১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭...বিশ্বজয়ের হ্যাটট্রিক

রেপ্লিকার বদলে আসল ট্রফিটাই দাবি করতে পারে অস্ট্রেলিয়া!

২০০৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

উৎপল শুভ্র

২৮ এপ্রিল ২০২১

রেপ্লিকার বদলে আসল ট্রফিটাই দাবি করতে পারে অস্ট্রেলিয়া!

বিশ্বকাপ জয়ের হ্যাটট্রিক! ২০০৭ বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে ব্রিজটাউনে অস্ট্রেলিয়া দল। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সংজ্ঞাও বোধ হয় পাল্টে দেওয়ার সময় এসেছে। সেই সংজ্ঞাটা হওয়া উচিত এমন—বিশ্বের সেরা দলগুলোকে নিয়ে ওয়ানডে টুর্নামেন্ট, যেটিতে অস্ট্রেলিয়া শিরোপা জেতে! প্রথম ৬টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মাত্র একবার, সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপে তিনবার!

প্রথম প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০০৭। প্রথম আলো।

অস্ট্রেলিয়া: ৩৮ ওভারে ২৮১/৪ (গিলক্রিস্ট ১৪৯, হেইডেন ৩৮) শ্রীলঙ্কা: ৩৬ ওভারে ২১৫/৮ (জয়াসুরিয়া ৬৩, সাঙ্গাকারা ৫৪)। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ: অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট: গ্লেন ম্যাকগ্রা।

প্রেসবক্সে বসেও বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ কয়েকটা ওভারের খেলা দেখতে হলো টিভিতে! মাঠের দিকে তাকিয়ে যে বল দেখা যাচ্ছিল না! খেলা শেষ হওয়ার আধঘন্টা আগেই গ্যালারির লাইট জ্বলে গেছে। শেষ ৫-৬ ওভার হলো বলতে গেলে অন্ধকারে। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো কোনো ম্যাচে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এটা চোখে না দেখলে সবার কাছে তা অবিশ্বাস্যই মনে হতো।

অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যও এখন প্রায় অবিশ্বাস্য রূপ নিয়ে ফেলেছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সংজ্ঞাও বোধ হয় পাল্টে দেওয়ার সময় এসেছে। সেই সংজ্ঞাটা হওয়া উচিত এমনবিশ্বের সেরা দলগুলোকে নিয়ে ওয়ানডে টুর্নামেন্ট, যেটিতে অস্ট্রেলিয়া শিরোপা জেতে! প্রথম ৬টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মাত্র একবার, সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপে তিনবার!  নয় বিশ্বকাপ শেষে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে চার। দুই বার বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব আছে আর মাত্র একটি দলের। রেপ্লিকার বদলে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের আসল ট্রফিটাই দাবি করে বসলে খুব অন্যায় হবে না!

কাল প্রায়ান্ধকার কেনসিংটন ওভালে টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের পর পন্টিংয়ের দলের বিজয়োৎসব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়ানদের এই আধিপত্য ক্রিকেটের সীমানা ছাপিয়ে যেকোনো দলীয় খেলার ক্ষেত্রেই বোধ হয় নতুন ইতিহাস গড়ে ফেলছে।

নতুন ইতিহাস হলো বিশ্বকাপ ফাইনালেও। এই প্রথম বৃষ্টির কারণে সংক্ষিপ্ত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল। এই প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষ হলো নতুন রীতিতে। ৩৩ ওভার শেষে শ্রীলঙ্কার স্কোর যখন ৭ উইকেটে ২০৬, ক্রিজে থাকা শ্রীলঙ্কার দুই ব্যাটসম্যান লাসিথ মালিঙ্গা ও চামিন্ডা ভাসের কাছে আম্পায়াররা জানতে চাইলেন, তারা খেলা চালিয়ে যেতে চান কি না। মাঠে তখন আলোআঁধারি, গ্যালারিতে বাতি জ্বলে গেছে অনেক আগেই, ভাস-মালিঙ্গা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ম্যাচের  ফলাফল চূড়ান্ত হয়ে গেছে আগেই, বাকি ৩ ওভার খেলা না খেলা সমান কথা। ব্যাটসম্যানরা ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন, মাঠে বিজয়োৎসবে মেতে উঠল অস্ট্রেলিয়া দল। অথচ ম্যাচ সমাপ্ত ঘোষণার করার পরও আম্পায়ারদের ভুলের কারণে অস্ট্রেলিয়াকে বাকি ৩ ওভারও খেলতে হলো। তা প্রায় অন্ধকারে এবং দুই প্রান্ত থেকেই স্পিনারদের নিয়মরক্ষার বোলিংয়ে।

