মুশফিক ভালো, কোহলি আরও ভালো
এশিয়া কাপ ২০১৪
উৎপল শুভ্র
২৭ মে ২০২১
ফতুল্লায় ২০১৪ এশিয়া কাপের ম্যাচ। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম দারুণ এক সেঞ্চুরি করে বড় একটা স্কোর গড়ে দিলেন দলকে। তারপরও জিততে পারলেন না। কারণ ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি এর চেয়েও ভালো একটা সেঞ্চুরি করে ফেললেন!
প্রথম প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। প্রথম আলো।
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৭৯/৭। ভারত: ৪৯ ওভারে ২৮০/৪। ফল: ভারত ৬ উইকেটে জয়ী
শেষ পর্যন্ত লড়াইটা হয়ে গেল দুই অধিনায়কের। তাতে বিরাট কোহলির সঙ্গে কীভাবে পারেন মুশফিকুর রহিম!
রানের ব্যবধান বেশি নয়। মাত্র ১৯ রানই বেশি করলেন কোহলি। কিন্তু ম্যাচে প্রভাব বিবেচনায় ভারত অধিনায়কের ১২২ বলে ১৩৬ রান এতটাই এগিয়ে যে কোহলি যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, ফতুল্লার দর্শকেরা দল বেঁধে গ্যালারি ছাড়তে শুরু করেছেন।
জয়ের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তখন মাত্র ১৩ রান। বাংলাদেশের ইনিংস শেষে স্বপ্নের যে রেণু বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল, সেটি বাতাসেই মিলিয়ে গেছে অনেক আগে। কোহলির ব্যাটিংই শুধু আটকে রেখেছিল দর্শকদের। রুবেলের ইয়র্কার তাতে ইতি টেনে দেওয়ার পর আর কিসের টানে মাঠে পড়ে থাকা! যেতে যেতে অনেক পেছন ফিরে দেখলেন, কোহলির সঙ্গে ২১৩ রানের জুটির অংশীদার অজিঙ্কা রাহানেকেও ফিরিয়ে দিলেন সোহাগ গাজী। ম্যাচটির আয়ু সামান্য বাড়ানো ছাড়া যেটির কোনো তাৎপর্য নেই।
টসে জিতে কোহলির সিদ্ধান্তে অবাক হওয়ার উপাদান ছিল। পিচ রিপোর্টে বিশেষজ্ঞ ধারাভাষ্যকার বলেছেন, টসে জিতলে অধিনায়ক এখানে চোখ বুজে প্রথমে ব্যাটিং নেবেন। বিরাট কোহলিও ‘চোখ বুজেই’ নিয়েছেন। তবে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত। কারণটা অনুমান করাও কঠিন কিছু নয়। ভারতীয় ব্যাটিং-পরম্পরায় শচীন টেন্ডুলকারের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর যে স্বীকৃতি, সেটির পেছনে অনেক কারণই আছে। একটা জায়গায় এখনই টেন্ডুলকার ম্লান হয়ে যেতে বসেছেন। কালকের আগে ১৩০ ওয়ানডেতে কোহলির ১৮টি সেঞ্চুরির ১২টিই পরে ব্যাটিং করে। সবগুলো সংখ্যাই ‘এক’ করে বেড়ে গেল এই ম্যাচের পর। ১৯ সেঞ্চুরির ১৭টিতেই জয়ী দলের নাম ভারত, বাড়তি মাহাত্ম্য যোগ করছে এই তথ্যটা।
দিল্লির তরুণের বখে যাওয়া সময়টার অনেক গল্প একসময় ভারতীয় ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে মুখে ফিরত। ত্যক্তবিরক্ত, তার চেয়েও বেশি চিন্তিত কোহলির কোচ একদিন তাঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘এই দিল্লিতে তোমার চেয়ে সুদর্শন অনেক ছেলে আছে। তুমি বিরাট কোহলি কিন্তু শুধু ক্রিকেটার বলে। মনে রেখো, সেই ক্রিকেটটা ঠিক না থাকলে কেউই আর তোমাকে পুছবে না।’
কোহলি মনে রেখেছেন। পালাবদলের সময়টা কবে শুরু হয়েছিল, সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে ২০১০ সালের শুরুতে বাংলাদেশে ত্রিদেশীয় সিরিজটির কথাও আলোচনায় আসে। যে টুর্নামেন্টে তিন ইনিংসে কোহলির রান ছিল ৯১, অপরাজিত ৭১ ও অপরাজিত ১০২।
সেই যে বাংলাদেশের প্রেমে পড়লেন, সেটিতে আর ভাটার টান নেই। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি, ৫টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক হয়ে গেলেন কাল। বাংলাদেশের বোলিং যেমন, বাংলাদেশের আলো-বাতাসও কোহলির একই রকম পছন্দ। বাংলাদেশের মাটিতে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের বিপক্ষেও ব্যাটিং-গড় ১১০ ছাড়ানো!
