ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৫
উৎপল শুভ্র
২০ মার্চ ২০২১
স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম ধাপ ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়। সেদিস থেকেই রং লেগেছিল টেস্ট খেলার স্বপ্নে। যে স্বপ্ন পূরণ হলো ২০০০ সালের নভেম্বরে। সূচনা বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন অধ্যায়ের। দল নির্বাচন নিয়ে নাটক থেকে শুরু করে সেই টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টও তাই বারবার পড়ার মতোই এক সুখস্মৃতি।
প্রথম প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০০০। প্রথম আলো।
এ যেন পরপর তিন দিন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া! স্বপ্নও কি সব সময় এত সুন্দর হয়? বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে, কখনো কখনো হয়তো নিজেদেরও বিস্মিত করে স্মরণীয় থেকে স্মরণীয়তর করে তুলছে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক লগ্নটিকে। টেস্টের এখনো দুদিন বাকি, তাতে নাটকীয় কিছু ঘটে গেলে ভিন্ন কথা, তবে রোববার, তৃতীয় দিন শেষে ড্রেসিংরুমের বাইরে বিষণ্ন সৌরভ গাঙ্গুলীর হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল আগামীকাল ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের অভিষেকটিকে বলা যাবে ‘স্মরণীয়তম’ই। আর মাত্র দুটি দিন, স্বপ্নটা যেন ভেঙে না যায়!
শুক্রবার প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ২৩৯, খুশির একটা হিল্লোল বয়ে গেল দেশজুড়ে। দিন শেষে কোচ সরওয়ার ইমরান যখন বললেন, ‘কাল রাতেই দলকে বলেছি টসে জিতে প্রথম ব্যাট করলে আমাদের টার্গেট ৪০০’, অনেকেই মুখ টিপে হাসলেন। শনিবার দ্বিতীয় দিন লাঞ্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি উইকেটও পড়ল না, রান হয়ে গেল ৩০২। চা-বিরতির কাছাকাছি গিয়ে বাংলাদেশ যখন অলআউট হলো, স্কোরবোর্ডে রান ঠিক ৪০০। এবার মুখ টিপে হাসলেন সরওয়ার ইমরান। রোববার তৃতীয় দিন শেষে ভারত ৭ উইকেটে ৩৬৬, টেন্ডুলকার-দ্রাবিড়-গাঙ্গুলীর মতো ব্যাটসম্যান যে দলে, তারা প্রথম ইনিংসে লিড নিতে পারবে কিনা, এ নিয়ে মহাচিন্তিত দেখাল ভারতের বিদায়ী কোচ অংশুমান গায়কোয়াড়কে। নৈতিক জয়টা কি পেয়ে যায়নি বাংলাদেশ?
অথচ অভিষেক টেস্ট নিয়ে গত কিছুদিনের আলোচনায় অনেক কথাই ঘুরেফিরে এসেছে, কিন্তু এই ‘জয়’ শব্দটা উচ্চারিত হয়নি একবারও। টেস্টের যেটি পঞ্চম দিন, সেদিনের বিকেলে সৌরভ গাঙ্গুলীকে প্রধান অতিথি করে কলকাতার এক শিল্পপতির কী এক অনুষ্ঠানের কার্ড নাকি বিলি হয়ে গেছে বেশ কদিন আগেই। টেলিফোনে সৌরভ কি সেসব ফিরিয়ে নিতে বলেছেন?
সৌরভের কী দোষ, বাংলাদেশই তো কাঁপছিল তিন দিনের মধ্যে টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। কে জানত, অনেকের ভাষায় ‘ফুরিয়ে যাওয়া’ আমিনুল ইসলাম বুলবুল তার অভিষেক টেস্টে ৯ ঘণ্টা ব্যাট করবেন? কে ভেবেছিল ১৮৭৭ সালে ইতিহাসের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান আর ’৯২ সালে জিম্বাবুয়ের ডেভ হটন নিজ দেশের অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরির যে কীর্তি গড়েছিলেন, সেই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করে অমরত্ব পেয়ে যাবেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক!
