তীরে এসে ডুবল তরী
উৎপল শুভ্র
২৬ মে ২০২১
মাত্র আগের বলটিতেই ওয়ানডেতে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন। মুশফিক ব্যাটটাও তুললেন না। শেষ ৫ বলে চাই ৬ রান। অন্য প্রান্তে শেষ ব্যাটসম্যান বলে মুশফিকের মনে হলো, যা করার, এই বলেই করে ফেলা ভালো। পোফুর বল তুলে দিতে চাইলেন লং অনের ওপর দিয়ে। কিন্তু সেটি শুধু ফিল্ডারের হাত পর্যন্তই পৌঁছাতে পারল।
প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১১। প্রথম আলো।
জিম্বাবুয়ে: ৫০ ওভারে ২৫০/৭। বাংলাদেশ: ৪৯.২ ওভারে ২৪৫। ফল: জিম্বাবুয়ে ৫ রানে জয়ী
লং অনে সিবান্দা যখন ক্যাচটি নিলেন, মাঠে অন্ধকার নেমে এসেছে। মুশফিকুর রহিম হতাশায় আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর চারপাশে ছোটাছুটি করছে কিছু লাল সরলরেখা। জিম্বাবুইয়ান খেলোয়াড়দের আনন্দ যে এই ম্যাচ ছাপিয়ে আরও বহু দূর ব্যাপ্ত! গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের কাছে টানা সাতটি সিরিজ হারার পর এই প্রথম সিরিজ জয়। সেটিও দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই।
যে পরাজয় সবচেয়ে বেশি বিঁধেছে মুশফিকুরের বুকেই। মাত্র আগের বলটিতেই ওয়ানডেতে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি পেয়েছেন। দুই বছর আগে এই জিম্বাবুয়েতেই ৯৮ রানে আউট হয়ে যাওয়ার দুঃখ ভুলে কোথায় আনন্দ করবেন, মুশফিকুর ব্যাটটাও তুললেন না। নিজের ব্যক্তিগত অর্জনে আনন্দ করার সময় কোথায়, পুরো দেশ যে তাকিয়ে তাঁর দিকে। শেষ ৫ বলে চাই ৬ রান। অন্য প্রান্তে শেষ ব্যাটসম্যান বলে মুশফিকুরের মনে হলো, যা করার এই বলেই করে ফেলা ভালো। পোফুর বল তুলে দিতে চাইলেন লং অনের ওপর দিয়ে। কিন্তু সেটি শুধু ফিল্ডারের হাত পর্যন্তই পৌঁছাতে পারল।
ঝুঁকিটা না নিলেই যে ভালো হতো, সেটি তো সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছেন। ৫ বলে ৬ রান আনতে ওভারের দ্বিতীয় বলেই ছক্কা মারতে যাওয়াটা একটু বেশি উচ্চাভিলাষীই হয়ে গেছে। ছক্কাটা হয়ে গেলে ‘হিরো’ হয়ে যেতেন। কিন্তু এই সিরিজে বাংলাদেশের কিছুই ঠিকমতো হবে না বলে নিয়তি-নির্ধারিত। নইলে তামিম ইকবাল কেন ওভাবে রান আউট হয়ে যাবেন? দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে কীভাবে তাঁর হাত থেকে ব্যাট পড়ে গেল, সেটি একটা রহস্যই বটে। হাতে ব্যাট থাকলে বেঁচে যেতেন কি না কে জানে, তবে খালি হাতে প্রাণপণ ডাইভ দিয়েও কাজ হলো না।
আগের দুই ম্যাচ মিলিয়ে মাত্র ৭ রান। এদিন সব পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ফুটে বেরোচ্ছিল তাঁর ব্যাট থেকে। ৬২ বলে ৪৪ রানের ইনিংসে মাত্র দুটি চার—এটি তো তামিম ইকবাল নন। যখন তাঁর খোলস থেকে বেরোনোর সময়, তখনই ওই সর্বনাশ।