অধিনায়কত্ব যে তাঁর জন্য বাড়তি কোনো বোঝা নয়, টানা অষ্টম জয়ে সেটিরও প্রমাণ। এখন পর্যন্ত অধিনায়কত্বের সুযোগ পেয়েছেন হয় ধোনির বিশ্রাম অথবা চোটের কারণে। দীর্ঘ মেয়াদে পাওয়ার দাবিও জানিয়ে রাখছেন সুযোগ পেলেই।
মুশফিকুরের সেই দাবি এরই মধ্যে পূরণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রায় দুই বছর মেয়াদে অধিনায়ক করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অধিনায়কত্বের চাপ-টাপ সামলানোর দক্ষতাও অনেক দিনই প্রমাণিত। তবে কালকের মতো করে বোধ হয় আর কখনো নয়।
এশিয়া কাপের দল নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে বিতর্কের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, সেটিতে পুড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। উল্টো সেই আগুন জ্বলে উঠল তাঁর ব্যাটে। যেটি বরুন অ্যারনকে ‘বাঁকা পথ’ ধরতেও বাধ্য করল। এক ওভারে দুটি চার ও একটি ছয়ের পর বিমার ছুড়লেন মুশফিকের দিকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়া ব্যাটসম্যানের দিকে যতই সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে যান, সেটি ইচ্ছাকৃত মনে করার যথেষ্টই কারণ ছিল। মুশফিক বীরের মতো আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। শেষ ওভারে আউট হওয়ার আগে বোলারদের লড়াই করার মতো একটা পুঁজিও দিয়ে গিয়েছিলেন। কোহলির আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত যেটি ম্যাচজয়ী বলেও ‘ভুল’ বোঝাচ্ছিল।
ওভার থ্রোর ৪ রানে সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর বাঁধনহারা যে উল্লাস, সেটি শুধুই ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির নয়। মাঠে ও মাঠের বাইরে ঘিরে ধরা দমবন্ধ করা চাপ থেকে মুক্তির আনন্দই যেন তাতে বেশি মূর্ত হয়ে থাকল।
৪৯ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর এনামুলের সঙ্গে ১৩৩ রানের জুটি। যা দুই বছর আগে গত এশিয়া কাপে ভারত-বধের সুখস্মৃতি ফিরিয়ে আনছিল বারবার। তখন কে জানত, ভারতের বিপক্ষে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডটি রাত বাড়তে বাড়তে নিছকই একটা পরিসংখ্যান হয়ে থাকবে!
মুশফিকুরের সেঞ্চুরির জবাব যেমন সেঞ্চুরি করেই দিলেন বিরাট কোহলি, তেমনি তৃতীয় উইকেট জুটির জবাবও তৃতীয় উইকেটেই। এখানে ব্যবধানটা এত বড় যে ম্যাচ থেকে অনিশ্চয়তার সব রং মুছে গেল তাতেই।
অর্থহীন হয়ে গেল বড় একটা প্রশ্নও। ৩৭ ওভার শেষে বাংলাদেশ যখন ৩ উইকেটে ১৮২, তখন কেন জিয়াউরকে না পাঠিয়ে অনেক দিনই ‘ছক্কা নাঈম’ নামকে বিদ্রূপ করা নাঈম ইসলাম ও ফর্মহীন নাসিরকে পাঠানো হলো?
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রাজ্জাক শিশিরকে দাঁড় করালেন কাঠগড়ায়। ভারতীয় ইনিংসের অর্ধেকটা যেতে না-যেতেই নাকি বল গ্রিপ করা যাচ্ছিল না। কোহলি আর রাহানে যে ব্যাটিংটা করলেন, তাতে এটা অবশ্য অজুহাতের মতোই শোনাল।
শিশির নয়, বিরাট কোহলির কাছেই হেরেছে বাংলাদেশ!
আরও পড়ুন: