গ্রিনিজের হাত ধরে স্বপ্নপূরণের একেবারে কাছাকাছি

জন্মদিনে গ্রিনিজ-স্মৃতি-১

উৎপল শুভ্র

১ মে ২০২১

গ্রিনিজের হাত ধরে স্বপ্নপূরণের একেবারে কাছাকাছি

গ্রিনিজের হাতে বাংলাদেশকে দেওয়া তাঁর সেরা উপহার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ঘুরতে এসে বিসিবি অফিসে আইসিসি ট্রফি হাতে। ছবি: বিসিবি

হল্যান্ডের বিপক্ষে মহানাটকীয় ম্যাচ জিতে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। সেই সেমিফাইনাল জিতলেই খুলে যাবে স্বপ্নের বিশ্বকাপের দুয়ার। মাঝখানে একটু সময় তো ছিলই, কিন্তু গর্ডন গ্রিনিজ তার একটুও নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। কুয়ালালামপুর থেকে পাঠানো লেখাটা ছিল আইসিসি ট্রফিজুড়ে গর্ডন গ্রিনিজকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে।

প্রথম প্রকাশ: ৭ এপ্রিল, ১৯৯৭। ভোরের কাগজ।

সকাল আটটায় দরজায় ধুমধাম শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল তাঁদের। পরাজয় হতাশা আর অবসাদে ডুবিয়ে দেয়; জয়ের আনন্দ তীব্রতম হলে একই রকম না হোক, একটা ক্লান্তি তো আসেই, হয়তো কিছুক্ষণ পর। আর এক্ষেত্রে তো নিছক একটা জয়ের আনন্দ নয়, স্বপ্নের একবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়ানোর উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেছে তাঁদেরকে। সেই উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়েছে যখন, তখন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়--এমন স্বপ্নের উত্তাপের ওমে এলিয়ে পড়েছে শরীর বিছানায়। তাঁরা চোখ খুললেন তাই বেশ কষ্ট করে। কিছুটা বিস্ময়, তার চেয়ে বেশি বিরক্তি নিয়ে দরজার হাতল ধরে টান দেওয়ার পর মুহূর্তেই বিরক্তিটা একদম মুছে গিয়ে তাঁদের মুখে ফুটে উঠল হাসি। দরজায় ধুমধাম শব্দের যিনি স্রষ্টা, তিনি তা সুষ্টি করতে যে হাতের সঙ্গে পা-ও ব্যবহার করেছেন, তা চোখে পড়ল তাঁদের। কারণ এখন তিনি অন্য দরজায় কর্মব্যস্ত। চোখে চোখ পড়তেই মুখে হাসি, সে হাসিতে গভীর মমতা, চোখে খানিকটা দুষ্টুমির ছায়া ফেলে বললেন তিনি,‌‘আরে, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছ তোমরা, ব্যাপারটা কী? জানো না, সামনেই বড় পরীক্ষা।’

সেই বড় পরীক্ষার নাম আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনাল। যে সকালের ঘটনা, সেমিফাইনাল তখনও তিন দিন দূরে। তারপরও মাস্টার সাহেব যে ছাত্রদের সাতসকালে এভাবে ডেকে তুলবেন, এর সম্ভাব্য কারণ, প্রিয় মুখগুলো আবার দেখার জন্য তর সইছিল না তাঁর। আগের দিনের সাফল্য যেন খেলোয়াড়দের আত্মতৃপ্তিতে ডুবিয়ে দিয়ে আসল পরীক্ষায় নামার আগে কোনোরকম শৈথিল্যকে প্রশ্রয় না দেয়, সেটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। নাস্তা-টাস্তা করার পর সবাইকে নিয়ে জিমন্যাসিয়ামে রওনা হলেন যখন, তখনই তা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ছাত্ররা। একই সঙ্গে ঘুম থেকে ডেকে তোলার ওই অদ্ভুত কায়দা দেখে এটাও যে, ‌‘গুরু’ আজ খুব মুডে আছেন!

‌‘গুরু’ মানে গর্ডন কাথবার্ট গ্রিনিজ আসলেই এখন ভালো মুডে আছেন। একটা গোটা দেশের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করার সুযোগটাকে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাওয়ার পর তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা, এটা অনেকবারই বলেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা বুঝতেও তাঁর বেশিদিন লাগেনি যে, ঠিক দেশটাকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে উন্মাদনা দেখেছেন, বুঝতে পেরেছেন আইসিসি ট্রফি শুধুই একটি টুর্নামেন্ট নয় এ দেশের জন্য, অনুভব করেছেন ১২ কোটি মানুষের এক দেশ উৎসবে মেতে ওঠার মতো একটি আনন্দের উপলক্ষ এনে দেওয়ার দায়িত্বটি তাঁর ওপর দিয়ে উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আছে মালয়েশিয়ার দিকে। এ কারণেই ইংল্যান্ডেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটানো বারবাডোজের মানুষটার সঙ্গে লাল-সবুজ পতাকা হাতে কাঁদতে থাকা মানুষটার কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না রাবার রিসার্চ ইনস্টিউটিউট মাঠে। গর্ডন গ্রিনিজের চোখেও তখন জল!

