পাঁচ বছর ও ৪৭ ম্যাচ পর সেই জয়-১
উৎপল শুভ্র
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ম্যাচের পর ম্যাচ হারতে হারতে জয়ের স্বাদই ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর জয়হীন টানা ৪৭টি ওয়ানডে! ২০০৪ সালের ১০ মার্চ হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়টা ছিল তাই দীর্ঘ খরার পর এক পশলা বৃষ্টি।
প্রথম প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০০৪। প্রথম আলো।
প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতা ওয়ানডে ক্রিকেটকে যতই বদলে দিক, বাংলাদেশ বদলাচ্ছে না। বাংলাদেশ আগের নিয়মেই খেলতে চায়। পুরনো নিয়মে খেলেও যে আধুনিক যুগে সাফল্য পাওয়া যায়—কাল হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সেটিই দেখাল বাংলাদেশ।
প্রথম ১৫ ওভার যে বাংলাদেশ আগের নিয়মেই খেলল, এতে অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। বেশির ভাগ ওয়ানডের জয়-পরাজয় যেখানে নির্ধারিত হয়ে যায়, সেই প্রথম ১৫ ওভারে বাংলাদেশ যে এক যুগ আগের নিয়মেই ব্যাট করবে, ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগেই তা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার।
হাতে যত বেশি সম্ভব উইকেট রাখো, তারপর শেষ ১০ ওভারে ঝড় তোলো— ওয়ানডে ক্রিকেট এই নিয়মই অনুসরণ করে এসেছে অনেক দিন। ’৯২ বিশ্বকাপে মার্ক গ্রেটব্যাচকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে শেষের ঝড়টা যে শুরুতেই তোলা যায়, সেটি প্রথম দেখাল নিউজিল্যান্ড। এরপর ’৯৬ বিশ্বকাপে সনাত্ জয়াসুরিয়া আর রুমেশ কালুুভিতারানার উদ্বোধনী জুটি তো ওয়ানডে ক্রিকেটকে চিরদিনের মতোই বদলে দিল।
না, বাংলাদেশ বদলায়নি। আসলে বদলাতে পারেনি। অবশ্যম্ভাবীভাবেই ইনিংসের শুরুতে মুখোমুখি হতে হয় প্রতিপক্ষের সেরা দুই পেসারের। সেই বোলিংয়ের বিপক্ষে প্রথম ১৫ ওভারের সুবিধে নেওয়ার সামর্থ্য আসলে বাংলাদেশের ওপেনারদের নেই। আছে কি নেই, এ নিয়ে আসলে সেভাবে আলোচনাই হয় না। কারণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ ম্যাচের তো একই চিত্র, ইনিংস শুরু হতে না হতেই দু-তিনটি উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে শুরু করে বাংলাদেশ। এর চেয়ে বরং হাতে উইকেট রেখে পুরনো নিয়মে খেলাটাই যে বাংলাদেশের জন্য ভালো, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তা ভালোই জানে বাংলাদেশ। কাল তারা তাই সেভাবেই খেলল এবং সেভাবে খেলেও যে জেতা যায়, দেখাল তা-ই।
প্রথম ১৫ ওভারের সুবিধা নেওয়ার একটা চেষ্টা অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। পাকিস্তানে হাবিবুল বাশারকে ওপেনিংয়ে তুলে আনা হয়েছিল এ কারণেই। অলক কাপালিকে ওপেনার বানানোর পেছনেও কাজ করেছে এই ভাবনাই। শাহরিয়ার হোসেনের সঙ্গে অলক কাপালি—কাগজে কলমে বিধ্বংসী এক জুটিরই প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কাগজে-কলমের হিসাব এক কথা, আর সেটি মাঠে অনূদিত হওয়া আরেক কথা। অলক কাপালির কট বিহাইন্ড হওয়ার মাধ্যমে ওপেনিং জুটি যখন ভাঙল, স্কোরবোর্ডে তখন তাই ৬ ওভারে মাত্র ১৪ রান। ৬ রান পর শাহরিয়ারও যখন তাঁর অনুগামী হলেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যাওয়া-আসার পরিচিত দৃশ্য পুনরাভিনীত হওয়াটা নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছিল। তা হতে দিলেন না হাবিবুল বাশার ও রাজিন সালেহ। রণকৌশল ঠিক করাই ছিল। রান তো তুলতে হবেই, তবে তার চেয়েও জরুরি দায়িত্ব হলো, আউট হওয়া যাবে না। সেই কাজে তাঁরা সফল বলেই পরের ২৮ ওভারে কোনো উইকেট পড়ল না।
অধিনায়কত্ব পেয়ে হাবিবুল বাশারের মনে অনেক অনুভূতিই খেলা করেছে। তার মধ্যে ছিল একটা স্বস্তিরও। এবার অন্তত ওয়ানডে দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। হয়তো সেই নির্ভার মানসিকতাই অনেক দিন পর ওয়ানডেতে হাবিবুলকে হাবিবুলের মতো ব্যাট করতে দিল। মাত্র ৮০ বলে ৬১ রানের ইনিংস এই সফরে তাঁর সব দুঃস্মৃতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার কাজটাও করল। অসাধারণ কিছু শট খেলেছেন, যার মধ্যে সেরা বলে মানতে হবে মাওয়্যারের বলে ফ্লিক করে মারা বাউন্ডারিকে। মাওয়্যারের সেই ওভারে ৩টি চার মেরেছেন হাবিবুল, তবে সেই ফ্লিকটির কাছে বাকি সব ম্লান। ক্যারিয়ারের শুরুতে তার প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিলেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, সেই ফ্লিকটি মুহূর্তের জন্য আজহারউদ্দিন মনে করাল তাঁকেও।
দুটি সিরিজ খেলার পরই সহ-অধিনায়ক হয়ে গেছেন রাজিন সালেহ, এটা যতটা বিস্ময়ের, তার চেয়ে বেশি রাজিনের পরিণত ক্রিকেট মস্তিষ্কের প্রমাণ। ওয়ানডেতে তার নবম ইনিংসে তৃতীয় ফিফটিটি পেলেন কাল, রেমন্ড প্রাইসের বলে বিশাল এক ছক্কা যে ইনিংসের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক। তারপরও হাবিবুল আর রাজিন ১১৪ রানের জুটি গড়তে একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলেছেন কি না, সে প্রশ্ন উঠছিলই। ৪০ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৪ উইকেটে ১৪৯। সেখান থেকে ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ২৩৮!
