যেভাবে রচিত হলো দুঃস্বপ্ন
২০০৩ বিশ্বকাপ ক্রিকেট
উৎপল শুভ্র
১৩ মে ২০২১
কানাডা ১৮০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর এই ম্যাচ বাংলাদেশের হেসেখেলে জেতার কথা। বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানেরাও এমন ভেবেছিলেন বলেই আসলে হয়েছিল সর্বনাশটা। কিংসমিডের প্রেসবক্সে বসে যেমন যা দেখছি, তা বিশ্বাস হচ্ছিল না; এতদিন পরও তা হতে চায় না। ৪ উইকেটে ১০৬ থেকে ওই বোলিংয়ের বিপক্ষে কীভাবে সম্ভব আর ১৪ রান যোগ করেই অলআউট হয়ে যাওয়া! সেই কালো রাতের গল্প।
প্রথম প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। প্রথম আলো।
★ সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপে দুটি জয়, পরের চার বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের আর কোনো জয় নেই।
★ সেই ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ঠিক আগে মেহরাব হোসেন একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওই একটিই। এরপর ওয়ানডেতে বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি নেই।
১১ ফেব্রুয়ারি ডারবানের কিংসমিডে এই দুটো আক্ষেপই ঘুচে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ যা হলো, সেটি রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। গত বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে যে রূপকথার জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশ, এই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটিই দেখল তার নির্মম সমাপ্তি। নর্দাম্পটন যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বপ্নভূমি হয়ে থাকে, ডারবান হয়ে থাকল স্বপ্নের করুণতম মৃত্যুর সাক্ষী।
’৯৯ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আপসেটের নায়ক ছিল বাংলাদেশ, এবার নিজেরাই তার শিকার। সেটিও কাদের বিপক্ষে? শূন্যের চেয়েও ২০ ডিগ্রি নিচে নেমে যাওয়া তাপমাত্রা চারপাশ বরফে ঢেকে দেওয়ায় গত ছয় মাস কোনো ক্রিকেট ম্যাচই খেলতে পারেনি যে দল, যে দলের খেলোয়াড়রা জীবিকার জন্য অন্য কিছু করে শুধু ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়, যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ জানেই না যে, তাদের জাতীয় দল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে, সেই কানাডার বিপক্ষে!
কয়েকদিন আগে ডারবানের এই কিংসমিডেই কাওয়াজুলু-নাটালের মতো শক্তিধর প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ২৫১ রান তাড়া করে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই জয়টির পর বাংলাদেশ দলকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। কে জানে, সেটিই হিতে বিপরীত হলো কি না, সেই জয়ই কানাডাকে হালকাভাবে নেওয়ার সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিল কিনা বাংলাদেশকে!
কানাডার নিতান্তই সাধারণ বোলিংয়ের সামনেই ১২০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার আর কোনো কারণ তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ের ধরন আরও সহজ করে দিচ্ছে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে। ১২০ রান এসেছে মাত্র ২৮ ওভারে— এটাই বলে দিচ্ছে সব। ওপেনিং জুটিতে ৩৩ রান, এরপর আর বলার মতো কোনো পার্টনারশিপই নেই। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সবাই যেন নেমেছেন কানাডার বোলারদের উড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। বোধবুদ্ধিহীনের মতো প্রত্যেকে একই ভুল করে এসেছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এক অবিশ্বাস্য প্রদর্শনীতে মেতে উঠে ১১ ফেব্রুয়ারিকে পরিণত করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ‘কালো দিন’-এ।
অলক কাপালিকে দুর্ভাগা মানতে হয়, তাঁর প্যাডে বল লেগেছিল অফ স্টাম্প লাইনের বাইরে। তারপরও আঙুল তুলে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকান আম্পায়ার ব্রায়ান জারলিং। ওই একটিই ব্যতিক্রম, বাকি সব ব্যাটসম্যানই উইকেট বিলিয়ে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী।
অধিনায়ক খালেদ মাসুদ ব্যাটসম্যানদের ওপর এতটাই ক্ষুব্ধ যে, ওই বিপর্যয়ের পরদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইতেই বললেন, ‘সবসময় শুধু আমাকেই বলতে হবে কেন? যান, ব্যাটসম্যানদের জিজ্ঞেস করুন, ওরা বলুক, ওরা কী করেছে!’
সানোয়ারের নাম যে আলাদা করে বললেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অলক কাপালির সঙ্গে তাঁর পার্টনারশিপটি ৭৬ রানে ৪ উইকেট হারানোর ধাক্কাটাকে যখন একটু সামলে নিয়েছে, তখনই স্টাম্পের লাইনের বলে সুইপ করার ইচ্ছে জাগল তাঁর! সর্বনাশের বীজটাও পোঁতা হলো তখনই। ১০৬ রানে তাঁকে দিয়ে শুরু, এরপর মাত্র ১৪ রানেই পড়ে গেল শেষ ৬ উইকেট!
গত আইসিসি ট্রফিতে নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি অস্টিন করডিংটন। তিন ম্যাচ খেলে উইকেট পেয়েছেন ২টি, জ্যামাইকায় জন্মানো সেই করডিংটন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক ম্যাচেই পেয়ে গেলেন ৫ উইকেট! আইসিসি ট্রফিতে খেলা ব্যাটসম্যানরাও যে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মতো দিলদরিয়া নয়।
টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নিয়মিতই। কানাডার বিপক্ষে পরাজয় সেসব প্রশ্নকে তো চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছে দেবেই। শুধু সেটি হলেই কথা ছিল, আরও বড় দুশ্চিন্তা যে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখন। এই পরাজয় বাংলাদেশের পরের পাঁচটি ম্যাচকে না এর চেয়েও বড় কোনো দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দেয়!
আরও পড়ুন: কানাডার কাছে হারের পর...