উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
স্কুল পালানো ইশান্ত!
ইফতেখার নিলয়
২ সেপ্টেম্বর ২০২১
বাইশ গজে ইশান্ত শর্মা এখন যে গল্পগুলো লিখছেন, তা বোধ হয় অজানা নয় কারও। কিন্তু, ইশান্ত যেভাবে উঠে এসেছেন, যাদের জ্বালাতন করে উঠে এসেছেন.... সেই গল্পগুলো কি জানেন? ইশান্তের জন্মদিনে সেই গল্পগুলোই জানাতে চাইছেন এক পাঠক।
'রঞ্জি ট্রফি চলাকালীন একদিন হুট করেই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আমার নাম চলে আসে। সেদিন সারাদিন বোলিং করে ম্যাচ শেষে খুব ক্লান্ত ছিলাম। তখন চিকু (ভিরাট কোহলি) ছিল আমার রুমমেট। আমি শুয়েছিলাম আর চিকু খুব জোরে আমাকে টানছিল এই বলে যে, "আরে উঠ! তোর ডাক পড়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভারত দলে তোর নাম চলে এসেছে"।'
আমি পাত্তা না দিয়ে শুয়েছিলাম। উল্টো বললাম, "বিরক্ত না করতে, সারাদিন বোলিং করে খুব ক্লান্ত।" চিকুও নাছোড়বান্দা। আমাকে টেনেই তুলল টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাতে। ক্লান্তি নিয়ে উঠে টিভি স্ক্রিনে ব্রেকিং নিউজে নিজের নাম দেখলাম। এরপরই সকল ক্লান্তি কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।'
ওই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আর যাওয়া হয়নি ইশান্তের। সব ব্যবস্থা করেও শেষ মুহূর্তে যাত্রা বাতিল করতে হয় তাঁকে। পরে অভিষেক হয়েছিল টেস্ট দিয়ে, এই বাংলাদেশেই। অভিষেকের দিন বাসে ইশান্তের সামনের সিটে শচীন টেন্ডুলকার, এর সামনে সৌরভ গাঙ্গুলী, এরও সামনে ভিভিএস লক্ষ্মণ। সামনে ক্রমান্বয়ে রাহুল দ্রাবিড় আর বীরেন্দর শেবাগদের মতো প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারদের বসতে দেখে খুব অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে তাঁকে। মনে মনে বারবার একটা কথাই উচ্চারণ করতে হয়েছে, 'এ কোথায় ফেঁসে গেলাম আমি?’
এরপরের গল্পটা আপনারা সবাই জানেন। সেগুলো বলতে গেলে অনেকে হয়তো বিরক্তই হবেন। তাই গৎবাঁধা গল্প নয়, ইশান্ত শর্মার দুয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা তুলে ধরব আপনাদের সামনে।
আবারও বলে রাখি, ইশান্ত বরাবরই ছিলেন ডানপিটে একজন। স্কুলে কিংবা ঘরে সবখানেই তাঁকে বকুনি খেতে হয়েছে খুব, বিশেষ করে চুল বড় রাখার জন্য। লেখাপড়ার দিকে খামখেয়ালি মনোভাবে স্কুলে দশম শ্রেণির পর আর ওই পথ আর মাড়াননি তিনি।
এমনকি শিক্ষকের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে সেখানে না যাওয়ার কাহিনিও আছে তাঁর জীবনে। পাড়ার আর আট-দশটা ছেলের যেমন থাকে। একদিন ইশান্তের মা শিক্ষকের বাসায় বেতন দিতে গেলে তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, ইশান্ত একদিনও তাঁর কাছে পড়তে আসেনি।
লেখাপড়ায় মনোযোগী না হওয়ায় প্রাইভেটের নামে বাসা থেকে বের হয়ে প্রতিদিনই বসে থাকতেন বন্ধুর বাসায়। ঘণ্টা দেড়েক বাদে ঘরে ফিরে স্কুলে লেখা খাতা দেখিয়ে প্রমাণ করতেন স্যারের পড়া। তবে অন্যান্য দিনের মতো সেদিন আর শেষ রক্ষা হয়নি। স্কুলের খাতা দেখিয়ে স্যারের খাতা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়নি। হাতেনাতে ধরা খাওয়ার পর রাগে ক্রিকেটের বদলে ইশান্তকে ফুটবল বানিয়ে খেলেছিলেন তাঁর মা।
ক্রিকেট মাঠে বোলিংয়ের সময় ইশান্তের লম্বা চুল নজর কাড়ে সবারই। এই চুল বড় রাখার আগ্রহের শুরু অল্প বয়স থেকেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক চুল কাটার জন্য চাপ দিয়ে বারবার পিটি থেকে ইশান্তকে বের করে দিলেও চুল কাটাতে পারেননি। প্রধান শিক্ষকের শাসনের পাল্লায় পড়ে একবার সবার সামনে অপমানিত হওয়াতে, লজ্জা ভেঙে যায় তাঁর। আবারও তাই চুল কাটা নিয়ে গড়িমসি দীর্ঘ হতে থাকে।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে লালচাঁদ রাজপুত ইশান্তদের কোচ ছিলেন। সেসময় কোচ হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই কড়া একজন। তাঁর অধীনেই নিউজিল্যান্ড সফরে যান ইশান্ত। জিঙ্ক লাগানো, সানগ্লাস ব্যবহার করা, গাড়িতে হেডফোনে গান না শোনা এবং চুল বড় রাখা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল সে দলের সবার। ইশান্তকে চুল কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রথম দিন সেলুনে গিয়ে বন্ধ থাকায় ফিরে আসতে হয়। দ্বিতীয় দিন ক্লান্তির কারণে যাওয়া হয়নি সেলুনে। তৃতীয় দিন অজুহাত দাঁড় করান আবারও। এরপর জরিমানা গুনতে হয়।
এরপর থেকে বারবার জরিমানাই গুনে গিয়েছেন কেবল। ইশান্ত নিজেই বলে দেন, 'জরিমানাই নিয়ে নেন, আমার পক্ষে দেশের বাইরে এসে এসব চুল কাটা সম্ভব না।' মা, স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর ক্রিকেট কোচ কেউই তাঁকে চুল কাটতে বাধ্য করতে পারেননি কোনোভাবেই।
এই বড় চুলের সাথে তাঁর বসবাসের শুরুটা কবে থেকে তা এখন সম্ভবত পরিষ্কার পাঠকের কাছে। মাথায় বড় চুলের ভার সহ্য করার পাশাপাশি বয়েছেন ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের স্বপ্নের ভারও। বারবার অফ ফর্মের গ্যাঁড়াকলে পড়েও বারংবার ফিরে এসেছেন। লিখেছেন নয়া আবির্ভাবের এক গল্প। সময়ের পরিক্রমায় হয়েছেন ভারতের টেস্ট ক্রিকেটের পেস বোলিংয়ের অনন্য একজন।
ইশান্তের জন্য এই গল্প গৌরবের। যতটুকু ইশান্তের জন্য, ততটুকুই তাঁর ফেলে আসা দিনের প্রধান শিক্ষক, কোচদের জন্যেও। বাইশ গজে ইশান্তের সর্বশেষ ৪/৫ বছরের সফলতার গল্প নিশ্চয়ই তাঁদেরও বেশ আনন্দিত করে। তাঁরাও তো ইশান্তের সফলতার গল্প তৈরি হওয়ার পেছনের একেকজন নায়ক।