মহানায়কের শেষ টেস্ট-৩
৬২-র স্বপ্নে বিভোর ভারত
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
শচীন...শচীন...শচীন!!! বগলে ব্যাট, মাথায় তেরঙা খচিত হেলমেট—দুই যুগ ধরেই ভারতের মাঠে মাঠে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির উইকেট-যাত্রায় সঙ্গী এই চিৎকার। ধেত্, সেসবের সঙ্গে কি এর তুলনা চলে নাকি! সেসবে শুধু প্রত্যাশা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আর এখানে বাঁধনহীন আবেগ।
প্রথম প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর, ২০১৩। প্রথম আলো।
মুরালি বিজয় আউট হওয়ার পর গ্যালারি থেকে যে উল্লাসধ্বনিটা উঠল, তাতে কারও মনে হতেই পারত খেলাটা বোধ হয় ব্রিজটাউন বা কিংস্টনে হচ্ছে!
কিন্তু হাতে হাতে তো সবার তেরঙাই দুলছে! সঙ্গে কোরাসের মতো একটাই চিত্কার। ড্রেসিংরুম থেকে নেমে আসার সিঁড়িতে ছোটখাটো শরীরটা দৃশ্যমান হওয়ামাত্র যেটি উত্তুঙ্গ ছুঁল। শচীন...শচীন...শচীন!!! বগলে ব্যাট, মাথায় তেরঙা খচিত হেলমেট—দুই যুগ ধরেই ভারতের মাঠে মাঠে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির উইকেট-যাত্রায় সঙ্গী এই চিৎকার। ধেত্, সেসবের সঙ্গে কি এর তুলনা চলে নাকি! সেসবে শুধু প্রত্যাশা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আর এখানে বাঁধনহীন আবেগ। অমর মহাকাব্যের শেষ অঙ্কটা ক্রিকেট-বিধাতা কীভাবে লিখে রেখেছেন, সেটি তো আর কারও জানা নেই। কে জানে, হয়তো এই শেষবার, শেষবারের মতো তিনি ব্যাটিংয়ে নামছেন।
মাঠে নেমে অভ্যাসমতো আকাশের দিকে তাকালেন একবার। দৃষ্টিটা নামিয়ে ফেলতে হলো দ্রুতই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা যে তাঁকে গার্ড অব অনার দিতে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে গেছেন। এটা নতুন কিছু নয় এবং পূর্ব-অনুমিতই। ১৯৪৮ সালে ওভালে নরম্যান ইয়ার্ডলির ইংল্যান্ড ডন ব্র্যাডম্যানকে দিয়েছিল। শচীন টেন্ডুলকার নিজেও একবার দিয়েছেন। সিডনিতে বিদায়ী টেস্টে স্টিভ ওয়াহকেও বাকি দলের সঙ্গে। নতুন যা যোগ হলো, দুই আম্পায়ারও দেখা গেল দাঁড়িয়ে গেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের পাশে!
ড্যারেন স্যামির দল শুধু তালিই দিল। নরম্যান ইয়ার্ডলির দল টুপি খুলে থ্রি চিয়ার্স দিতে দিতে প্রায় উইকেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল ডনকে। এরিক হলিসের দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হয়ে যাওয়ায় গুগলি পড়তে না পারার চেয়ে ডনের আবেগে ভেজা চোখের বড় ভূমিকা দেখেন অনেকে। ডন যেটিকে পরে হেসে উড়িয়ে দেন।
ব্র্যাডম্যান তাঁর ব্যাটিংয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন। এই প্রথম তাঁর ‘ব্র্যাডম্যান’ না হওয়ার লড়াই। বলটা মাঝব্যাটেই খেললেন। পুরো মাঠ যেন একসঙ্গে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
টেন্ডুলকার-বন্দনা গার্ড অব অনারেই শেষ হয়ে সেটি দ্রুতই রূপ নিয়েছে ‘যুদ্ধে’। স্লিপ-সিলি পয়েন্ট-ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ-ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগ দিয়ে টেন্ডুলকারকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্রথম বলেই ‘ক্যাচ ইট’ বলে চিত্কার উঠল। মুহূর্তের জন্য থেমে গেল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের হূত্স্পন্দন। বলটা যে টেন্ডুলকারের ব্যাটে লেগে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে যাওয়ার আগে মাটি ছুঁয়ে গেছে, গ্যালারি থেকে তাৎক্ষণিক তা বোঝার উপায় কী! এবার সেই দ্বিতীয় বল এবং টেন্ডুলকার তখনো শূন্য! উপচে পড়া অর্জনের ডালিতে একটা ফুল বরাবর টেন্ডুলকারের মনে সবচেয়ে বেশি সুবাস ছড়িয়েছে। ব্র্যাডম্যান তাঁর ব্যাটিংয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন। এই প্রথম তাঁর ‘ব্র্যাডম্যান’ না হওয়ার লড়াই। বলটা মাঝব্যাটেই খেললেন। পুরো মাঠ যেন একসঙ্গে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
শিলিংফোর্ডের পরের ওভারের প্রথম বলেই ‘ব্র্যাডম্যান’ হওয়ার শঙ্কা দূর। এই টেস্টকে ঘিরে আরও অনেক ‘প্রথম’-এর সঙ্গে যোগ হলো এটাও। ব্র্যাডম্যান হওয়াটাকে ‘শঙ্কা’ মনে হওয়ার ঘটনাও তো ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম। ডিপ স্কয়ার লেগে বল পাঠিয়ে একটা সিঙ্গেলই শুধু পেলেন। কিন্তু তাতেই যে হর্ষধ্বনিটা উঠল, সেঞ্চুরির পরও অনেক ব্যাটসম্যানের ভাগ্যে তা জোটে না।
