বাংলাদেশ-ভারত দ্বিতীয় টেস্ট ২০০৭
ঘোর অন্ধকারে আশরাফুল যেন মায়াবী বিভ্রম!
মিরপুর স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট-৩
উৎপল শুভ্র
২৫ মে ২০২১
একদিনেই ১৫ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ হেরে গেল তিন দিনেই। ডেভ হোয়াটমোর বিদায়ী উপহারের বদলে পেলেন আরও একটা ইনিংস পরাজয়। তবে সব ছাপিয়ে শেষ দিনের হাইলাইট হয়ে রইলেন মোহাম্মদ আশরাফুল, তাঁর ৪১ বলে ৬৭ রানের ইনিংসটা এমনই চোখ ধাঁধানো যে, ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসে যেটিকে মনে হচ্ছিল মধ্য দুপুরের মায়াবী বিভ্রম!
প্রথম প্রকাশ: ২৮ মে ২০০৭। প্রথম আলো।
ভারত ১ম ইনিংস: ৬১০/৩ ডিক্লে. বাংলাদেশ: ১১৮ ও ২৫৩ ফল: ভারত ইনিংস ও ২৩৯ রানে জয়ী
‘আমরা কি সত্যিই তাঁকে দেখেছি! নাকি পুরোটাই ছিল মধ্যদুপুরে দেখা এক বিভ্রম।’ রঞ্জি সম্পর্কে লিখেছিলেন নেভিল কার্ডাস। শূন্য মিরপুর স্টেডিয়ামকে সামনে রেখে এই ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে বসেও মনে হচ্ছে, সত্যিই কি আমরা মোহাম্মদ আশরাফুলের ওই ইনিংসটি দেখেছি! না কি পুরোটাই ছিল মধ্যদুপুরের বিভ্রম!
৪৬ মিনিট উইকেটে থেকে ৪১ বলে ৬৭। হায়! কখনো কখনো পরিসংখ্যানকে কী অর্থহীনই না মনে হয়! এর সাধ্য কী বোঝায়, আশরাফুল যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ শুধু আশরাফুলই ছিলেন। যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, এই ম্যাচের বাকি সবকিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়ে সত্যি হয়ে ছিল শুধুই একটা ঘোর। যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, বিশ্বকাপের মায়াবী চশমা খুলে ফেলে টেস্ট ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতায় ফিরে আসার ধাক্কাও আর গায়ে লাগছিল না। যতক্ষণ আশরাফুল ছিলেন, এই টেস্টে প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছিল বাংলাদেশেরও বিশ্বকে দেখানোর কিছু আছে।
এক দিনে ১৫ উইকেট হারিয়ে ইনিংস ও ২৩৯ রানে পরাজয়ের লজ্জার মধ্যে বাংলাদেশের দেখানোর থাকল শুধু আশরাফুলই। ওহো, মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা কীভাবে ভুলে গেলাম! কালই প্রথম আলোর স্টেডিয়ামে ছাপা হওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিজেকে তিনি অলরাউন্ডার মনে করেন না। মাশরাফি মনে না করলেই কী, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যে তাঁকে অলরাউন্ডার বানিয়েই ছাড়ছেন। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৯২ বলে ৭৯ রানের পর কাল দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৮ বলে ৭০। টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের চার ইনিংসের যে তিনটিতে ব্যাটিং করেছেন, তার দুটিতেই সর্বোচ্চ স্কোরারের নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা। সন্দেহাতীত সেরা বোলার তো বটেই। সংবাদ সম্মেলনে ভারতের ক্রিকেট ম্যানেজার রবি শাস্ত্রীকে পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত দেখাল এবং শাস্ত্রীর সেই মাশরাফি-প্রশস্তি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই।
আশরাফুল বলা হয়ে গেল। মাশরাফিও। এই টেস্টে বাংলাদেশের সবই তো বলা হয়ে গেল। আর যা বাকি থাকল, তার সবই কষ্টের, লজ্জার, অপমানের। যা ভুলে যেতে পারলেই ভালো। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে ডেভ হোয়াটমোরের শেষ টেস্ট। মাঝখানে কিছু সুখস্মৃতি তো আছেই, সেসবের স্মৃতিচারণাও করলেন। কিন্তু ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সমীহযোগ্য এক দল হয়ে ওঠার তৃপ্তির সঙ্গে এই আক্ষেপটাও হোয়াটমোরের সঙ্গী না হয়ে পারে না যে, চার বছর আগে শুরুর সময় টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে যেখানে দেখেছিলেন, বিদায়বেলায়ও সেখানেই দেখে গেলেন। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোয়াটমোর-যুগের প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ১৩২ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ‘বিদায়ী উপহার’ হিসেবেও পেলেন সেই ইনিংস পরাজয়ই।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শেষ করে পরের টেস্ট সিরিজ ১৩ মাস পর জেনে হাবিবুল বাশার বলেছিলেন, ‘আবার আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।’ তা এই টেস্টে বাংলাদেশকে ৪৬তম টেস্টের বদলে প্রথম টেস্টের দলের মতোই দেখাল। ১৩ মাস টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় নেই, মাঝের সময়টায় ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও বলতে গেলে খেলাই হয়নি, ওয়ানডের স্রোতে ভেসে যাওয়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা টেস্ট ম্যাচেও তাই ‘ওয়ানডে’ই খেলল! প্রথম ইনিংস স্থায়ী হলো ৩৭.২ ওভার, দ্বিতীয় ইনিংসের আয়ু ৫৭.৩ ওভার। কবে যে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটটা খেলতে শিখবে!
