অস্ট্রেলিয়া যেন অন্য গ্রহের দল
প্রায়ান্ধকারে শেষ হওয়া এক বিশ্বকাপ ফাইনাল!
২০০৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট
উৎপল শুভ্র
২৮ এপ্রিল ২০২১
এই এক বিশ্বকাপেই যেন দুই ধরনের খেলা হলো। বাকি সব দল খেলল একটা, আর অস্ট্রেলিয়া অন্য। হলুদ-নীলরাও ক্রিকেটই খেলল, কিন্তু সেটি অন্য গ্রহের খেলা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এমন দাপট দেখিয়ে কোনো দলকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেনি কেউ এর আগে। চ্যাম্পিয়ন দলকে দুইবার বিজয়োৎসবে মেতে উঠতেও দেখেনি, দেখেনি বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো একটা ম্যাচ প্রায় অন্ধকারে খেলা হতে।
প্রথম প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০০৭। প্রথম আলো।
ফাইনালের সমাপ্তিটা বোধ হয় এই বিশ্বকাপের প্রতীকী রূপ। ক্লান্তিকর দৈর্ঘ্য, তর্কযোগ্যভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত কোচের রহস্যময় মৃত্যু, একের পর এক একপেশে ম্যাচ, আইসিসির ‘মাথামোটা’ কর্তাদের সৌজন্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্বাদটাই হারিয়ে যাওয়া...ফাইনালটার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল সব ভুলিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপটাকে স্মরণীয় করে রাখার। ফাইনাল সেই দায় নিলে তো! উল্টো ফাইনালেই হলো এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারিটা।
অস্ট্রেলিয়ানরা যে দুই বার বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব করল, প্রতীকী মনে হচ্ছে সেটিকেও। অন্য গ্রহের ক্রিকেট খেলে যেমন অনায়াসে টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতল অস্ট্রেলিয়া, একই সাফল্য দুবার উদযাপন করার ‘সুযোগ’কে মনে হচ্ছে এরই পুরস্কার! রিকি পন্টিং তাতে একটুও খুশি নন। প্রহসনে পরিণত হওয়া ফাইনালের সমাপ্তিটা যে তাঁর দলের অবিশ্বাস্য কীর্তিকেও আড়ালে ঠেলে দেওয়ার উপক্রম করছে, এটা তাঁর ভালো লাগবে কেন? সংবাদ সম্মেলনে এসে রিকি পন্টিং তাই সাংবাদিকদের কাছে যেন অনুনয়ই করলেন, ‘আশা করি, শেষ ১৫-২০ মিনিটকে শিরোনাম না বানিয়ে আমরা এই বিশ্বকাপে যে ক্রিকেটটা খেলেছি, সেটি আপনারা ভুলে যাবেন না।’
কেউই তা ভুলছে না, ভোলা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই শেষ ‘১৫-২০ মিনিট’কেও যে ভোলা যাচ্ছে না! এই প্রথম বৃষ্টির কারণে সংক্ষিপ্ত হয়েছে বিশ্বকাপ ফাইনাল, এই প্রথম খেলা ‘শেষ’ হয়ে যাওয়ার পরও আবার তা শুরু হয়েছে! দ্বিতীয়টি শুধু বিশ্বকাপ ফাইনালেই নয়, ক্রিকেট ইতিহাসেই প্রথম। কেনসিংটন ওভালে সন্ধ্যা নেমে গেছে, জ্বলে গেছে রাস্তার বাতি, ব্যাটসম্যানরা বল দেখছেন না। অস্ট্রেলিয়ার দুই স্পিনার শুধু হাত ঘুরিয়ে বল করে যাচ্ছেন, আর ব্যাটসম্যানরা অন্ধের মতো ব্যাট এগিয়ে দিচ্ছেন—এভাবে কিনা শেষ হলো একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল!
এর আগেও একবার ‘শেষ’ হয়ে ছিল! শেষ ৩ ওভারে দরকার ৬৩ রান, উইকেটে শ্রীলঙ্কার দুই পেস বোলার, অন্ধকারে বল দেখা যাচ্ছে না। ভাস আর মালিঙ্গাকে দুই আম্পায়ার ‘লাইট অফার’ করতেই মেনে নিলেন তাঁরা। অস্ট্রেলিয়ানরা মেতে উঠল বিশ্বকাপ-জয়ের হ্যাটট্রিকের আনন্দে। জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্মারক হিসেবে একটা স্টাম্প তুলে নিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। শুরু হয়ে গেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। অথচ বাকি ৩ ওভার শেষ করতে আবার শুরু হলো খেলা!
