বাংলাদেশ-ভারত দ্বিতীয় টেস্ট ২০০৭
ভারতের চার ব্যাটসম্যান মিলে এক `ওপেনিং জুটি`!
মিরপুর স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট-১
উৎপল শুভ্র
২৫ মে ২০২১
মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের টেস্ট অভিষেক সেদিন। কিন্তু উইকেট বুঝতে ভুল করে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ে পাঠানোতেই সব রোমাঞ্চের শ্রাদ্ধ। কোনো উইকেটই পড়ল না সারা দিনে, যার পেছনে ক্যাচ মিস আর আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তও রেখেছিল সামান্য ভূমিকা। উইকেট না পড়লেও ব্যাট করতে নেমেছিলেন ভারতের চার ব্যাটসম্যান!
প্রথম প্রকাশ: ২৬ মে ২০০৭। প্রথম আলো।
১ম দিনের শেষে
ভারত ১ম ইনিংস: ৩২৬/০
বুক পর্যন্ত নেমে আসা দাড়ি ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁকে বিশিষ্ট করে রাখার একটা কারণ হতে পারে। আসল কারণ নয়। ডব্লু জি গ্রেস অমর হয়ে আছেন তাঁর ক্রিকেটীয় কীর্তির কারণেই। ফ্রন্টফুট আর ব্যাকফুটে খেলার ধারণার জন্ম দিয়ে ব্যাটিং ব্যাকরণের প্রথম মাস্টার মশাই তিনি। সেটি সব সময় সবার মনে থাকে না। তবে টস নিয়ে তাঁর অমর উক্তিটির ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। ডব্লু জি গ্রেসের দিকনির্দেশনার বাইরে গিয়ে কোনো না কোনো অধিনায়ক প্রায়ই মনে করিয়ে দেন তাঁকে। কাল যেমন দিলেন হাবিবুল বাশার।
কী বলেছিলেন গ্রেস? ‘টসে জিতলে প্রথমে ব্যাটিং করো। সংশয় থাকলে একটু ভাবো, তারপর ব্যাটিং করো। তার পরও সংশয় দূর না হলে কোনো সতীর্থের সঙ্গে আলোচনা করো, তারপর ব্যাটিং করো।’ গ্রেসের এই কথা মনে রাখলে হাবিবুল বাশার টসে জিতে বোলারদের বধ্যভূমিসম মিরপুরের উইকেটে ভারতকে ব্যাটিং পাঠানোর ভুলটা করতেন না। দিনশেষে স্কোরবোর্ডে ৩২৬। ভারতের চারজন ব্যাটসম্যানকে যে মাঠে নামতে হলো, তাতে বাংলাদেশের বোলারদের কোনো ভূমিকা নেই। দুই ভারতীয় ওপেনারকে অবসর নিতে বাধ্য করেছে প্রথম দিনের একমাত্র ‘সফল বোলার’ গরম আর আর্দ্রতা।
সংবাদ সম্মেলনে ডেভ হোয়াটমোরকে আসতে দেখে সাংবাদিকরা একটু নড়েচড়ে বসলেন। অধিনায়কের পরিবর্তে কোচ—বিষেন সিং বেদির মতো বিস্ফোরক কিছু যদি শোনা যায়! টেস্ট ক্রিকেটে টসে জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর সবচেয়ে বিখ্যাত ভুলটি ১৯৯০ সালের লর্ডস টেস্টে। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের কাছ থেকে ওই ‘উপহার’ পাওয়ার পর ইংল্যান্ড প্রথম দিন শেষ করে ২ উইকেটে ৩৫৯ রানে। ভারতীয় দলের কোচ বিষেন সিং বেদি প্রথম সুযোগেই জানিয়ে দেন, ওটা ছিল অধিনায়কের একার সিদ্ধান্ত। তিনি নিজে ব্যাটিং করারই পক্ষে ছিলেন।
হোয়াটমোর বেদির মতো কিছু বলতে পারেন—এটি ভাবলে ভেবেছেন ভারতীয় সাংবাদিকরা। বাংলাদেশ দল সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তাঁদের এটা ভালো করেই জানা যে, বাংলাদেশ-অধিনায়কের এখনো কোচের মতামত অগ্রাহ্য করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস নেই। এই সিদ্ধান্তে ডেভ হোয়াটমোরের বড় একটা ভূমিকা না থেকে পারেই না। হোয়াটমোর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচতে সহজ পথ বেছে নিলেন। স্বীকার করে ফেললেন, উইকেট বুঝতে তাঁদের ভুল হয়েছে।