তিন দিন ধরে সব ‘ভালো’ যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করতে। নইলে তুলনায় অনেক দুর্বলতর সব দলের বিপক্ষে খেলা ১০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচেও যেখানে বাংলাদেশের ৪০০ রানের ইনিংস (সর্বোচ্চা ৩১৫/৮ ডিক্লে., বিপক্ষ ইংল্যান্ড ‘এ’, চট্টগ্রাম, ১৯৯৯) নেই, পাঁচ স্পেশালিস্ট বোলার নিয়ে নামা ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসটিই কীভাবে ৪০০ হয়ে যায়? কীভাবে রফিক, হাসিবুলের ব্যাটও ঝলসে ওঠে, শেষ ৩ উইকেটে ৬৬ রান তুলে ফেলে নবীন একটি দল? প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও বাংলাদেশের কারও নয় ঘণ্টা ব্যাট করার কৃতিত্ব নেই, অথচ আমিনুল অনেক বছর টেস্ট ক্রিকেটের অন্ধিসন্ধি চেনা এক ব্যাটসম্যানের মতো কী স্বচ্ছন্দেই না উত্তর দিয়ে দিলেন ভারতীয় বোলারদের ছুড়ে দেওয়া সব প্রশ্নের! প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেই বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসটি ১৪৩ রানের (হাবিবুল বাশার, চট্টগ্রামে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষেই), অথচ আমিনুল ইসলাম টেস্টে খেলে ফেললেন ১৪৫ রানের ইনিংস!
প্রতিপক্ষের ব্যাটিং শক্তিমত্তা আর নিজেদের বোলিং দুর্বলতা মিলে যে দুশ্চিন্তা, সেটিই একজন বোলার কমিয়ে অতিরিক্ত একজন ব্যাটসম্যান ঢুকিয়েছিল বাংলাদেশ দলে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, এই উইকেটে ভারতকে দুবার ব্যাট করানো সম্ভব নয়, তার চেয়ে বরং নিজেরা দুবার অলআউট না হওয়ার বন্দোবস্ত করি। তিন স্পেশালিস্ট বোলারের সঙ্গে অধিনায়ক নাঈমুর রহমান, স্পেশালিস্ট অফ স্পিনার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বলতে গেলে কাকুতি-মিনতি করতে হয়েছে যাকে। ভারতের বিপক্ষে এই বোলিং, যে দলের চারজন ব্যাটসম্যানের গড় ৫০-এর আশপাশে! রানের বন্যা বয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ‘ক্রিকেট পণ্ডিত’রা! বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রতিপক্ষ ভারত-এটা শোনার পর থেকে ৩৭৫ রানের রেকর্ড হারানোর দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করেছিলেন ব্রায়ান লারা। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট সমচ্চার্কে বলতে গিয়ে স্টিভ ওয়াহ রসিকতা করেছিলেন-‘শচীন টেন্ডুলকার চারশ করে ফেলবে কিনা, এটা জানতে চাইছ?’ বাংলাদেশের সেই বোলাররাই কাল অবাক করে দিল ক্রিকেট বিশ্বকে।
বোলারদের সবাই দারুণ বোলিং করেছেন, তবে তারপরও আলাদা করে বলতে হবে নাঈমুর আর রফিকের কথা। কাল এক দিনেই ৩৩ ওভার করে বল করেছেন তারা দুজন। ক্যারিয়ারেই কখনো এমন ধকল নিতে হয়নি তাদের! অথচ সিচ্চানকে সারা জীবন ডালভাত মনে করে আসা ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা একটি ওভারের জন্যও চড়াও হতে পারেনি তাদের ওপর। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও ইনিংসে যার ৫ উইকেট নেই, সেই নাঈমুরের প্রথম টেস্ট ইনিংসেই ৫ উইকেট নেওয়া সারা! অভিষেক টেস্টে ৭ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। ফিল্ডিংয়ের কথাই ধরুন। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে বদলি ফিল্ডার রাজিন সালেহ যে দুটি ক্যাচ নিয়েছেন, তাতে কে বলবে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ক্লোজ-ইন ফিল্ডিংয়ের অভ্যাস নেই!