প্রমত্ত অ্যাডাম গিলক্রিস্ট সেদিন বলতে গেলে একাই মীমাংসা করে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালের। ছবি: গেটি ইমেজেস

অস্ট্রেলিয়ানদের আনন্দটা তাতে একটু বিলম্বিতই হলো মাত্র। ম্যাচ তো তারা আগেই জিতে গেছে। বলা যায় তাদের ইনিংসটির শেষেই। এক হাতে হেলমেট, অন্য হাতে ব্যাট তুলে তুমুল করতালির প্রাপ্তি স্বীকার করতে করতে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, মনে হলো বিশ্বকাপটা তখনই দিয়ে দেওয়ার দাবিও তিনি করতে পারেন! ৩১তম ওভারে অস্ট্রেলিয়া তখন ২ উইকেটে ২২৪। ৪৫ বল তখনো বাকি। এই বিশ্বকাপে প্রথমে ব্যাট করলেই তিন শ রানের যে নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া, এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছিল না। ৫০ ওভার থেকে কমে ম্যাচ ৩৮ ওভারের হয়ে গেছে, সেটাই যেন নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে আরও উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল পন্টিংয়ের দলকে।

শেষ পর্যন্ত যে তা হলো না, ৩৮ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর হলো ৪ উইকেটে ২৮১, এর কারণও ওই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট! গিলক্রিস্ট আউট হয়ে যাওয়ার পর বাকি ৪৫ বলে অস্ট্রেলিয়া তুলেছে ৫৭। খারাপ নয়, কিন্তু খুব ভালোও মনে করতে দিচ্ছিল না গিলক্রিস্টের ওই মহাকাব্যিক ইনিংস। গিলক্রিস্ট আর ৪-৫ ওভার থাকলে কী হতো, তা শুধু অনুমানই করা যায়। কোনো বোলারকেই বোলার মনে করেননি, কোনো বলকেই মারার অসাধ্য নয়, ১০৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসটি শুধু সংখ্যাবিচারেই বিশ্বকাপ ফাইনালের সর্বোচ্চ নয়, ব্যাটসম্যানশিপের বিবেচনাতেও সেটি ওয়ানডে ইতিহাসে সেরা ইনিংসগুলোর মধ্যে ঢুকে গেল।

অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক-শিরোপাও এক রকম নিশ্চিত হয়ে গেল ওতেই। ৫০ ওভারের ম্যাচেও ২৮১ অনেক বড় স্কোর। আর ৩৮ ওভারে ২৮২ রানের টার্গেট ছোঁয়া, সেটি কেনসিংটন ওভালের এই উইকেট যতই ব্যাটিংবান্ধব হোক না কেন, প্রায় অসম্ভবই। সে জন্য শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের কারো ব্যাট থেকে অতিমানবীয় একটা ইনিংস আসতে হতো। কিন্তু এক ম্যাচে কি আর দুটি অতিমানবীয় ইনিংস সম্ভব? অ্যাডাম গিলক্রিস্ট যে তা খেলে ফেলেছেন!

এই বিশ্বকাপটা তাঁর খুব ভালো যায়নি। ফাইনালের আগে ১০ ম্যাচে ৩০৪ রান, সর্বোচ্চ বাংলাদেশের বিপক্ষে অপরাজিত ৫৯। ওপেনিং পার্টনার ম্যাথু হেইডেন যেখানে ম্যাচের পর ম্যাচ রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে দিয়েছেন, গিলক্রিস্টকে হয়ে থাকতে হয়েছে নীরব দর্শক। আর এদিন ১৭২ রানের ওপেনিং জুটিতে হেইডেনকেই দর্শক বানিয়ে রাখলেন গিলক্রিস্ট। ১৭২ রানে হেইডেনের অবদান মাত্র ৩৮! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬৬ বলে সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপে দ্রুততম সেঞ্চুরির যে রেকর্ড গড়েছেন হেইডেন, সেটিও প্রায় ভেঙে দিচ্ছিলেন। ৬৪ বলে ৯৩ হয়ে গিয়েছিল, বাকি ৭ রান করতে আরও ৮ বল খেলতে হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি হয়েছে ৭২ বলে। যাতে ৮টি চার ও ৬টি ছয়। গিলক্রিস্টের যখন ১০০, অস্ট্রেলিয়ার স্কোর মাত্র ১৪৮অন্য প্রান্তে হেইডেনের মতো ব্যাটসম্যান থাকার পরও এই একাধিপত্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকাপ ফাইনালের গিলক্রিস্টকে।

বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও মাাথু হেইডেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

দিলহারা ফার্নান্ডো এই ম্যাচ কোনোদিন ভুলবেন বলে মনে হয় না। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল, এমনিতেও ভোলার কথা নয়। তবে এখন মনে রাখাটা হবে অন্য রকম। ৮ ওভারে ৭৪ রান দিয়েছেন, এটার চেয়েও তাঁকে বেশি তাড়িয়ে বেড়াবে নিজের বোলিংয়ে গিলক্রিস্টের ওই ক্যাচটা না নিতে পারার ব্যর্থতা। গিলক্রিস্টের রান ছিল তখন মাত্র ৩১। শেষ পর্যন্ত গিলক্রিস্টের উইকেটটি দিলহারাই পেয়েছেন, কিন্তু ততক্ষণে শ্রীলঙ্কার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে।

মজার ব্যাপার হলো, গিলক্রিস্টের এই ব্যাটিং-তাণ্ডব শুরু হলো ১০ ওভারের বাধ্যতামূলক পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পর। ১০ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর মাত্র ৪৬। একটা কারণ অবশ্যই লাসিথ মালিঙ্গা। তিন বছর আগে মালিঙ্গাকে টেস্টে খেলেছিলেন গিলক্রিস্ট ও হেইডেন, ওয়ানডেতে কখনোই খেলেননি। কাল তাই মালিঙ্গার ব্যতিক্রমী অ্যাকশন আর গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ভালোই সমস্যা হলো গিলক্রিস্ট-হেইডেনের। হেইডেনেরই বেশি। মালিঙ্গার ১৮ বল খেলে ৮ রান, সেটিও দ্বিতীয় স্পেলে ফিরতেই একটি ছক্কা মেরে দিয়েছেন বলে। নইলে মালিঙ্গার প্রথম স্পেলের ১৪ বল খেলে মাত্র ১ রান করতে পেরেছিলেন হেইডেন। মালিঙ্গার প্রথম ৩ ওভারে ৩, ৪ ওভারে ৬রান যা হচ্ছিল, সব অন্য প্রান্ত থেকে।

সে প্রান্তটি যাঁর নামে, সেই জোয়েল গার্নার ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলারদের একজন। অথচ সেই জোয়েল গার্নার প্রান্তে যে-ই বল করতে এলেন, তিনিই অকাতরে রান বিলাতে থাকলেন। ভাস প্রথম ৩ ওভারে ২৯, দিলহারা ফার্নান্ডোও তা-ই, তিলকরত্নে দিলশান ২ ওভারে ২৩। দিলহারা ফার্নান্ডো ফিরতি ক্যাচটা ফেলার পরই আসলে শুরু গিলক্রিস্টের তান্ডব। পরের দুই বলে চার, তৃতীয় বলে লং অফের ওপর দিয়ে বিশাল এক ছক্কা। এমনই ব্যাটিং করেছেন যে, হেইডেন পর্যন্ত পরিণত হয়েছেন মুগ্ধ দর্শকে। একটু পর দিলহারার বলেই লং অফের ওপর দিয়ে এমন অনায়াস একটি ছক্কা মারলেন যে, হেইডেন এসে জড়িয়ে ধরলেন গিলক্রিস্টকে। এমনিতে শুধু সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি হলেই পার্টনারকে এমন জড়িয়ে ধরতে দেখা যায়, শুধুই একটি শটের পর জড়িয়ে ধরাটাকে অভূতপূর্বই বলতে হবে।

গিলক্রিস্টের ইনিংসটিকেও যে অনেকে অভূতপূর্ব বলে ফেলতে পারেন। ১৭২ রানের যে উদ্বোধনী জুটিটি কাল শ্রীলঙ্কার স্বপ্ন মুছে দিল, সেটি বিশ্বকাপ ফাইনালে নতুন পার্টনারশিপ রেকর্ড। আগের রেকর্ডটি ছিল ১৯৭৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইংল্যান্ডের মাইক ব্রিয়ারলি ও জিওফ বয়কটের। ১২৯ রান তুলতে ৩৭ ওভার লাগিয়ে ফেলে তাঁরা দুজন দলকে ডুবিয়েছিলেন। আর গিলক্রিস্ট-হেইডেনের ১৭২ মাত্র ২২.৫ ওভারে। বিশ্বকাপ ট্রফিটাকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করার সুযোগ তো তাঁরাই করে দিলেন অস্ট্রেলিয়াকে।

আরও পড়ুন: প্রেসবক্সে লাইট জ্বলছে, জ্বলছে রাস্তায়ও আর মাঠে কিনা অন্ধকারে চলছে বিশ্বকাপ ফাইনাল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×