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের অন্যায়ের শিকার হওয়ার পর রাগে ফুঁসেছেন। হল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর দলের টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানরা যখন হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচটিকে প্রায় মাটিতে ফেলে দিয়েছে, তখন মাঠের বাকি দর্শকদের মতো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনায় নেমেছেন তিনিও। বৃষ্টি এলো, খেলা থেমে গেল ‌‘আজ আমরা এভাবে এক পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালে গেলে এটা হবে পোয়েটিক জাস্টিস’--এ কথা বলে হাসলেন। বৃষ্টি থেমে গেল, খেলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ পরম বন্ধু মনে হওয়া বৃষ্টি পরিণত হয়েছে চরম শত্রুতে। বাংলাদেশ টেন্টের (মাঠে ড্রেসিংরুম থাকলে তো!) বাইরে গ্রিনিজ তখন একটা বল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন মিনতি করলেন,‌‘ আর পনেরো মিনিটের জন্য একটা বৃষ্টি আয় না!’ বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়ে টেনশনটা ভাগাভাগি করছিলেন। হঠাৎই মুখে কপট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন, ‌‘এই এখানে কি তোমাদের? নো ইন্টারভিউ!’

এই ছবি স্বপ্ন পূরণের পর। আইসিসি ট্রফি জেতার পর বাংলাদেশ দলের সঙ্গে গর্ডন গ্রিনিজ (সবার বাঁয়ে দাঁড়ানো)। ছবি: শা. হ. টেংকু

আইসিসি ট্রফি খেলতে রওনা হওয়ার আগে যেমন, তেমন কুয়ালালামপুরে এসেও প্রথম কয়েকদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ নির্লিপ্ত আচরণ করেছেন। কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের শহর কুয়ালালামপুরের দূরদূরান্তের মাঠে পৌঁছে যখন দেখতে পেয়েছেন, দলের আগেই সাংবাদিকেরা মাঠে, স্বাভাবিকভাবেই একটু অন্য অনুভূতি হয়েছে তাঁর। আস্তে আস্তে প্রেসের সঙ্গে তাঁর আচরণে উপেক্ষাকে ছাপিয়ে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ স্পষ্ট হয়েছে। হল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়ালেন, বাংলাদেশকে টুর্নামেন্ট থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সাদা দেশগুলো যে জোট বেঁধেছে, জানালেন সেই ক্ষোভের কথা। ম্যাচশেষে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে এবং হোটেলে ফেরার সময় বাসে যে সকাল-বিকালে একটা-দুটো সাদা ধরে তা দিয়ে নাস্তা সারার ইচ্ছে স্লোগান হয়েছে খেলোয়াড়দের কণ্ঠে, তা এমনিতেই হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় দেড় যুগের খেলোয়াড়ি জীবনে বর্ণবাদের নোংরামি অনেক দেখেছেন গ্রিনিজ, দেখছেন কোচ হিসেবে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংসেও।

বাংলাদেশ টেন্টের বাইরে দাঁড়ানো গর্ডন গ্রিনিজ হাতের বলটি নিয়ে বোলিংয়ের ভঙ্গি করছিলেন, লেগ-ব্রেকের গ্রিপ! ‌‘আপনি কি লেগ-ব্রেক বোলিং করতেন নাকি’ প্রশ্নটা শুনে গ্রিপটা বদলালেন। বলের সেলাইটার দুপাশে তর্জনী ও মধ্যমা রেখে বললেন, ‌‘না, আমি করতাম স্লো মিডিয়াম পেস। ভেরি স্লো!’

'স্লোয়ার দ্যান আতহার আলী?’ ‌

গ্রিনিজ হাসলেন, ‌‘লিটল ফাস্টার দ্যান নাইন্নু’! নাইন্নু মানে নান্নু, গ্রিনিজের মুখে নামগুলো শুনতে দারুণ লাগে।