সকালে আগের দিন অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলা আমিনুল মুরালি কার্তিকের দেওয়া সহজ একটি ক্যাচ ফেলেছেন, রফিকের বাজে থ্রোর সঙ্গে দুর্জয়ের ব্যর্থতা মিলে আউট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছেন সুনীল যোশি, পরে ব্যক্তিগত ১৮ রানে তারই দেওয়া কঠিন একটি ক্যাচ ধরতে পারেননি শর্ট লেগে দাঁড়ানো আল-শাহরিয়ার, সোয়া দিনেরও বেশি ফিল্ডিংয়ে ভুল বলতে এটুকুই। নইলে ফিল্ডিংয়েও দেখা গেছে উজ্জীবিত বাংলাদেশকে। এমনকি হাঁটুতে বল লেগে মাঠের বাইরে যাওয়া খালেদ মাসুদের পরিবর্তে প্রায় তিন ঘণ্টা উইকেটকিপিং করা শাহরিয়ার হোসেনও কী সুন্দর ঢুকে গেলেন ইতিহাসে! টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ডিসমিসালটি খালেদ মাসুদের নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটেও কিপিং না করা এই ওপেনারের। বল তার গ্লাভসে লেগে স্টাম্পে ফিরে স্টাম্পড করে দিয়েছে সাবা করিমকে। বলতে হবে সৌভাগ্যপ্রসূতই, নবীন একটি দেশের এমন লড়াই দেখে মুগ্ধ ভাগ্যও পক্ষ নিয়েছে বাংলাদেশের। এখন পর্যন্ত বলতে গেলে সবকিছুই ঘটছে বাংলাদেশের পক্ষে।
সুনীল যোশির দেওয়া সুযোগ দুটির একটি কাজে লাগাতে পারলেই আরো জোর দিয়ে বলা যেত কথাটা। তৃতীয় দিন শেষে যোশি অপরাজিত ৭১ রানে। সপ্তম উইকেটে সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে তার গড়া ১২১ রানের জুটিটিই এখনো অসমাপ্ত রেখেছে ভারতের ইনিংস। গত পরশু শেষ বিকেলে শিভ সুন্দর দাসকে বোল্ড করে শুরু করেছিলেন নাঈমুর, এরপর কাল সকালে ভালো খেলতে থাকা সদগোপন রমেশকে বিদায় করে টেস্ট ক্রিকেটে তার প্রথম উইকেটটি নেন বাঁহাতি পেসার বিকাশ। লাঞ্চের আগেই দ্রাবিড়েরও(২৮) বিদায়। সিলি পয়েন্ট আর শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে নাইট ওয়াচম্যান মুরালি কার্তিক (৪৩) এবং ‘গ্রেট’ শচীন টেন্ডুলকারও (১৮) যখন ড্রেসিংরুমে ফিরলেন, ৫ উইকেটে ১৯০ রানে দাঁড়িয়ে তখন কাঁপছে ভারত। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের লিড নেওয়ার মতো অভাবনীয় ব্যাপারটি তখন খুবই ‘ভাবনীয়’ পর্যায়ে চলে এসেছে। তারপরও সাবা করিম আর সুনীল যোশিকে সঙ্গী করে সৌরভ গাঙ্গুলী তৃতীয় দিনে তিন শ রান তোলার টার্গেটের প্রায় কাছাকাছিই চলে গিয়েছিলেন। দিনের খেলার একেবারে শেষ দিকে সৌরভের হঠাৎ মাথা গরম হয়ে না গেলে হয়তো তা হয়েও যেত। বিস্ময়করভাবে স্পিনারদের চেপে বসতে দেওয়া ভারতীয় অধিনায়ক হঠাৎই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে নাঈমুরকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন গ্যালারিতে। এই শটটি মারায় বিশ্ব ক্রিকেটেই তাকে এক নম্বর বলে মানেন অনেকে। কিন্তু এটি যে নাঈমুরের দিন! সৌরভকে বেরিয়ে আসতে দেখে তার একটু টেনে দেওয়া বলটি গ্যালারিতে যাওয়ার পরিবর্তে আশ্রয় পেল লং অনে দাঁড়ানো আল-শাহরিয়ারের হাতে। এবং এই উইকেটটির কারণেই টেস্টের তৃতীয় দিন শেষেও পারফরম্যান্স বিচারে ভারতের চেয়ে বেশি নম্বর পাচ্ছে বাংলাদেশ।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, কে জানে! তবে কাল সন্ধ্যায় ‘তোমরা ভালো খেলছ, আমরা বাজে’-সৌরভ গাঙ্গুলীর এই মন্তব্য শুনে গালে লাল-সবুজ পতাকা আঁকা এক দর্শক যে বললেন ‘বাকি দুদিন যা ইচ্ছা তা-ই হোক। হারলেই বা কী, আমরা আমাদের জয় পেয়ে গেছি’, সেটি বোধহয় পুরো বাংলাদেশেরই মনের কথা।
এটি যদি আনন্দের হয়, তার চেয়েও বেশি আনন্দ পেতে পারেন এটা জেনে যে, নাঈমুর রহমানের দল মোটেই তা ভাবছে না। ‘আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি’-কথা না বলেও ভাবভঙ্গিমায় যেভাবে এ কথা বোঝালেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, আসল বিস্ময়টা ধাক্কা দিল তাতেই।
আমাদের ক্রিকেটারদের তো আমরাই এতদিন চিনতে পারিনি!
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-১
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-২
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৩
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৪
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৬