সকালে ম্যাচ শুরুর সময় স্টেডিয়ামে মেরেকেটে হাজার পাঁচেক দর্শক। টেন্ডুলকার ব্যাট করতে নামার সময় যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সেই দর্শকেরা যখন নাতি-নাতনির সঙ্গে স্মৃতিচারণা করবেন, সম্ভবত এটাও বলবেন যে, পুরো সময়টা কেমন উৎকণ্ঠায় কেটেছিল! একটা বল, একটা বলই যে শেষ করে দিতে পারে শেষবারের মতো টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখার সুযোগ।
এমন নয় যে, টেন্ডুলকারের ব্যাটের কোনো অবদান ছিল সেই উৎকণ্ঠার। বরং উইকেটে কাটানো এক শ মিনিটের মতো সময়ে তাঁকে এমনই সাবলীল দেখাল, নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসল সবাইকে। স্যামিকে মিড অন ঘেঁষে মারা স্ট্রেট ড্রাইভটা মনে করিয়ে দিল সেরা সময়ের টেন্ডুলকারকে। এটাই তাঁর সিগনেচার শট, একবার যা মেরে মেরে শারজায় চামিন্ডা ভাসকে প্রায় কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন। ভাসের ‘অপরাধ’ ছিল, আগের দিন কাকে যেন বলেছিলেন টেন্ডুলকার স্ট্রেট ড্রাইভ মারতে গেলে বল উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটি টেন্ডুলকারের কানে পৌঁছে যায় এবং পরদিন সেঞ্চুরির পথে তিনি ‘স্ট্রেট ড্রাইভ কত প্রকার ও কী কী’ ভাসকে তা বুঝিয়ে দেন।
ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট নিয়েও সম্ভবত উন্মাদনা ছিল। তবে ওয়াংখেড়ের তুলনায় সেটি যে এক শতাংশও নয়, এটি লিখতে ‘সম্ভাবনা’ শব্দটা একদমই ব্যবহার করতে হচ্ছে না। প্রথমত সেটি ছিল পরভূমে, মিডিয়াও তখন এমন সর্বব্যাপী হয়ে ওঠেনি। এমন ‘হাইপ' ওঠার তাই প্রশ্নই ওঠে না। সবচেয়ে বড় পার্থক্য, সেখানে টেস্ট ম্যাচটাই মুখ্য ছিল। এখানে যা হয়ে উঠেছে টেন্ডুলকারের ‘বিদায় সংবর্ধনা।’
সকাল থেকেই যেটির উদযাপন শুরু। ম্যাচ শুরুর আগে ভারতীয় বোর্ড সভাপতি বিশেষ একটা স্মারক উপহার দিলেন। চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা টেন্ডুলকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অটোগ্রাফসংবলিত ফ্রেমে বাঁধানো জার্সি। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ‘২০০’ খচিত ক্যাপ। পরিচিত সেই ফ্লপি হ্যাটের বদলে টেন্ডুলকার যেটি মাথায় দিয়ে ফিল্ডিং করতে নামলেন। একটু আগেই টসে জিতেছেন ধোনি। সেই টসের মুদ্রাতেও টেন্ডুলকারের মুখ।
টেনশন সহ্য করতে না পারা বা সংস্কার, যে কারণেই হোক, টেন্ডুলকারের পরিবার কখনো টেলিভিশনে তাঁর লাইভ ব্যাটিং বলতে গেলে দেখেইনি। আর এখানে পুরো পরিবার স্টেডিয়ামে উপস্থিত। মা রজনী টেন্ডুলকার এই প্রথম ছেলের খেলা দেখতে মাঠে। দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর উদ্দেশেই কি ব্যাটটা তুললেন! ৩৮ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়ার সময় ব্যাট তোলাও তো এই প্রথম।
ওয়াংখেড়ে যতই টেন্ডুলকারের ছবির প্রদর্শনী হয়ে যাক, বাকি মুম্বাইয়ে আবেগের ঢেউ না দেখতে পাওয়াটা বড় বিস্মিত করেছিল। সেই আবেগ যেন লাভাস্রোত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বিকেল নাগাদ। সন্ধ্যায় স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার পথে ‘থার্টি এইট’ সংখ্যাটা অনেকবার কানে এল। দু-একবার ‘সিক্সটি টু মোর’-ও!
ব্র্যাডম্যানের জন্য সংখ্যাটা ছিল ‘৪’, টেন্ডুলকারের জন্য এখন যা ‘৬২’। টেস্টের আগের দিন টেন্ডুলকারের অভিষেক টেস্ট কাভার করা সাংবাদিকদের একজন তাঁকে বলছিলেন, ‘৫২ নম্বর সেঞ্চুরিটা করো। এটিই ডনকে শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে ভালো উপায়। বলতে পারবে, ডন ৫২ টেস্ট খেলেছেন, তাঁর প্রতিটি টেস্টের জন্য আমার একটি সেঞ্চুরি।’
শচীন টেন্ডুলকার একা নন, পুরো ভারতেরই আজ ঘুম ভাঙবে ওই সেঞ্চুরির স্বপ্ন চোখে। দল-দেশ ছাপিয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে এমনই একাকার তাঁর নাম যে, কখনো কখনো এই অবাস্তব চিন্তাটাও মনে আসছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজও তা চাইছে না তো!
মহানায়কের শেষ টেস্ট-১
মহানায়কের শেষ টেস্ট-২
মহানায়কের শেষ টেস্ট-৪
মহানায়কের শেষ টেস্ট-৫
মহানায়কের শেষ টেস্ট-৬