রান আউট সর্বনাশ হয়ে এসেছে আরও একবার। মুশফিকুরের সঙ্গে শুভাগতর জুটিটি জমে উঠেছিল, সেটি শেষ হয়ে গেল মিড অফ ফিল্ডারের হাতে বল দেখেও শুভাগতর অব্যাখ্যনীয় দৌড়ে। ৬১ রানের ওই জুটিটি হয়েছে সাকিব ফিরে আসার পর। আস্কিং রেট যেভাবে তর তর করে ওপরে উঠছিল, তাতে সাকিবের থাকাটা খুব প্রয়োজন ছিল। উতসেয়াকে ফিরতি ক্যাচ দেওয়ার আগে সাকিব করতে পেরেছেন মাত্র ১৯। স্পিনারদের দুঃসময় উপহার দিয়ে আসা এই সিরিজে কালই ব্যতিক্রমী হয়ে উজ্জ্বল প্রসপার উতসেয়া। ৪৭ রানে তাঁর ৩ উইকেট নিয়ে এই অফ স্পিনার ম্যাচেরই সফলতম বোলার।
ব্রায়ান ভিটরি? তাঁর কী খবর? প্রথম দুই ম্যাচে ব্রায়ান ভিটরির বিষে নীল হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ভিটরির স্বপ্নযাত্রায় এদিন বিরতি। পাঁচের নামতা ভুলে গিয়ে মাত্র এক উইকেট। সেটিও শেষ বলে। মাহমুদউল্লাহ ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন লং অনে। ম্যাচটা যখন বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তখন ওই ঝুঁকি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পেছন ফিরে তাকিয়ে মাহমুদউল্লাহর আউটটিকেই মনে হচ্ছে টার্নিং পয়েন্ট। এর পরই যে একের পর এক উইকেট পড়তে শুরু করল। ম্যাচটা হয়ে দাঁড়াল জিম্বাবুয়ে বনাম মুশফিকুর। যাতে জিততে জিততেও হেরে গেলেন বাংলাদেশের উইকেটকিপার।
গত পরশু ম্যাচ রেফারি রোশান মহানামা হারারেতে বড় স্কোর গড়ার যে রেসিপি দিয়েছিলেন, জিম্বাবুয়ে যেন সেটিই অনুসরণ করল। শুরুতে ঝুঁকি না নিয়ে হাতে উইকেট রাখো, পরে ঠিকই রান আসবে। মেঘলা আকাশ ও কনকনে বাতাস মিলিয়ে পেসারদের জন্য আদর্শ এক দিনে বাংলাদেশের তিন পেসার দারুণ বোলিং করলেন। ২০ ওভার শেষে স্কোর তাই মাত্র ৬০। পরে ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতেও দুর্দান্ত শফিউল-রুবেল। কিন্তু তার পরও শেষ ১০ ওভারে ৮৩ রান তুলে জিম্বাবুয়ে ২৫০। বাংলাদেশের ফিল্ডারদেরও অবশ্য তাতে বড় অবদান।
একটা দলের মানসিক অবস্থা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় ফিল্ডিং দেখে। বাংলাদেশ দলের অবস্থাটাও বোঝা গেল। চার-চারটি ক্যাচ পড়ল। টাটেন্ডা টাইবুরই তিনটি। ১৬ রানে ফেললেন শুভাগত, ৪১ রানে নাসির ও মুশফিকুর। কিছুক্ষণ পর চিগুম্বুরার ক্যাচ ফেললেন বদলি ফিল্ডার সোহরাওয়ার্দী।
পরের বলেই আউট হয়ে গেছেন বলে এমনিতে খুব ভালো ফিল্ডার হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দীর মিসটা খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়নি। তবে টাইবু প্রথমবার বেঁচে যাওয়ার পর করেছেন আরও ৬৭ রান। মাসাকাদজার সঙ্গে তাঁর ১৪২ রানের জুটিটি না হলে জিম্বাবুয়ের ২৫০ হয় না।
তবে সেই ২৫০-ও তো প্রায় পেরিয়েই গিয়েছিল বাংলাদেশ। বলতে গেলে মুশফিকুর রহিমের একক কৃতিত্বে। এমন একটা ইনিংস খেলার পরও পরাজয়। নিজের ভুলেই তীরে এসে তরী ডুবে গেল বলে হয়তো নিজেকে ‘অপরাধী’-ও ভাবছেন মুশফিকুর।
কখনো কখনো ক্রিকেট বড় নিষ্ঠুর!
আরও পড়ুন: মুশফিক ভালো, কোহলি আরও ভালো