ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-১
উৎপল শুভ্র
২০ মার্চ ২০২১
স্বপ্ন পূরণের পথে প্রথম ধাপ ছিল ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়। সেদিন থেকেই রং লেগেছিল টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্নে। যে স্বপ্ন পূরণ হলো ২০০০ সালের নভেম্বরে। দল নির্বাচন নিয়ে নাটক থেকে শুরু করে সেই টেস্টের ম্যাচ রিপোর্টও তাই বারবার পড়ার মতোই এক সুখস্মৃতি।
প্রথম প্রকাশ: ১ নভেম্বর ২০০০। প্রথম আলো।
সাংবাদিকদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত ৮টার দিকে একটি করে নাম উচ্চারণ করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, আর নামগুলো হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। অভিষেক টেস্টের দল ঘোষণার আগে বোর্ড সভাপতি নিজেও ব্যবহার করলেন ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি। ঐতিহাসিকই তো! অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে যে টেস্ট অভিষেকের মাধ্যমে, সেই টেস্টের ১৪ জন তো ইতিহাসেরই অংশ। সেই ইতিহাস গড়ায় নেতৃত্ব দেবেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। তাকেই বহাল রাখা হয়েছে অধিনায়ক হিসেবে।
তিন নির্বাচক তানভীর হায়দার, রকিবুল হাসান ও তানজীব আহসান সাদ দলের কোচ, অধিনায়ক ও ফিজিওর সঙ্গে বসেছিলেন দুপুর সাড়ে ১২টায়, দুপুর আড়াইটার মধ্যেই তাদের কাজ শেষ। তাদের নির্বাচিত অভিষেক টেস্টের দল সাংবাদিকদেরও মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তবে বোর্ডের অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাকি ছিল তখনো। আনুষ্ঠানিকতাই, কারণ নির্বাচকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বোর্ড তাদের নির্বাচিত দলে কোনো পরিবর্তন করেনি।
১১/১২টি নাম নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না, কৌতূহল ছিল বাকি তিন/চার জন নিয়ে। কদিন আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলা ব্যাটসম্যান রাজিন সালেহ এবং তরুণ অফ স্পিনার ফাহিম মুনতাসির সুমিত আবিভূর্ত হলেন ‘চমক’ হিসেবে। ১৪ জনের দলে এদের অন্তর্ভুক্তি যতটা চমক, তার চেয়েও বড় চমক বলতে হবে হাবিবুল বাশার সুমনের বাদ পড়াটা। গত বছর দেড়েক বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাদের একজন তিনি, অথচ অতীতে অনেকবারের মতো এবারও নির্বাচকদের খামখেয়ালির শিকার হতে হলো তাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া দলটি থেকে সুমন ছাড়াও বাদ পড়েছেন বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক মনি, ওপেনার এহসানুল হক সিজান এবং অলরাউন্ডার মুশফিক বাবু।
অভিষেক টেস্টের বাংলাদেশ দল: নাঈমুর রহমান (অধিনায়ক), খালেদ মাসুদ (সহ-অধিনায়ক), মেহরাব হোসেন, শাহরিয়ার হোসেন, জাভেদ ওমর, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান, আল-শাহরিয়ার রোকন, হাসিবুল হোসেন, মঞ্জুরুল ইসলাম, বিকাশ রঞ্জন দাস, মোহাম্মদ রফিক, ফাহিম মুসতাসির, রাজিন সালেহ। ** পরে দলে ডাকা হয় হাবিবুল বাশার ও এনামুল হক মণিকে।
