মাটিতে নেমে আসা আকাশের তারা
উৎপল শুভ্র
২৫ জুন ২০২১
আকাশের তারাকে চোখের সামনে মাঠে দৌড়ে বেড়াতে দেখলে কেমন লাগে? খুঁজলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো হাজার বাইশ-তেইশ লোক বাংলাদেশেও পাওয়া যাবে। মধ্যরাত পেরোনো টেলিভিশনের পর্দায় মেসির পায়ের জাদু তো বলতে গেলে নিয়মিত সাপ্তাহিক বিনোদন। তবে খোলা আকাশের নিচে রোজারিওর ঐন্দ্রজালিককে দেখার অভিজ্ঞতা ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দর্শকরাও তো পেয়েছিল।
প্রথম প্রকাশ: ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১। প্রথম আলো।
আকাশের তারা মাটিতে নেমে এলে তার কেমন লাগে, সেটি লিওনেল মেসি ভালো বলতে পারবেন। অথবা কে জানে, প্রশ্নটাই না বুঝে অবাক তাকিয়ে থাকবেন।
নিজের তারকামূল্য না বোঝার কোনোই কারণ নেই। এই গ্রহের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়া মেসিম্যানিয়াই প্রতিনিয়ত তা বুঝিয়ে দেয়। আরও ভালো বুঝিয়ে দেয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। বার্সেলোনার বেতন আর প্রচারদূত হওয়ার সামান্য বিনিময়মূল্য মিলিয়ে এই ২০১১ সালে তাঁর উপার্জন দাঁড়াবে ৩২৬ কোটি টাকারও বেশি।
মেসি যদি প্রশ্নটা না বোঝেন, তার কারণ বর্তমান ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা হয়েও তারকাসুলভ অহমিকা থেকে বিস্ময়করভাবে মুক্ত বলে। প্রশ্নটা বরং এটা হওয়াই ভালো—আকাশের তারাকে চোখের সামনে মাঠে দৌড়ে বেড়াতে দেখলে কেমন লাগে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো হাজার বাইশ-তেইশ লোক এখন বাংলাদেশে আছে। মধ্যরাত পেরোনো টেলিভিশনের পর্দায় মেসির পায়ের জাদু তো বলতে গেলে নিয়মিত সাপ্তাহিক বিনোদন। তবে খোলা আকাশের নিচে রোজারিওর ঐন্দ্রজালিককে দেখার অভিজ্ঞতা কাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দর্শকদের বাকি জীবনের সঞ্চয় হয়ে গেল।
হ্যাঁ, তাঁরা যাঁকে দেখলেন, তিনি রোজারিওর ঐন্দ্রজালিকই। বার্সেলোনার খুদে জাদুকর নন। বার্সেলোনার মেসি যা ইচ্ছে তা-ই করতে করতে যখন ইচ্ছা হয় গোলও করেন। রোজারিওর মেসি যখন আর্জেন্টিনার, তখন প্রথম অংশটা ঠিক থাকে। কিন্তু গোলটা কেন যেন হয় না। সেই অপবাদ বলুন, রহস্য বলুন, ঢাকার ম্যাচও তা ঘোচাতে ব্যর্থ। মেসি গোল পেলেন না।
প্রায় শৈশবেই আর্জেন্টিনা ছেড়ে চলে গেছেন বলে আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ে এখনো মেসির জায়গা হয়নি। মেসি আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীতে ঠোঁট মেলান না বলে তীব্র সমালোচনাও হয়। জাতীয় সংগীতটা তিনি জানেন কিনা, বিতর্ক আছে তা নিয়েও। ম্যারাডোনা যতই স্নেহভরে ‘মেসি আমার চেয়েও ভালো’ বলে দরাজ সার্টিফিকেট দিন না কেন, আর্জেন্টাইনরা তুলনাটা শুনলেই হাসে। বিখ্যাত বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসি যা করছেন, অখ্যাত নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনা তো তার চেয়ে কম করেননি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে কখনো কখনো ছাড়িয়ে গেছেন নাপোলির ম্যারাডোনাকে। মেসি আকাশি নীল-সাদায় কিছুটা হলেও নিজেকে হারিয়ে ফেলেন।
‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’র মতো বার্সেলোনার মেসিই এখন মেসির শত্রু। কালকের ম্যাচটাই ধরুন। সন্দেহাতীতভাবে মেসি ম্যাচের সেরা। অথচ তাঁর মানদণ্ডে দশে হয়তো ৫ বা ৬ পাবেন। তাঁর তুলনাটা যে মাঠের অন্য সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে নয়, বার্সেলোনার মেসির সঙ্গে।
ম্যাচের আগের দিন নাইজেরিয়ান কোচ শিয়াশিয়া নির্বিকার মুখে দাবি করেছিলেন, মেসিকে নিয়ে আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই। মেসিকে নিয়ে পরিকল্পনা করে কোনো লাভ হয় না, এটাকেই কারণ মনে হয়েছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণেই মধ্যেই অবশ্য বোঝা গেল, পরিকল্পনা যেটি ছিল, সেটি আসলে মুখ ফুটে বলার মতো নয়। প্রেম আর যুদ্ধে নাকি অন্যায় বলে কিছু নেই। নাইজেরিয়ানরা সীমানাটা একটু বাড়িয়ে এটিকে ‘প্রেম, যুদ্ধ আর মেসিকে আটকানোর চেষ্টায় অন্যায় বলে কিছু নেই’ করে নিল। বারবার নির্দয় ট্যাকলের শিকার হলেন মেসি। একবার মাঝমাঠে অনেকক্ষণ পড়ে থেকে কেটে যাওয়া ঠোঁটের শুশ্রূষার জন্য মাঠের বাইরেও আসতে হলো। মেসিদের ঠেকাতে এ সব হয়ই। তার পরও ৯০ মিনিট মেসি মাঠে থাকবেন আর সেই ঝলক দেখা যাবে না, তা কি হয় নাকি!
ঠিকই দেখা গেল। মোহময় সেই দৌড়, জাদুকরি সব থ্রু—এসব তো থাকলই। সঙ্গে মাঠের বাইরে থেকে ফেরার পরপরই ম্যাচের স্মরণীয়তম কয়েকটি সেকেন্ডও, যা ‘ম্যারাডোনা-মুহূর্ত’ হতে হতে হলো না। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মাঠের ডান দিক দিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার সেই শতাব্দী-সেরা গোল। মেসিও ডান দিকেই পাঁচ নাইজেরিয়ানকে মোহমুগ্ধ করে রেখে গোলের দরোজায়। ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনকেও কাটিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। নাইজেরিয়ান গোলরক্ষক সেভাবে এগিয়ে আসেননি বলে মেসিকে গোলেই মারতে হতো। তা থেকেই গোল, তবে তা মেসির নয়। মেসির শটে হাত লাগিয়ে নাইজেরিয়ান গোলরক্ষক যে সেটি অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার পায়ে তুলে দিয়েছেন।
মাঠে তাঁকে চিনতে খুব সুবিধা হচ্ছিল। ওই ছোটখাটো শরীর আর দৌড়ানোর অনন্য ভঙ্গিই তো সবার চেনা। সঙ্গে যোগ হলো হলুদ-কমলা রঙের নতুন বুট। নতুন বুটই, অ্যাডিডাসের নতুন বুটের অভিষেক হলো এই ম্যাচেই। বিশ্বের সেরা ফুটবলার যখন পণ্যদূত, অ্যাডিডাসের যেকোনো নতুন উদ্ভাবন তো মেসির পায়েই প্রথম শোভা পাবে। এই ম্যাচের আগে অ্যাডিডাসের লোকজন ২৫ জোড়া বুট নিয়ে এসেছেন, যা জেনে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন বাফুফের কর্মকর্তারা। অ্যাডিডাসের নতুন বুট যে মেসির পুরো ৯০ মিনিট খেলার নিশ্চয়তা হয়ে এসেছে।
মেসি ৯০ মিনিটই খেললেন। সেই ৯০ মিনিটেও কি আশ মেটে! খেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর আর্জেন্টিনা দল যখন মাঠ ছাড়ছে, কড়া নিরাপত্তা ভেদ করে মাঠে ঢুকে পড়া শ পাঁচেক দর্শক ড্রেসিংরুমের সামনে ‘মেসি’ ‘মেসি’ চিৎকারে গলা ফাটাচ্ছে। বাইরে আরও হাজারও জনতা। অনেকে মাঠে নেমে ঘাস ছুঁয়ে দেখছেন। এই ঘাস যে মেসির স্পর্শধন্য।
মেসির পায়ে গোল দেখা হয়নি, ওটুকুই যা অতৃপ্তি। তার পরও তো কম দেননি। আর ৯০ মিনিট রক্তমাংসের মেসিকে চোখের সামনে সঞ্চরণশীল দেখাটাই তো জীবনপাত্র উছলিয়া পড়া মাধুরী।
আরও পড়ুন: ঢাকায় যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিলাম মেসিকে