বাংলাদেশ-ভারত দ্বিতীয় টেস্ট ২০০৭
টেন্ডুলকারদের বিশ্ব রেকর্ডের পর আশরাফুলদের `বাংলাদেশি রেকর্ড`!
মিরপুর স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট-২
উৎপল শুভ্র
২৫ মে ২০২১
প্রথমে রেকর্ড গড়লেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা, লেখা হলো ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম চারজনেরই সেঞ্চুরির অনন্য কীর্তি। দিনের শেষাংশে ব্যাটিংয়ে নেমে নিজেদের লজ্জার রেকর্ডটাই নতুন করে লিখলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা, ৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে গড়লেন সবচেয়ে বাজে শুরুর বাংলাদেশি রেকর্ড। মিরপুর স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় দিনটিতেও ছিল ঘটনার ঘনঘটা।
প্রথম প্রকাশ: ২৭ মে ২০০৭। প্রথম আলো।
২য় দিনের শেষে
ভারত ১ম ইনিংস: ৬১০/৩ (ডিক্লে.) বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৫৮/৫
শেষ বিকেলের ৫টি উইকেট ভারতীয় বোলাররা নিলেন, নাকি অসহনীয় গরমে প্রায় পৌনে দু দিন ফিল্ডিং করার ক্লান্তি, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকা টেস্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে নেই। সেটি দিব্যচক্ষে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অসাধারণ ব্যাটিং করলেও এই টেস্টে পঞ্চম দিন বলে কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। নৈরাশ্যবাদীরা অবশ্য চতুর্থ দিন নিয়েই সংশয়ে!
মোহাম্মদ আশরাফুল চিন্তাভাবনায় সব সময়ই খুব ইতিবাচক। তিনি মানতে চাইবেন না জানতাম। সংবাদ সম্মেলনে বললেনও, ‘খেলাটা ক্রিকেট। কিছুই বলা যায় না।’ কিন্তু বলার সময় মনে হলো না, ভেতর থেকে আসা বিশ্বাস থেকে কথাটা বলছেন। অন্য রকম হলেই বিস্ময়কর হতো। একটু আগে প্রথম বলেই আউট হয়ে আসা ব্যাটসম্যানের মনে এই বিশ্বাস কীভাবেই বা থাকে?
বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে শুরু করার পর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অধিনায়ক বা দলের প্রতিনিধিকে সবচেয়ে বেশিবার যে প্রশ্নটির উত্তর দিতে হয়েছে, তা হলো: ‘এটিই কি টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে দিন?’ কাল আশরাফুলকেও দিতে হলো। যৌক্তিক প্রশ্ন। টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পর আড়াই ওভারের মধ্যে ৪ উইকেট নেই। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে! পারে, এর চেয়েও খারাপ হতে পারে।
ইনিংসের প্রথম বলেই স্লিপে ক্যাচ দিলেন জাভেদ ওমর। পরের ওভারে হাবিবুল বাশার উইকেটকিপারকে। পরের ওভারে পর পর দুই বলে শাহরিয়ার নাফীস ও মোহাম্মদ আশরাফুল আউট হয়ে ফেরার সময় স্কোরবোর্ডে মাত্র ৭। এর চেয়ে ভয়াবহ শুরু আর হতে পারত না। ভুল বলা হলো। টেস্ট ক্রিকেটে এর চেয়েও ভয়াবহ শুরুর বিস্তর উদাহরণ আছে। সবচেয়ে কম রানে ৪ উইকেট হারানোর রেকর্ডও এটি নয়। তা এই টেস্টে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষের। যে রেকর্ড সমান করা সম্ভব, কিন্তু ভাঙা নয়। কারণ ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লিডসের হেডিংলিতে ভারতের ৪ উইকেট পড়েছিল শূন্য রানে!
টেস্ট ইতিহাসে না হোক, বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে সূচনার উদাহরণ এটিই। বাংলাদেশের ৪৬টি টেস্টে সবচেয়ে কম রানে ৪ উইকেট পড়ার আগের ‘রেকর্ড’টি ছিল ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ১৩ রানে পড়েছিল ৪ উইকেট। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই আরেকবার ১৪ রানে ৪ উইকেট পড়েছিল। ২০০৪ সালে হারারে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের সেই ব্যাটিং বিপর্যয় মোহাম্মদ আশরাফুলের মনে থাকার কথা। টেস্টে প্রথম বলে আউট হওয়ার লজ্জায় যে সেবারই প্রথম ডুবতে হয়েছিল তাঁকে। টেস্টে আশরাফুলের ১০টি শূন্য, প্রথম বলে আউট হলেন কাল তৃতীয়বারের মতো (আরেকবার গত বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বো টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে)।
এ সবই কালকের দিনটির ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে তোলার মতো। তবে ঘটনা হলো, কাল মিরপুর স্টেডিয়ামে দুঃস্বপ্নের মতো দিনটিকেও ‘তুলনামূলক ভালো’ মনে করানোর মতো দিনের সঙ্গে বাংলাদেশকে বেশ কবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেট। এক ইনিংসে চার সেঞ্চুরিই যেমন। টেস্ট ক্রিকেটে কোনো দলের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি এটাই প্রথম। কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে এক ইনিংসে ৫টি সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ডই তো আছে (২০০১ সালে মুলতানে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তান)।
অবধারিত ফলোঅন বা ইনিংস পরাজয়ও যেমন বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে ভারতের পাহাড়প্রমাণ রান সেটিকে এখানে একটু বেশি ভীতিকর বলে মনে করাচ্ছে। ম্যাচের মাত্র দু দিন গেল, ফলোঅন এড়াতেই প্রয়োজন আরও ৩৫৩ রান। হাতে মাত্র ৫ উইকেট। রাজিন সালেহর সঙ্গে ৩৩ রানের জুটি গড়ে উইকেট পতনের স্রোতে বাঁধ দেওয়া সাকিব আল হাসান শেষ স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে ৩০ রানে অপরাজিত। মোহাম্মদ শরীফের বদলে রাজিন সঙ্গী থাকলে সাকিবের কালকের রাতটা একটু কম বিনিদ্র কাটত। সেটি হতে দেননি অনিল কুম্বলে। ৯ বলে ৩ উইকেট তুলে নেওয়া জহির খানের জায়গায় সিরিজে তাঁর প্রথম ওভার করতে এসেই রাজিনকে তুলে নিয়েছেন এই লেগ স্পিনার।
রাজিন-সাকিব দুজনই অবশ্য ভাগ্যের ছোঁয়া পেয়েছেন। স্লিপে দিনেশ কার্তিকের অতি-উত্সাহ বাঁচিয়েছে, নইলে কাল প্রথম ইনিংসের জন্য নির্ধারিত ২৬ ওভারেই বাংলাদেশের অলআউট হয়ে যাওয়াটা খুব বিচিত্র ছিল না। ১০ ওভার বাকি থাকতেই অবশ্য শেষ হয়ে গেছে খেলা। টেস্ট ক্রিকেটে আর কখনো দিনের খেলার সমাপ্তি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য এমন স্বস্তি নিয়ে আসেনি। মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার জন্য যে কারও তর সইছিল না। টসে জিতে ব্যাটিং-স্বর্গ উইকেটে প্রথম ব্যাটিং না করার ভুলটার সবচেয়ে বড় শাস্তি বলতে হবে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ১৫৩ ওভার ফিল্ডিং করা। এ কারণেই একের পর এক মিসফিল্ডিংয়ের কারণ খুঁজতে হচ্ছে না। কালও ক্যাচ পড়ল দুটি। শুধু ফিল্ডিংয়েই শেষ না হয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়েও সেই ক্লান্তির জের, দিনেশ কার্তিক পর্যন্ত যা স্বীকার না করে পারলেন না। তিনি নিজেই তো গত পরশু মাত্র ১২ রান দূরের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকে অনিশ্চিত করে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সেটিও নিজের পায়ে নয়।
কাল রাহুল দ্রাবিড় আউট হওয়ার পর নেমে কার্তিক সেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় ১২৯ রানে আউট হওয়ার পর দ্রাবিড়ের কোনো দুঃখ থাকার কথা নয়। না, দুঃখ আছে। দেড় বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার ভিনু মানকড় ও পংকজ রায়ের ৪১৩ রানের উদ্বোধনী জুটির বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার সুযোগ হারানোর দুঃখ। গত বছর লাহোরে একটি বাউন্ডারির দূরত্বে থাকতে তাঁকে হতাশায় ডুবিয়ে আউট হয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দর শেবাগ। কাল নিজে আউট হলেন বিশ্ব রেকর্ড থেকে ৫ রান দূরে থাকতে। পরিসংখ্যানবিদরা বোধ হয় খুশিই হয়েছেন তাতে। এখানে রেকর্ডটি হলে নিচে টীকা-ফীকা লাগত। এই উদ্বোধনী জুটির অংশীদার যে চারজন!
বাংলাদেশের বিপক্ষে ৬০০ রান এই প্রথম। গত বছর চট্টগ্রামে অস্ট্রেলিয়ার ৪ উইকেটে ৫৮১ রানের রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভারতের এই ৩ উইকেটে ৬১০। লাফিয়ে লাফিয়ে নয়, ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা এই রানের পাহাড়ে উঠল হামাগুড়ি দিয়ে। যে ব্যাটিং ড্র নিশ্চিত করার চেষ্টা বলে ভুল বোঝানোর মতো! একমাত্র ব্যতিক্রম মহেন্দ্র সিং ধোনি (৫০ বলে অপরাজিত ৫১)। কিছুদিন আগে হলেও যে কথাটা অবিশ্বাস্য শোনাত, এখন কারও কাছেই তা এমন কোনো বিস্ময় নয়—চার সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে সবচেয়ে ম্রিয়মাণ লাগল শচীন টেন্ডুলকারকে। টেস্টে তাঁর ৩৭তম সেঞ্চুরি, বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা তিন টেস্টে তৃতীয়। সেই সেঞ্চুরি এসেছে ২০০ বলে, যাতে মাত্র ৬টি চার ও ১টি ছয়। ৯৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় ফিফটি আরও শ্লথ, ১০১ বলে!
শচীন টেন্ডুলকার এখন যে ব্যাটিংটা করেন, তা দেখতে দেখতে আপনার মনে পুরাকীর্তি দর্শনের অনুভূতি জাগবে। ঐশ্বর্যময় স্বর্ণালি অতীতের কথা ভাববেন। কখনো কখনো দীর্ঘশ্বাসও পড়বে।
আরও পড়ুন:
প্রথম দিন: ভারতের চার ব্যাটসম্যান মিলে এক 'ওপেনিং জুটি'!
তৃতীয় দিন: ঘোর অন্ধকারে আশরাফুলকে মনে হচ্ছিল মায়াবী বিভ্রম!