বাংলাদেশের তারকা উদ্বোধনী জুটি শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হোসেন অপি ফিটনেস সমস্যা কাটিয়ে ফিরে আসায় সিজানের বাদ পড়াটা ছিল প্রত্যাশিতই। টেস্টে স্পেশালিস্টদের ব্যাপারেই জোর দেওয়া উচিত, মুশফিক বাবুও তাই থাকেন না। তবে মনি হয়তো আশায় আশায় ছিলেন, কিন্তু হেরে গেছেন তিনি মোহাম্মদ রফিকের কাছে। মাস কয়েক আগে ক্রিকেটারদের সঙ্গে চুক্তি করার সময় রফিককে বাদ দিয়ে মনিকে বেছে নেওয়ার পেছনে নির্বাচকরা ‘মনি লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটে ভালো’ এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে একমাত্র চার দিনের ম্যাচটিতে মনির চেয়ে অনেক ভালো পারফর্ম করে সেই যুক্তির অসারতা প্রমাণ করেছেন রফিক। তারই পুরস্কার অভিষেক টেস্টের দলে জায়গা পাওয়া।
কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া দলটির ১০ জনই টিকে গেছেন, ফিরে আসা অপি-বিদ্যুতের সঙ্গে তৃতীয় ওপেনার হিসেবে দলে থাকছেন জাভেদ ওমর বেলিম গুল্লু। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান আছেন পাঁচজন-আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আল শাহরিয়ার রোকন, নাঈমুর রহমান দুর্জয় (তাকে অবশ্য অলরাউন্ডারই বলা যায়) ও রাজিন সালেহ। পেস বোলার ওই সফরেরই তিনজন-হাসিবুল হোসেন শান্ত, মঞ্জুরুল ইসলাম ও বিকাশ রঞ্জন দাস। দুই স্পিনার মোহাম্মদ রফিক ও ফাহিম মুনতাসির সুমিত। দুর্জয় থাকার পরও আরেকজন অফ স্পিনার নেওয়ার কারণটি অনুমিতই, ভারতীয় দলে বেশ কজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি। বছর দুয়েক আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘এ’ দলের বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেটও নিয়েছিলেন তিনি। সুমিতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তাই কোনো প্রশ্ন হলো না, তবে রাজিন সালেহর ব্যাপারটি নিয়ে হলো। প্রধান নির্বাচক তার ব্যাখ্যা দিলেন, ‘তরুণ খেলোয়াড়, ভালো ফিল্ডার, টেস্ট ম্যাচে আমরা ওর কাছ থেকে ভালো সার্ভিস পাব বলে মনে করেছি।’ রাজিন সালেহর একাদশে আসার কোনো প্রশ্ন নেই, পরিবর্ত ফিল্ডার হিসেবেই যে তার সার্ভিস চাওয়া আছে, তা এক রকম পরিষ্কার।
রাজিন সালেহর অন্তভুর্ক্তির ব্যাপারে প্রধান নির্বাচকের ব্যাখ্যা মোটামুটি গ্রহণযোগ্যই হলো সবার কাছে। কিন্তু তার দিকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ছুটে গেল যে ব্যাপারে, হাবিবুল বাশার সুমনের সেই বাদ পড়ার কারণ হিসেবে দেওয়া তার যুক্তিকে মনে হলো বড় বেশি খেলো। শেষ পর্যন্ত তিনি আশ্রয় নিলেন ‘ফিটনেস’ নামে চিরন্তন বর্মের আড়ালে। ফিটনেসের ব্যাপারটি যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই ওয়ানডেতে গত দেড় বছর নিয়মিত খেলে গেলেন সুমন, আর টেস্ট ম্যাচ আসতেই ভয়াবহ হয়ে উঠল তার ফিটনেস সমস্যা!
এই একটি সিদ্ধান্তই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে অভিষেক টেস্টের দল নির্বাচনকে। অভিষেক টেস্টটি বাংলাদেশের জন্য উৎসবে মেতে ওঠার মতোই এক উপলক্ষ, কিন্তু সেই উৎসবমুখর পরিবেশেও একটু কান পাতলেই শোনা যাবে হাবিবুল বাশার সুমনের দীর্ঘশ্বাস! এবং সেই দীর্ঘশ্বাস অকারণে ফেলবেন না তিনি!
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-২
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৩
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৪
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৫
ফিরে দেখা বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট-৬