হয়ে থাকল। তবে শেষ ১০ ওভারে ৭২ রান ওঠার মূলে যথারীতি শহীদ আফ্রিদি।
ওয়ানডের ৪৪তম ওভারে শহীদ আফ্রিদির ক্যাচ ফেলে দেওয়ার মতো আত্মধ্বংসী কাজ আর হয় না। নিজের বোলিংয়ে শফিউল সেটিই করলেন। ‘নতুন জীবনে’ তাও কমই করলেন আফ্রিদি। পরের ২০ বলে ৩৪ রানকে ‘কম’ বলা হচ্ছে তিনি সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি বলেই। ২৭ বলে ৪২ রানের ইনিংসে যথারীতি দুটি ছক্কা থাকল। ‘বুম বুম’ নামকে সার্থক করে ওয়ানডেতে তিন শ ছক্কার মাইলফলক থেকে এই পাঠান আর মাত্র পাঁচটি ছক্কা দূরে।
নাসিরের সেঞ্চুরিতে একটু আড়াল হয়ে গেছে ঠিকই, তবে এই ম্যাচ কিন্তু কিছু প্রশ্নকে ঠিকই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তৃতীয় স্পিনার হিসেবে ইলিয়াস সানিকে নামিয়ে দেওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকল। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, দাঁতে দাঁত চেপে দুঃসময়টা পার করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞার বদলে তামিম-ইমরুল-শাহরিয়ারের ব্যাটিংয়ে কেন অমন অবিবেচক ঔদ্ধত্য?
আরও পড়ুন: