ইতালি-স্পেন সেমিফাইনাল

ইমমোবিলে না মোরাতার রাত?

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

স্বপ্ন চন্দ

৭ জুলাই ২০২১

ইমমোবিলে না মোরাতার রাত?

২০১২ ইউরোর পর এই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পার করল ইতালি ও স্পেন। গত ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে নেওয়া ‘প্রতিশোধ’ ইতালির ফাইনাল হারের ক্ষতে প্রলেপ দেয়নি নিশ্চয়ই। নয় বছরের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর আবার মুখোমুখি নতুন চেহারার ইতালি-স্পেন।

স্পেনের চার বছরের অর্কেস্ট্রার ক্রেসেন্ডো যে ফাইনালে, ইতালির শেষের শুরুটাও সেখান থেকে। তার দুই বছর পর ব্রাজিল বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়। শুরু তুমুল সমালোচনার। ইতালিয়ান ফুটবলের অন্ধকার সময় আগত। প্রয়োজন ছিল একটা টাইম মেশিনের। তাহলেই চার বছর পর এই শেষকৃত্যের আর পুনরাবৃত্তি করতে হয় না।

সেই ফাইনাল তো আসলে স্বর্গরাজ্য থেকে স্পেনেরও মাটিতে নামার শুরু। ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জয়ের রেকর্ড গড়ে দুই বছর পর বিশ্বকাপে তাদেরও একই পরিণতি। মাঝে নয় বছরে দু’দলের অনেক উত্থান-পতনের পর আবার দেখা ইউরো নকআউটে। এবার এক ধাপ আগেই, এই যা। কিন্তু ম্যাচটা যত না সে ফাইনালের পুনঃমঞ্চায়ন, যত না ইতালিয়ানদের প্রতিশোধের সুযোগ, তার চেয়ে বেশি ফুটবলের দুই পরাশক্তির জোর গলায় জানান দেওয়ার–আমরা আছি এখনও।

ঘটনাচক্রে ভিসেন্তে দেল বস্কের স্পেনের সোনালি যুগের শেষটাও ইতালির হাতেই। ২০১৬ ইউরোর রাউন্ড অব সিক্সটিনে ইতালির কাছে হারের পরই দিয়ে দেওয়া হয় স্পেনের টিকি-টাকার মৃত্যু ঘোষণা। ম্যাচের ৩৩ মিনিটে ইতালিকে এগিয়ে দেওয়া কিয়েলিনির গোল এলোমেলোই করে দিয়েছিল স্পেনকে। ওই দলের কেউই যে জানতেন না, ইউরো নকআউট পর্বে গোল খাওয়ার স্বাদ কী রকম। নকআউটে স্পেন শেষ গোলই তো খেয়েছিল তার ১৬ বছর আগে!

২০১২ ইউরো জয়ের পর। ছবি: গেটি ইমেজেস

মোটা দাগে দুই দলের আবার শীর্ষে ফিরে আসার গল্পটা এক মনে হলেও, দুই দলের বেছে নেওয়া রাস্তা একবারে বিপরীত। স্পেন যেখানে শত বাধা-বিপত্তি-সমালোচনার পরও স্থির থেকেছে বিশ্বস্ত টিকি-টাকাতে, ইতালি আমূল পাল্টে ফেলেছে তাদের খেলার ধরন। আর নয় জীবন বাঁচিয়ে খেলা। ইতালির মতো অন্ধকার দিন দেখতে হলে হয়তো স্পেনও টিকি-টাকাকে জলাঞ্জলি দিয়ে খুঁজতে নামত নতুন পথ। তা হতে তো পারত কতকিছুই, সে ফাইনালে ১০ জন নিয়ে খেলতে না হলে হয়তো সে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসতে পারে ইতালি, ওলটপালট হয়ে যায় গত কয়েক বছরের ইতিহাস। বর্তমানেই বরং থাকা যাক।

ম্যাচের প্রায় পুরো সময়েই বল স্পেনের পায়ে থাকবে বল, ইতালি জীবন দিয়ে নামবে গোল না খাওয়ার লড়াইয়ে – দুই বছর আগে হলেও ঘর-বাড়ি বাজি রেখে চোখ বন্ধ করে এ ভবিষ্যদ্বাণী করে দেওয়া যেত। এখন যে তা করা যাচ্ছে না, তাতেই বোঝা যায় কী রকম ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে ইতালির ফুটবল। এনরিকের চোখেও সেটা খুব স্পষ্ট। স্পেন যেমন বল পায়ে রাখতেই ভালোবাসে, ইতালিও এখন সে ভালোবাসায় বুঁদ। নিচে নেমে কাউন্টার অ্যাটাকের আশায় বসে না থেকে যুগের দাবিতে তারাও এখন খেলে হাই-প্রেসিং ফুটবল। নয় বছর আগে জাভি-ইনিয়েস্তা-সিলভাদের পায়ে অতিরিক্ত সময় দেওয়ার ভুলের পুনরাবৃত্তি নিশ্চয়ই করবে না ইতালিয়ানরা। অবশ্য সেটা যতটা না স্পেনের খেলাকে নষ্ট করতে, তার থেকে বেশি নিজেদের খেলাটা খেলতে।

সর্বশেষ ইউরোতে স্পেনকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল ইতালি, প্রথম গোলটা এসেছিল কিয়েলিনির পায়ে। ছবি: গেটি ইমেজেস

সেবার যেমন হয়েছিল জাভি ও পিরলোর শিল্পের অলিখিত লড়াই, এবার লড়াইটা বুসকেটস ও জর্জিনিওর। ইতালিয়ানদের খেলার গতি জর্জিনিও-নির্ভর। বেশিরভাগ সময়েই বল নিতে নেমে আসেন নিচে, নির্ধারণ করে দেন খেলার টেম্পো, যা আক্রমণে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতা দেয় ভেরাত্তি ও বারেল্লাকে। একদম নিখাদ ‘রেজিস্তা’ যাকে বলে। স্পেন দলে বুসকেটসের ভূমিকাটা সম্পূর্ণ মিলে না গেলেও তাঁর দলের খেলার মধ্যমণি হওয়ার ব্যাপারটা খুব মিলে যায়। বয়স ৩৩ হতে চললেও গ্রুপের তৃতীয় ম্যাচে ফিরে এসেই পর পর দুটি ম্যান অব দ্য ম্যাচ পারফরম্যান্স দিয়ে বুঝিয়েছেন তাঁর মূল্য। দমকা হাওয়ার মতো ১৮ বছরের পেদ্রির আবির্ভাব আর সাথে অভিজ্ঞ কোকে, সব মিলিয়ে এনরিকের দুশ্চিন্তার তালিকায় আর যা-ই আসুক, মিডফিল্ড আসবে না।

তাহলে চিন্তার কারণ কোথায়? এখানেও মিলে যায় দুই দল। ফরোয়ার্ড লাইন।

আসলে তো ফরোয়ার্ড লাইন নয়। ফরোয়ার্ড।

এখনও জ্বলে উঠতে পারেননি স্পেনের মোরাতা ও ইতালির ইমমোবিলের কেউই। এবারের ইউরোর ইমমোবিলে কতটা মলিন, পাঁচ ম্যাচে 'মাত্র দুই গোল' লিখেও তা বোঝানো দায়। স্পেনের দুই স্ট্রাইকার মোরাতা-মোরেনো দুইজনে মিলেই সেখানে করেছেন দুই গোল, সেটাও ৭.৪ এক্সজি (এক্সপেক্টেড গোলস) তৈরির পর। দর্শনীয় গোলের চেয়ে দর্শনীয় মিস-ই করেছেন বেশি।

