বগুড়ায় সেই জয়ের আগের দিন...
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ২০০৬ সিরিজ
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াইটাই নিয়মিত দৃশ্য হয়ে গেছে এখন। অথচ কয়েক বছর আগেও সম্মানজনক হারটাই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন, এমনকি পাঁচ উইকেটের হারগুলোকেও বলতে হতো, `ভালোই তো!` আর শ্রীলঙ্কানরা তো ধরেই নিত, মাঠে নামার আগেই জয় নিশ্চিত। বগুড়ায় যে ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে প্রথম হারায় বাংলাদেশ, সেই ম্যাচের আগের দিন জয়াসুরিয়া-জয়াবর্ধনের সঙ্গে কথা বলে লিখেছিলাম লেখাটা।
প্রথম প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। প্রথম আলো।
সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স দেখে যদি আপনার মন খারাপ হয়ে থাকে, তাহলে বলি, অকারণেই আপনি মন খারাপ করেছেন। বাংলাদেশ তো ভালোই করেছে! না না, রসিকতা নয়। ১১৮ রানে অলআউট হয়ে গিয়ে ৫ উইকেটে হারা কীভাবে ভালো হয়, এই প্রশ্ন করবেন তো! ভালো, কারণ প্রতিপক্ষ দলটির নাম শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ১৫টি ওয়ানডেতে এই ৫ উইকেটে পরাজয়ই যে সবচেয়ে সম্মানজনক ব্যবধান। এর আগের ১৪ ম্যাচে একবারই ৫ উইকেটে হারার ‘কৃতিত্ব’ ছিল, ১০ উইকেটেও হারতে হয়েছে দু-দুবার। বাংলাদেশের জন্য শ্রীলঙ্কা এমনই ‘অপয়া’ দল যে, ৫ উইকেটে পরাজয়ও যথেষ্ট ভালো পারফরম্যান্স!
কাল বিকেলে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার প্র্যাকটিস শেষে সনাৎ জয়াসুরিয়ার সঙ্গে এ কথা-সে কথার মধ্যে বাংলাদেশের ‘জায়ান্ট কিলিং’য়ের প্রসঙ্গ এল। পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে..নামগুলো শেষ করার আগেই জয়াসুরিয়া হেসে বললেন, ‘তোমরা শ্রীলঙ্কাকে তো একবারও হারাতে পারোনি।’ শ্রীলঙ্কাকে হারানো দূরে থাক, কখনো হারানোর সম্ভাবনাও জাগাতে পারেনি বাংলাদেশ।
কারণটা কী? জয়াসুরিয়ার এই কারণ খুঁজতে ব্যাকুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। দুষ্টুমির হাসি দিয়ে তিনি বরং বললেন, ‘আশা করি, ব্যাপারটা এমনই থাকবে।’
মাহেলা জয়াবর্ধনে অবশ্য একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছেন। তা হলো, শ্রীলঙ্কা দলের দর্শন। ‘আমরা কোনো দলকেই হালকাভাবে নিই না। জানি, তাহলেই অঘটন ঘটে যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমরা যে মানসিকতা নিয়ে নামি, বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও তা-ই। আমাদের দলের একেবারে তরুণ খেলোয়াড়দের মাথাতেও এটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অন্য দলগুলো হয়তো এই ভুলটাই করেছে, বাংলাদেশও এর সুযোগ নিয়েছে’—শ্রীলঙ্কান অধিনায়কের কথায় যুক্তি আছে। শ্রীলঙ্কা যতবার অঘটনের শিকার হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অঘটন ঘটিয়েছে তারা নিজেরাই।
১৯৭৯ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো দিয়ে শুরু, সেটি শ্রীলঙ্কার টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগের কথা। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরও তো অনেক দিন বড় দলগুলোর বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার জয় অঘটন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বড় অঘটনের শিকার হওয়া বলতে গত বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে হেরে বসা। এই একটি ‘লজ্জা’ ভবিষ্যতের জন্য ভালোই হয়েছে বলে জয়াবর্ধনের ধারণা, ‘কেনিয়ার কাছে হেরে যাওয়ার পর কেমন লেগেছিল, আমরা তা কোনোদিনই ভুলতে পারব না। ওই স্মৃতিই কোনো দুর্বল দলের বিপক্ষেও আমাদের মধ্যে একটুও গা-ঝাড়া ভাব আসতে দেয় না।’
এই দ্বীপদেশটির বিপক্ষে বাংলাদেশের বিস্মরণযোগ্য স্মৃতির অভাব নেই। জয়াবর্ধনেও জড়িয়ে এর একটির সঙ্গে। ২০০১ সালে কলম্বোয় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে মারভান আতাপাত্তুর মতো জয়াবর্ধনেও সেঞ্চুরি করার পর ইচ্ছে করেই অবসর নিয়েছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে এমন ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি, এর পরেও না। এত দিন পর জানা গেল, এটা আতাপাত্তু বা জয়াবর্ধনে কারো ইচ্ছেতেই হয়নি। জয়াবর্ধনে জানালেন, এটা ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। ড্রেসিংরুম থেকে ডেকে পাঠানোর আগে তাঁকে বা আতাপাত্তুকে কোনো আভাসই দেওয়া হয়নি। এরপরই এমন একটা কথা বললেন, যেটি রীতিমতো নতুন একটা চিন্তার দ্বার খুলে দিল। ‘টিম ম্যানেজমেন্টের কেউই জানত না যে, ওভাবে বেরিয়ে এলে তা আউট বলে গণ্য হবে। তবে যা হওয়ার হয়েছে, আমরা আর তা মনে রাখিনি’—জয়াবর্ধনের এ কথা শোনার পরই মনে হলো, আরে, তাই তো, আসল ক্ষতিটা তো দুই ব্যাটসম্যানেরই হয়েছে! ওই ঘটনা রেকর্ড বুকে তাঁদের নাম তুলে দিয়েছে—এটা শোনার পর মুখে যতই বলুন, ‘ভালোই তো’, মনে মনে জয়াবর্ধনের ক্ষুব্ধই হওয়ার কথা। নইলে ‘যা হওয়ার হয়েছে’ কেন বলবেন? মনে না রাখার প্রশ্নই বা আসবে কেন?

বাজে উইকেটে ব্যাটিং করার দক্ষতা বিচারে অনেকেই যাঁকে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়েও বড় ব্যাটসম্যান মনে করেন, সেই জ্যাক হবস একবার বলেছিলেন, ‘পত্রিকাগুলো যদি অ্যাভারেজ না ছাপত, তাহলে ক্রিকেট খেলাটা আরো সুন্দর হতো।’ হবসের যুগে শুধু খেলার আনন্দেই খেলতেন সবাই, ক্রিকেটের আধুনিক যুগে ‘হবসের শিষ্য’ খুঁজতে গেলে হতাশই হতে হবে। একালের খেলোয়াড়দের বরং নিজেদের অ্যাভারেজ ঠোঁটস্থই থাকে। আউট না হয়েও স্কোরকার্ডে ‘আউট’ লেখা হওয়ায় তাঁদের ব্যাটিং অ্যাভারেজ যে খারাপ হয়ে গেল, মারভান আতাপাত্তু ও মাহেলা জয়াবর্ধনের তা ভালো লাগবে কেন?
আরও পড়ুন: বাঘের থাবায় সিংহ কাত
                      মধুর বিড়ম্বনা



 
										 
										 
										 
										 
										 
										

 
            





 
						 
						 
						 
						 
						