দুঃস্বপ্নের মতো গত বিশ্বকাপেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাতে উইকেট থাকার সুবিধে কাজে লাগিয়ে শেষ ১০ ওভারে ৬৬ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তান সফরে পিন্ডিতে চতুর্থ ওয়ানডেতে ১০ ওভারে এসেছিল ৭৭। কাল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেল সেগুলোকেও। শেষ ১০ ওভারে এল ৮৯ রান, শেষ ৬ ওভারে ৬৩। অধিনায়কত্বের চাপে খালেদ মাহমুদের যে ব্যাটিং হারিয়েই গিয়েছিল, নির্ভার ব্যাটে আবার তার ঝলক। রান আউট হওয়ার আগে ১৫ বলে ২২, হন্ডোকে পুল করে একটি বিশাল ছয় মারলেন। তার চেয়েও তাকে বেশি চেনাল এক্সস্ট্রা কভারের ওপর দিয়ে বুলেটের গতিতে ছুটে যাওয়া দুটি ড্রাইভ।
তবে এতক্ষণ যাঁদের কথা বলা হলো, আসল নায়ক তাঁদের কেউই নন। নায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। গত পরশু বিকেলে একটা প্রার্থনার কথাই বলছিলেন, পরদিন যেন প্রথম ১৫/১৬ ওভারের মধ্যে নামতে না হয়। নতুন করে শুনেছিলাম পুরনো আক্ষেপটাও, ‘আগে কেমন ইচ্ছেমতো শট খেলতাম! এখন চাইলেও অনেক সময় পারি না।’ খেলার আনন্দে খেলার দিন ফুরিয়েছে, দায়িত্বের চাপ কেড়ে নিয়েছে ইচ্ছেমতো শট খেলার স্বাধীনতা। কাল যেন আবার খেলার আনন্দে খেলার সেই ফেলে আসা কৈশোরে ফিরে গেলেন আশরাফুল।
খেলার আনন্দে খেলার দিন ফুরিয়েছে, দায়িত্বের চাপ কেড়ে নিয়েছে ইচ্ছেমতো শট খেলার স্বাধীনতা। আবার যেন খেলার আনন্দে খেলার ফেলে আসা কৈশোরে ফিরে গেলেন আশরাফুল।
৪০তম ওভারে নেমেছেন, শট খেলার স্বাধীনতা এনে দিল সেটিই। আর আশরাফুল শট খেললেনও। এর আগে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাটে এমন ইম্প্রোভাইজেশন দেখা গেছে বলে তো মনে করতে পারছি না। কিছু শট তো মনে করিয়ে দিল জাভেদ মিয়াঁদাদের কথা। মাত্র ৩১ বলে হাফ সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম বলে হাফ সেঞ্চুরি করার রেকর্ড। আগের রেকর্ডটিও ছিল এই জিম্বাবুয়েরই বিপক্ষে। ২০০১ সালে ঢাকায় খালেদ মাহমুদের ৩৭ বলে হাফ সেঞ্চুরিকে দ্বিতীয়-সেরায় পরিণত করে রেকর্ডটিকে নিজের করে নিলেন আশরাফুল। তখন বোঝা যায়নি, সেই রেকর্ডটি শুধুই ব্যক্তিগত রেকর্ড হয়ে থাকবে না। প্রায় ভুলে যাওয়া জয়ের স্বাদও এনে দেওয়ায় মূল ভূমিকাও রাখবে তা।
পাঁচ বছর ও ৪৭ ম্যাচ পর সেই জয়-২
পাঁচ বছর ও ৪৭ ম্যাচ পর সেই জয়-৩