কে জানে, আজ হয়তো ম্যাচের ব্যবধান হবে তাঁর পায়েই। ছবি: গেটি ইমেজেস

এ ম্যাচের সবচেয়ে বড় ‘মিস’ নিঃসন্দেহে লিওনার্দো স্পিনাজ্জোলা। জব ডেসক্রিপশন ডিফেন্ডার হলেও নিজ অর্ধে থাকা সময়ের প্রায় সমান সময় কাটিয়েছেন প্রতিপক্ষের অর্ধে (হয়তো তারও বেশি)। লেফট উইংয়ে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের, কখনো বা এমনকি মাঝে মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন মাঝমাঠেও। ডিফেন্সিভ দিকটা সামাল দেওয়ার মতো তির হয়তো মানচিনির তূণে আছে, তবে স্পিনাজ্জোলার শুন্যতায় আক্রমণে কিছুটা হলেও ধার অবশ্যই হারাবে ইতালি। ম্যাচ-ফিট হলে আক্রমণের লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে রাইট ব্যাক আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জিকে। লেফট উইংয়ে যে কাজ করতেন স্পিনাজ্জোলা, রাইট উইংয়ে তা করবেন ফ্লোরেঞ্জি।

লেফটব্যাকে স্পিনাজ্জোলার সরাসরি বিকল্প চেলসির এমারসন। তবে যদি পরিকল্পনা হয় ফ্লোরেঞ্জির উপরে উঠে রাইট উইং ওভারলোড করার, লেফটব্যাকে তুলনামূলক ডিফেন্সিভ রাফায়েল তোলোই বা আলেসান্দ্রো বাস্তোনিকে দেখলেও অবাক হওয়া যাবে না। আক্রমণের সময় যখন ওপরে উঠবেন ফ্লোরেঞ্জি, তারা নিচে এসে ব্যাক টু-কে বানিয়ে ফেলবেন ব্যাক থ্রি। স্পিনাজ্জোলায় এতটাই নির্ভর এই ইতালির খেলার ধরন যে, উল্টে দিতে হতে পারে গোটা সিস্টেমই। তবে প্রতিযোগিতার এত দূর আসা যে ফুটবল খেলে, নিশ্চয়ই সে ফুটবলের পরিবর্তন আনতে চাইবেন না মানচিনি।

স্পেনও তাই। নিজের পায়ে বল রাখতে চাওয়ার কারণ এখন আর শুধু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নয়, নিজেদের ডিফেন্ডারদের বাঁচাতেও। সবে ফ্রান্স ছেড়ে স্পেনে যোগ দেওয়া এমেরিক লাপোর্তের সাথে অনভিজ্ঞ এরিক গার্সিয়ার যুগলবন্দি এখনও জমে ওঠেনি ঠিক। এসেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেবেন, এমন প্লেয়ারও খুব কম আছে স্পেন বেঞ্চে। বিকল্প নিয়ে অবশ্য চিন্তার ভাঁজ নেই মানচিনির কপালে। এ দলে যে এক ম্যাচে দুই গোল করেও পরেরদিন বসে থাকতে হয় ম্যানুয়েল লোকাতেল্লিকে। হয়তো বেঞ্চ থেকে নামা কোনও ‘কিয়েসা’-ই করে দেবে দু’দলের মধ্যে পার্থক্য।

আবার পার্থক্য গড়ে দিতে পারে শত চিন্তার কারণ ফরোয়ার্ডরাই। ম্যাচ জেতাতে তো গোল করতে চাইবেনই, সাথে শত সমালোচনার মধ্যেও ম্যানেজারের অটল বিশ্বাসের প্রতিদান নিশ্চয়ই খুব করে দিতে চাইবেন মোরাতা-ইমমোবিলে। জ্বলে ওঠার জন্য এর থেকে ভালো দিন আর হয় না। দুটি ভালো ম্যাচের সুখস্মৃতির প্রলেপ ঢেকে দেবে এতদিনের সব গঞ্জনা-সমালোচনা।

মহাআরাধ্য ট্রফি যে মাত্র দুই ম্যাচ দূরে।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×