অস্ট্রেলিয়ানদের বিশ্বকাপ-জয়ের উৎসবের মধ্যে ঢুকে আম্পায়ার আলিম দার যখন রিকি পন্টিংকে গিয়ে বললেন, খেলা এখনো শেষ হয়নি, তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ়। ডাকওয়ার্থ-লুইসে ইনিংসের ২০ ওভার হলেই খেলা শেষ হয়ে যায়—বিশ্বের সেরা আম্পায়াররাও কীভাবে যেন তা ভুলে গেলেন! আলিম দারের সঙ্গে ফিল্ড আম্পায়ার স্টিভ বাকনর, টিভি আম্পায়ার রুডি কোয়ের্তজেন, ফোর্থ আম্পায়ার বিলি বাউডেন, ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো...কী সব নাম! অথচ তাঁরাই কিনা ওয়ানডের একেবারেই মৌলিক আইন ভুলে গিয়ে দুই অধিনায়ককে জানালেন, বাকি ৩ ওভার হবে পর দিন। মাঠে এ নিয়ে মিনি একটা মিটিংও হলো। বাকি ৩ ওভার স্পিনাররাই করবে—পন্টিংয়ের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর মাহেলা জয়াবর্ধনে জানালেন, তা হলে আজই আমরা খেলব।
দুই অধিনায়কের মাঝখানে সংবাদ সম্মেলনে এসে ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রো নিজেদের ভুল স্বীকার করলেন। রিকি পন্টিং ও মাহেলা জয়াবর্ধনের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এর আগেই। পন্টিংয়ের দুঃখ তারপরও যাচ্ছে না, ‘এমন একটা বিশ্বকাপ খেললাম আমরা, আর সেটির এমন সমাপ্তি! বিশ্বকাপটা আমরা এভাবে শেষ করতে চাইনি।’
এই এক বিশ্বকাপেই যেন দুই ধরনের খেলা হলো। বাকি সব দল খেলল একটা, আর অস্ট্রেলিয়া অন্য। হলুদ-নীলরাও ক্রিকেটই খেলল, কিন্তু সেটি অন্য গ্রহের খেলা।
যেভাবে শেষ করতে চেয়েছিলেন, সেভাবেই খেলেছে তাঁর দল। সনাৎ জয়াসুরিয়া ও কুমার সাঙ্গাকারার পার্টনারশিপটির সময় ছাড়া আর কখনোই অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ-জয় নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ও জাগেনি। শেষ পর্যন্ত ৫৩ রানের বড় ব্যবধানে হারল শ্রীলঙ্কা, তারপরও এটিই এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোনো দলের সেরা পারফরম্যান্স! এই এক বিশ্বকাপেই যেন দুই ধরনের খেলা হলো। বাকি সব দল খেলল একটা, আর অস্ট্রেলিয়া অন্য। হলুদ-নীলরাও ক্রিকেটই খেলল, কিন্তু সেটি অন্য গ্রহের খেলা। ‘এমন আধিপত্য দেখিয়ে আর কোনো দল কোনো বিশ্বকাপ জেতেনি। ভালো ভালো সব দলকেও আমরা একেবারে সাধারণ বানিয়ে ফেলেছি’—সবার জানা কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন রিকি পন্টিং।
মাহেলা জয়াবর্ধনে এর আগেই বলে গেছেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেও ট্রফিটা হাতে নিতে না পারার হতাশা তো আছেই, কিন্তু শ্রীলঙ্কান অধিনায়ককে একটুও বিষণ্ন মনে হলো না! ‘অস্ট্রেলিয়া যা খেলেছে, তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না। বড় টুর্নামেন্টে ওরা ওদের খেলাটাকে অন্য পর্যায়ে তুলে নেয়’—জয়াবর্ধনের কণ্ঠেও মুগ্ধতা।
৩৮ ওভারে অস্ট্রেলিয়া ২৮১ করে ফেলার পরই পন্টিংয়ের হাত থেকে ট্রফিটা কেড়ে নেওয়ার স্বপ্নটাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিলেন জয়াবর্ধনে, ‘দু শ চল্লিশ-টল্লিশ হলেও চেজ করা যেত। ২৮১ সম্ভব ছিল না। গিলি এমন মেজাজে থাকলে কোনো দলেরই কিছু করার থাকে না।’
‘গিলি’ মানে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, যার ১০৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসটি শুধু বিশ্বকাপ ফাইনালেরই সেরা নয়, সেটি ওয়ানডের সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলোর ছোট্ট তালিকারও ওপরের দিকে। ইনিংসটির বর্ণনায় ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটি বারবার বললেন পন্টিং। ‘আপনারা কেউ এর চেয়ে ভালো ইনিংস দেখেছেন কি না, জানি না। আমি দেখিনি’—আগের বিশ্বকাপের ফাইনালে নিজে খেলেছিলেন অপরাজিত ১৪০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস, গিলক্রিস্টের ‘অবিশ্বাস্য’ ব্যাটিংয়ের কাছে সেটিকেও তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে পন্টিংয়ের!