তাঁদের’ বলতে কোচ, অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ককে নিয়ে গড়া টিম ম্যানেজমেন্ট। যা খবর পাওয়া গেল, প্রথমে ফিল্ডিংয়ের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো মত ছিল হোয়াটমোরেরই। উইকেটে আর্দ্রতা আছে, আছে বাড়তি গতি আর বাউন্সও—কিউরেটরের এই কথায় প্রভাবিত কোচ এমন সব যুক্তি দিতে থাকেন যে, অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক আর উচ্চবাচ্য করেননি। দুজনই ব্যাটসম্যান—প্রথমে ব্যাট করার বিপদ সম্পর্কে কোচকে এমন নিশ্চিত দেখে তাঁরা আর সে পথে হাঁটতে চাইবেন কেন?
পরে এই ভুলের জন্য ডেভ হোয়াটমোর দলকে একাধিকবার ‘স্যরি’ বলেছেন। সেটির সাধ্য কী হাবিবুল বাশারের মাথার ওপর চেপে বসা পাহাড়প্রমাণ ভারটা কমিয়ে দেয়! এই টেস্ট ম্যাচ যে এখন দুঃস্বপ্নের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য। প্রথম দিনে ব্যাটিং-স্বর্গ মনে হওয়া উইকেটও পরের দিকে ভাঙতে বাধ্য। তাতে চতুর্থ ইনিংসে অনিল কুম্বলেকে খেলার কঠিনতম চ্যালেঞ্জটি নিতে হচ্ছে নিজেদের ভুলেই। চতুর্থ ইনিংস! ভারত রানের যে পাহাড় গড়তে যাচ্ছে, তাতে এই টেস্টে চতুর্থ ইনিংস বলে কিছু থাকার সম্ভাবনা বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ট্রিপল সেঞ্চুরি করার সমান বলে মনে হচ্ছে।
লর্ডসে আজহারউদ্দিনকে পুড়িয়েছিল গ্রাহাম গুচের ৩৩৩। আজহার অবশ্য বলতেই পারতেন, ৩৬ রানে উইকেটকিপার কিরণ মোরে ক্যাচ ফেলে না দিলে তো আর গুচের ৩৩৩ হয় না। হোয়াটমোরও বলতে পারেন, সৈয়দ রাসেলের বলে স্লিপে সাকিব আল হাসান দিনেশ কার্তিকের ক্যাচটি না ফেললে তো ভারত ১৮ রানেই প্রথম উইকেট হারিয়ে ফেলে। ৪২ রানে ওয়াসিম জাফরের দেওয়া সহজতম রিটার্ন ক্যাচটি মোহাম্মদ রফিক ফেলে না দিলেও তো দিনটি এমন দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকে না। বলতে পারতেন আম্পায়ার ড্যারিল হার্পারের আবারও বাংলাদেশের মনস্তাপের কারণ হয়ে ওঠার ঘটনাটিও। খালেদ মাসুদের গ্লাভসে যাওয়ার আগে বল দিনেশ কার্তিকের ব্যাটে লাগলেও হার্পার নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কার্তিক তখন ৭৪। আর ৮ রান করার পরই প্রচণ্ড গরমে পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে চ্যাংদোলা হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে কার্তিককে।
ওয়াসিম জাফরও মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন একই কারণে। তবে তার আগে ১৩৮ রান করে মুছে দিয়েছেন চট্টগ্রাম টেস্টে ‘পেয়ার’ পাওয়ার দুঃস্বপ্ন। চট্টগ্রামের ‘পেয়ার’ ঢাকা টেস্টে তাঁর খেলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত যে জাফর খেললেন, কে জানে, তাতে মুম্বাই থেকে দিলীপ ভেংসরকারের টেলিফোনের কোনো ভূমিকা আছে কি না! ভারতের প্রধান নির্বাচক যে জানেন, একটা ‘পেয়ার’ পাওয়া মানেই সব শেষ নয়, পরের টেস্টেই আসতে পারে সেঞ্চুরি। তিনি নিজেই তো তা করেছিলেন। দিলীপ ভেংসরকার ও ওয়াসিম জাফর ছাড়া এক টেস্টে ‘পেয়ার’ পেয়ে পরের টেস্টে সেঞ্চুরি করার কীর্তি আছে আর মাত্র ১৩ জন ব্যাটসম্যানের।
