ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৩
উৎপল শুভ্র
২০ মার্চ ২০২১
স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম ধাপ ছিল ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়। সেদিন থেকেই রং লেগেছিল টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্নে। যে স্বপ্ন পূরণ হলো ২০০০ সালের নভেম্বরে। দল নির্বাচন নিয়ে নাটক থেকে শুরু করে সেই টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টও তাই বারবার পড়ার মতোই এক সুখস্মৃতি।
প্রথম প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০০০
এর আগেও বলা হয়েছে এমন। সেসবও ক্রিকেটেরই নানা অর্জনের সূত্রে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর যে রকম সর্বজনীন উৎসবে মেতে উঠেছিল সারা দেশ, তাতে অনেকেই তুলনা টেনেছেন স্বাধীনতার সঙ্গে। ’৭১-এর ডিসেম্বরের পর এমন উৎসব নাকি আর দেখেনি বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পরও শোনা গেছে এমন। সেসবে অতিশয়োক্তিও খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা হয় নাকি?
সত্যিই হয় না। তবে এটাও সত্যি, স্বাধীনতার পর জীর্ণ-ক্লিষ্ট বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে যে কবার উজ্জ্বল রূপে উপস্থাপিত হয়েছে, তা ক্রিকেটের সৌজন্যে। সেই ক্রিকেটই বাংলাদেশের জন্য আরেকটি অবিস্মরণীয় উপহারের ডালি সাজিয়ে নিয়ে আসছে আজ। আজ ১০ নভেম্বর, ২০০০ সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্জনের গৌরবে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেক!
১৮৭৭ সালের মার্চে মেলবোর্নে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া মিলে জন্ম দিয়েছিল যে টেস্ট ক্রিকেটের, ১২৩ বছরে ক্রমেই ডালপালা ছড়িয়েছে তার। ক্রিকেটের কুলীন সমাজ সহজে আত্মীয়তা বাড়াতে চায়নি কখনোই, তারপরও দিনে দিনে বেড়েছে এর সদস্য সংখ্যা, বাংলাদেশকে দিয়ে যা ছুঁয়েছে দুই অঙ্ক। ১২৩ বছর বয়সী টেস্ট ক্রিকেট তার দশম সদস্য হিসেবে আজ দুহাতে বরণ করে নিচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশ্ব আজ নতুন আলোতে দেখছে সব সময়ই ভুল কারণে খবর হওয়া এই দেশকে। আজ বাংলাদেশের উৎসব করার দিন!
গত জুনে আইসিসির সভায় টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পরই এক দফা হয়ে গেছে সেই উৎসব। আইসিসির সেই সিদ্ধান্ত ছিল শুধুই কাগজে-কলমে স্বীকৃতি। আজ সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে নাঈমুর রহমান দুর্জয় আর সৌরভ গাঙ্গুলী যখন মাঠের মাঝখানে গিয়ে বাতাসে ছুড়ে দেবেন বিশেষভাবে তৈরি করা স্বর্ণমুদ্রাটি, তখনই হবে সত্যিকার ‘নবীনবরণ’। সকাল সাড়ে ৯টায় হবে প্রথম বলটি, শতাব্দীপ্রাচীন টেস্ট ক্রিকেটের ডালে ফুটে উঠবে আরেকটি ফুল।
সেই অভিষেকের লগ্নটাও হয়ে থাকছে ব্যতিক্রমী। টেস্ট ক্রিকেটে এই প্রথম দুই অধিনায়ক টস করতে যাওয়ার সময় বাংলায় কথা বলতে বলতে যাবেন। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ব্যতিক্রমী গৌরব আছে যে জাতির, তাদের কাছে এটিও অন্য রকম তাৎপর্যময় হতে বাধ্য। প্রতিপক্ষ ভারত হলে টিভি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাওয়া চেকটা অনেক গুণ ভারী হয়ে যায়-ভারতকে বেছে নেওয়ার পেছনে এই বিবেচনাটা অবশ্যই আয়োজকদের ছিল। তবে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো দুই বাঙালির টস করতে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্যও ভারতকে প্রথম টেস্ট প্রতিপক্ষ হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলীর দলকে এ দেশের মানুষের পছন্দ করার কথা।
ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ধাপে উত্তরণের আনন্দ আছে, বড় এক অর্জনের উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সবকিছু ভুলে হয়ে যাবে এক যুদ্ধক্ষেত্র। খেলাটাও তো এক রকম ‘যুদ্ধ’ই এবং সেই যুদ্ধে বাংলায় কথা বলেন বলে সৌরভ গাঙ্গুলী বাংলাদেশকে বিন্দুমাত্র ছাড়ও দেবেন না। বাংলাদেশই বা তা চাইবে কেন? অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে, অনেক বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কেটে বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এখানে এসে পৌঁছেছে, এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও নিজে থেকেই তৈরি করে নেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। তবে তা একদিন বা এক বছরের ব্যাপার নয়। তাই বলে কি অভিষেক টেস্টে দলের কাছ থেকে লড়াকু একটা পারফরম্যান্স আশা করবে না বাংলাদেশ? সেই প্রতিশ্রুতি কিন্তু দিয়েছেন অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়, ‘আমরা আমাদের পুরো সামর্থ্য অনুযায়ী খেললে খুব খারাপ করব না।’ ‘খুব খারাপ করব না’ থেকে কী বুঝে নেব আমরা? কোচ সরওয়ার ইমরান এখানে নির্দিষ্ট হয়েছেন, ‘ড্র করাটা অসম্ভব বলে মনে করি না।’
সত্যি যদি তা সম্ভব হয়, বাংলাদেশের জন্য সেই ‘ড্র’তেও থাকবে জয়ের গৌরব। ইতিহাসের প্রথম টেস্টে তো দুদলেরই অভিষেক। সেটির কথা বাদ দিন। এরপরের ছয়টি দলই কিন্তু হেরেছে টেস্ট অভিষেকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান তো ইনিংস ব্যবধানে। টেস্ট অভিষেকের সর্বশেষ দৃষ্টান্তটি অবশ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। ১৯৯২ সালে টেস্ট পরিবারের নবম সদস্য জিম্বাবুয়ে অভিষেক টেস্টেই রুখে দিয়েছিল ভারতকে। শুধু তাই নয়, এক সময় জেগেছিল অভাবনীয় এক আপসেটের সম্ভাবনাও। সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের সংগ্রামী সেঞ্চুরিটিই ভারতকে বাঁচিয়েছে চরম লজ্জার হাত থেকে। তবে সেই টেস্টটি হয়েছিল হারারেতে, আর ভারতকে বিদেশের মাটির জুজু কীভাবে তাড়া করে, তা সবারই জানা। সৌরভ গাঙ্গুলী যে ঢাকায় নেমেই বললেন, এটিকে তিনি বিদেশ মনে করেন না, সেটিতে অন্য অর্থ খোঁজার কারণ নেই। এ কথার মাধ্যমে ভারতীয় অধিনায়ক আসলে যা বুঝিয়েছেন, সেটিই বাংলাদেশের জন্য ভয়ের ব্যাপার। মাঠ, উইকেট, আবহাওয়া সব মিলিয়ে ঢাকা ভারতীয় দলের কাছে বিদেশ নয়, এটি তাদের নিজেদের দেশের মতোই। আর নিজেদের পরিচিত পরিবেশে ভারত যে রাতারাতি ‘বিড়াল’ থেকে ‘বাঘ’ হয়ে যায়, সেটি কে না জানে!
বুকে যত বড় করেই ‘বাঘ’ লাগানো থাকুক না কেন, লড়াইটা আসলে বাঘে-বাঘে হচ্ছে না। স্লিপ, গালি, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, সিলি পয়েন্টের কান ঝালাপালা করে দেওয়া বকবকানির মধ্যে ব্যাট করার অভ্যাস নেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের।
আর একটি ব্যাপারেও কোনো তর্ক নেই। প্রতিপক্ষের বুকে যত বড় করেই ‘বাঘ’ লাগানো থাকুক না কেন, লড়াইটা আসলে বাঘে-বাঘে হচ্ছে না। স্লিপ, গালি, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, সিলি পয়েন্টের কান ঝালাপালা করে দেওয়া বকবকানির মধ্যে ব্যাট করার অভ্যাস নেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের, শুধু ওয়ানডেতে রান আটকানো বল করতে অভ্যস্ত বোলারদের শিখতে হচ্ছে উইকেট নেওয়ার কৌশল; ক্লোজ-ইন পজিশনে ফিল্ডিং করার অভ্যাস নেই কারো। বাংলাদেশ তাই অনেক ব্যবধানে পিছিয়ে পড়া আন্ডারডগ। বাংলাদেশের এটি অভিষেক, ভারতের এটি ২৯৬তম টেস্ট। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছে ১০টি, ভারতীয় দলে তিনজন নতুন খেলোয়াড় থাকার পরও স্কোয়াডের বাকি ১১ জনের খেলা মোট টেস্টের সংখ্যা ২৬৯! ক্রিকেট ঐতিহ্য আর অভিজ্ঞতায় এই যোজন যোজন ব্যবধান শুধুই সাহস আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দিয়ে ‘নাই’ করে দেওয়া যায় না। তারপরও নতুন রঙের ভোরে আজ যখন ঘুম ভাঙবে বাংলাদেশের, প্রত্যাশা থাকবে একটাই। যে দলের অধিনায়কের নাম ‘দুর্জয়’, তারা যেন হারার আগেই হেরে না বসে। অভিষেক টেস্টেই প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো আগুন জ্বালিয়ে দিতে না পারুন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, অন্তত একদিন আগুন হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেওয়া স্ফুলিঙ্গটুকু যেন দেখতে পায় ক্রিকেট বিশ্ব।
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-১
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-২
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৪
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৫
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৬