১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে হারার পর টানা ২৯টি ম্যাচে অপরাজিত, সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ‘টাই’য়ের পর টানা ২৩ ম্যাচে জয়—বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া এমনই এক বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাঁদের কাছেই জানতে চাইতে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াকে থামানোর পথ! গ্লেন ম্যাকগ্রা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘এটা বিনে পয়সায় বলা যাবে না।’
এমন একটা ইনিংস খেলার রহস্যের উত্তর দিতে গিয়ে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট যা বললেন, তা থেকে অবশ্য চাইলে একটা উত্তর পেতে পারেন, ‘এই দল খেলাটা এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, সেটির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে নিজের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।’ দলে অসাধারণ সব খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি আসল কারণ নয়, নিজেদের পারফরম্যান্সকে ওপরে, আরও ওপরে তুলে নেওয়ার যে নিরন্তর তাড়না, সেটিই আসলে অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়া বানিয়েছে।
এক দলে এত ‘গ্রেট’ খেলোয়াড় থাকলে ব্যক্তিত্বের সংঘাতের ভয় থাকে। অস্ট্রেলিয়া সে দিক থেকেও ব্যতিক্রম। সবাই যেন এক মন-এক প্রাণে মিলেমিশে একাকার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ায় সবচেয়ে বেশি কী মিস করবেন—এই প্রশ্নের উত্তরে গ্লেন ম্যাকগ্রা তাই পাশে বসে থাকা পন্টিং-গিলক্রিস্টকে দেখিয়ে বলেন, “ওদের সঙ্গে খেলাটা। ‘আমরাই জিতব’ এই বিশ্বাস নিয়ে প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নামার অনুভূতিটা।”
শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছেন আগেই। বিশ্বকাপ ছিল তাঁর বিদায় জানানোর মঞ্চ। দেখা গেল, সেই বিশ্বকাপ শেষেও মঞ্চ আলো করে বসে আছেন তিনিই। এক বিশ্বকাপে ২৬ উইকেট নেওয়ার নতুন রেকর্ড গড়ে গ্লেন ম্যাকগ্রাই ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। তার পরও আক্ষেপ আছে পন্টিংয়ের! ম্যাকগ্রাকে বিদায় সংবর্ধনা দিতে শেষ ওভারটা তাঁকে দিয়ে করাবেন বলে একটা ওভার রেখে দিয়েছিলেন, শেষের ‘কেলেঙ্কারি’তে তা আর হলো না। অন্ধকারের মধ্যে শুধু স্পিনই করানোর কথা ছিল, ম্যাকগ্রা কি স্পিন বোলিং করতে পারেন না? পন্টিং কিছু বলার আগেই ম্যাকগ্রা বললেন, ‘আমি এখন যে গতিতে বল করি, এর সবই তো আর্মার।’
গত কিছু দিনে অস্ট্রেলিয়া দল থেকে অনেক তারা ঝরে গেছে। গ্লেন ম্যাকগ্রাও গেলেন। তার পরও অস্ট্রেলিয়ার জয়রথ থামবে বলে মনে হচ্ছে না। ওরা যে অন্য গ্রহের দল!
আরও পড়ুন: রেপ্লিকার বদলে আসল ট্রফিটাই দাবি করতে পারে অস্ট্রেলিয়া