এর মধ্যেই ঝিরঝির করে আবার এলো কাঙ্ক্ষিত সেই বৃষ্টি। ড্রেসিংরুমের ভেতরে ঢুকে মুখে হাত দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে এক পাক আনন্দের নাচ নেচে ফেললেন গ্রিনিজ। রাগলে তাঁর অন্য চেহারা, কিন্তু এমনিতেই আনন্দপ্রিয়। নান্নু সেই নাচ দেখে বললেন, ‌‘এখনও যে শয়তান, ২৫ বছর বয়সে যে ও কী ছিল!’ কিন্তু সেই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকল না। হয় সেমিফাইনাল, নয়তো বিশ্বকাপের স্বপ্নের সমাধি--এ অবস্থায় খেলা শুরু হলো, গ্রিনিজ দাঁড়িয়ে থাকলেন পুরোটা সময়। নান্নু ও মনি আউট হওয়ার সময় তাঁর মুখ অনেকটাই ঝুলে পড়ল। আবার আকরাম যখন তাঁর স্বপ্নের ইনিংসটি গড়ছেন এক-একটি আত্মবিশ্বাসী স্ট্রোকে, তাঁর চোখে তখন আশার ঝিলিক। এক সময় ম্যাচ শেষ হলো, এতক্ষণ চেপে রাখা উত্তেজনার পর স্বপ্নের এতটা কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার আনন্দ হাসির পরিবর্তে বেরিয়ে এল কান্না হয়ে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুমে কাঁদছেন, কাঁদছেন গর্ডন গ্রিনিজও। কিছুক্ষণ নিজেদের সামলে নিয়ে তাঁকে কাঁধে তুলে নিলেন খেলোয়াড়েরা। দর্শকদের একজন এসে লাল-সবুজ পতাকা দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে দিলেন গ্রিনিজকে।

বাংলাদেশ এখনও বিশ্বকাপের স্বপ্ন হাতের মুঠোয় পায়নি। কিন্তু মাত্র ক'মাসে গর্ডন গ্রিনিজ কী করেছেন, তা বোঝার জন্য সেই অপেক্ষায় থাকার প্রয়োজন নেই। সার্ক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে হতাশ হয়েছিলেন সবাই। টিম ম্যানেজমেন্ট বারবার জানিয়েছিল, টুর্নামেন্টকে নেওয়া হয়েছে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে। তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সে কথাকে ‌‘ব্যর্থতার অজুহাত’ হিসেবে ধরে নেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, সেটা আসলে অজুহাত ছিল না।

টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার আগে গ্রিনিজ আক্ষেপ করেছিলেন,‌ ‌‘আর যদি কয়েকটা মাস সময় পেতাম। টুর্নামেন্টটি সেপ্টেম্বরে হলেই হতো, এখনও দলে অনেক সমস্যা, আরও অনেক উন্নতি করার সুযোগ আছে।' প্রতিটি বিভাগে-বড় বড় জয়ের পরও এ কথা বলেছেন গ্রিনিজ নিজেই। কিন্তু কিছু পরিবর্তন তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। সার্ক ক্রিকেটে ক্যাচের পর ক্যাচ ফেলা দলটিকে এখন চেনা কঠিন। ফিল্ডিংয়ে উন্নতি হয়েছে অনেক, বাজে ফিল্ডার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ দলের অনেকেই এখন যে ফিল্ডিং করেন, তা ঢাকার দর্শকেরা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবেন না।

এর চেয়েও যেটা বড় পরিবর্তন, তা হলো বাংলাদেশ দলকে এখন মাঠে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, অভিন্ন এক লক্ষ্য অর্জনের জন্য একতাবদ্ধ এক ইউনিট। অধিনায়ক আকরাম খান বলতে পারতেন, তাঁর নেতৃত্বেই একতাবদ্ধ হয়েছে দল। কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি বললেন সত্যি কথাটাই, ‌‘এই পুরো ব্যাপারটার জন্য সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব পাওয়া গর্ডন গ্রিনিজের। আমার দৃষ্টিভঙ্গিই পুরো বদলে দিয়েছেন তিনি। সব সময় পজিটিভ চিন্তা করতে শিখিয়েছেন।’ হল্যান্ডের বিপক্ষে  মনি ভালো বোলিং না করায় বেশ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলেন আকরাম। ৪২তম ওভারে বল করতে আসার যে ঝুঁকিটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‌গ্রিনিজ পূর্ব যুগে যে কোনোদিনই তা নিতে সাহস পেতেন না--এটা স্বীকার করলেন আকরাম নিজেই।

ছোটখাট এমন কিছু পরিবর্তনই ক্রিকেটে বড় হয়ে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সই কি তার যথেষ্ট প্রমাণ নয়? গর্ডন গ্রিনিজের হাত দলে বাংলাদেশ এখন স্বপ্নপূরণের একেবারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, সামান্য যে পথটা বাকি. তা যেন ভালোয় ভালোয় শেষ হয়!

আরও পড়ুন: আইসিসি ট্রফি জয়ের পর গর্ডন গ্রিনিজের একান্ত সাক্ষাৎকার
 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×