ভেংসরকারের সঙ্গে জাফরের এর চেয়েও বড় মিল। এই সিরিজের আগে কেপটাউনে খেলা সর্বশেষ টেস্টটিতে সেঞ্চুরি করেছেন জাফর। তাঁর আগে টেস্ট ইতিহাসে মাত্র যে দুজনের পেয়ারের আগে-পরে সেঞ্চুরি ছিল, তাঁদের একজন দিলীপ ভেংসরকার। অন্যজন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরি ও ডাবল সেঞ্চুরির মালিক ক্লিফোর্ড রোচ। ১৯২৯-৩০ সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রিজটাউনে ১২২ ও ৭৭ রানের দুটি ইনিংস খেলার পর পোর্ট অব স্পেনে পরের টেস্টে ‘পেয়ার’। তা পেয়ে রোচ এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে, নিজে থেকেই সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন পরের টেস্ট থেকে। শেষ পর্যন্ত খেলেন এবং করেন ২০৯।
৪৬ টেস্টের ইতিহাসে সারা দিনে বাংলাদেশের একটিও উইকেট ফেলতে না পারার মাত্র দ্বিতীয় ঘটনা এটি। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক রুডলফ ও বোটা ডিপেনার অবিচ্ছিন্ন ছিলেন পুরো দ্বিতীয় দিন। কাল এর পুনরাবৃত্তিতে বাংলাদেশের জঘন্য ফিল্ডিংয়ের মতো হাবিবুল বাশারের ক্যাপ্টেনসিরও বড় ভূমিকা। কী যে ফিল্ড সাজালেন, অনেক সময়ই তার মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা গেল না। জাফর যখন ৯৭ রানে, তখনো ক্লোজ ইন ফিল্ডার রেখে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। ফিল্ডারদের কেন সামনে আনছেন আর একটু পর কেনই বা ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তা বোধগম্য হওয়াটাও একটু কঠিনই হলো। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর থার্ডম্যানে ফিল্ডিং করা। প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে থার্ডম্যানে দাঁড়াতে দেখে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও নাকি মহা-আশ্চর্য হয়েছেন।
দিনশেষে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে পেরেছেন বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড়ই। মাশরাফি বিন মুর্তজা। প্রথম স্পেল: ৫-১-৬-০। দ্বিতীয় স্পেল: ৩-২-১-০। লাঞ্চের পর তৃতীয় স্পেলের সময় অ্যাঙ্কেলে চোট পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তা ১.৪-০-১৬-০। বিকেলে ৫-১-৮-০ শেষ স্পেলটিতেও বেশ কবার কাঁপিয়ে দিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকারকে।
এমন উইকেটে মাশরাফিও এর বেশি আর কী-ই বা করবেন!
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় দিন:টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়দের বিশ্ব রেকর্ডের পর আশরাফুলদের 'বাংলাদেশি রেকর্ড'!
তৃতীয় দিন: ঘোর অন্ধকারে আশরাফুলকে মনে হচ্ছিল মায়াবী বিভ্রম!