আশরাফুল বলা হয়ে গেছে লিখেছি। সব কি বলা হলো! নেমেছিলেন ১০ রানে ৩ উইকেট পড়ার পর। সেই তিন উইকেটের প্রথমটি জাভেদ ওমর। যাকে নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে দুই ইনিংসেই প্রথম বলে আউট হয়ে ‘কিং পেয়ার’ পাওয়া ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা ১১ হয়ে গেল। কোনো দলের এক টেস্টের দুই ইনিংসেই প্রথম বলে উইকেট হারানোর প্রথম ঘটনাটিও হয়ে গেল এতেই। রেকর্ডবুকে এটি থাকবে, তবে সুবিচার হয় পাশে আম্পায়ার ড্যারিল হার্পারের নামটিও লেখা থাকলে। জাভেদের ব্যাটে না লাগার পরও যে কট বিহাইন্ড দিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার! এই টেস্ট সিরিজে বিলি ডকট্রোভের সঙ্গে যার যুগলবন্দী বাংলাদেশ দলের চেয়েও জঘন্য পারফরম্যান্স ‘উপহার’ দিয়েছে।
ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কাল জানালেন, কিন্তু সিদ্ধান্তটা আগেই নিয়ে রেখেছিলেন হাবিবুল বাশার। টেস্ট সিরিজের শুরুতেই বলছিলেন, ক্যারিয়ারে আর কখনো এমন চাপের সঙ্গে পরিচয় হয়নি তাঁর। উইকেটটিও হয়তো যতটা না জহির খান, তার চেয়ে বেশি সেই চাপই নিল। টেস্টে হাবিবুলের প্রায় তিন হাজার রানের বেশির ভাগই যে পুলে, সেটি মারতে গিয়েই কাল মিড অনে ক্যাচ।
মোহাম্মদ আশরাফুল টেস্ট-ব্যাটসম্যান হাবিবুলের বড় ভক্ত। ‘সুমন ভাই কী শটই না খেলে’—অনেকবারই শুনেছি তাঁর মুগ্ধতামাখা এ কথা। ওয়ানডে-অধিনায়ক হিসেবে ‘সুমন ভাই’য়ের উত্তরসূরি কাল আবারও দেখালেন, তাঁর দিনে শুধু ‘সুমন ভাই’ নয়, নির্ভেজাল ক্রিকেটিং শট খেলায় বিশ্বের কারও চেয়েই তিনি কম যান না। রাজিন সালেহর সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে ৮১ রান, যার ৬৭-ই আশরাফুলের। ২৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি অল্পের জন্য জ্যাক ক্যালিসের দ্রুততম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড (২৪ বলে) ভাঙতে পারেনি, তবে মিনিটের হিসেবে ইংল্যান্ডের জেটি ব্রাউনের ১১৩ বছরের পুরনো রেকর্ডটি ঠিকই ভেঙেছে। ৯টি চার আর ২টি ছয়ে হাফ সেঞ্চুরি করতে আশরাফুলের লেগেছে মাত্র ২৭ মিনিট। ১৮৯৪-৯৫ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে ব্রাউনের হাফ সেঞ্চুরি করতে এক মিনিট বেশি লেগেছিল।
আশরাফুলের মতো টেস্টে ২৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি আছে ইয়ান বোথাম ও শহীদ আফ্রিদিরও। তবে বোথাম-আফ্রিদির ইনিংসে শুদ্ধ ব্যাটিংয়ের এমন জয়জয়কার থাকতেই পারে না। যে সিরিজটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, সেটিতে আগের দুই ইনিংসে কিছুই করতে না পারার রাগ থেকেই কি অমন ব্যাটিং? অথচ আশরাফুল নির্বিকার ভঙ্গিতে জানাচ্ছেন, ‘ওগুলো মারারই বল ছিল।’
শেষ পর্যন্ত ঢাকা টেস্ট থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বলতে আশরাফুলের এই ইনিংসটিই। মাশরাফি বিন মুর্তজার কথাও একটু মনে রাখুন। বাকি সব ভুলে যেতে পারলেই ভালো। সেখানে যে শুধুই অন্ধকার। তা এমনই নিকষ যে, সংশয় জাগছে, সত্যিই কি আমরা আশরাফুলের ওই ইনিংসটি দেখেছি! নাকি পুরোটাই মধ্যদুপুরের বিভ্রম!
আরও পড়ুন:
প্রথম দিন: ভারতের চার ব্যাটসম্যান মিলে এক 'ওপেনিং জুটি'!
দ্বিতীয় দিন:টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়দের বিশ্ব রেকর্ডের পর আশরাফুলদের 'বাংলাদেশি রেকর্ড'!