উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
জুভেন্টাসের রোনালদোকে কি সফল বলা যাবে?
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
২৯ আগস্ট ২০২১
রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে সব কিছু জয় করার পর জুভেন্টাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিজেকে নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করাতে। সেই জুভেন্টাস পর্ব শেষ করে নাটকীয়ভাবে ফিরে এসেছেন পুরোনো ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। জুভেন্টাস-চ্যালেঞ্জ কি সফল হয়েছে? জুভেন্টাসের রোনালদোকে কিভাবে মনে রাখবে ফুটবল? সংখ্যা-উপাত্ত-অর্জনের আয়নায় খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর।
ময়েস কিন তো তাহলে রোনালদো হয়েই গেলেন!
খুবই স্থুল রসিকতা হয়ে গেল? নাকি দলবদলের বাজারে নিয়মিত পা ফেলা আপনি বাক্যটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথেই নিচ্ছেন? দুই বছরের চুক্তিতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জুভেন্টাস ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, 'তুরিনের বুড়ি'দের তাই তাঁর ফাঁকা হয়ে জায়গাটা পূরণ করতেই হতো। সেই চেষ্টাটা তাঁরা করতে চাইছে ময়েস কিনকে দিয়ে। সব ঠিক থাকলে দুই বছরের জন্যে তাঁকে দলে ভেড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা খুব শিগগিরই দিয়ে দেবে তুরিনের দলটি, গত রাতে তুরিনে নাকি তাঁর মেডিকেলও হয়ে গেছে। ময়েস কিন কিভাবে রোনালদো হয়ে উঠলেন, সেই গল্পটা নিশ্চয়ই আপনিও জানতেন।
কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, সিআরসেভেনের উত্তরসূরি হিসেবে ঠিক মানুষটাকেই কি বেছে নিয়েছে জুভেন্টাস? এমনিতে ক্যারিয়ারে যাঁর অর্জন পাঁচ ব্যালন ডি'অর আর পাঁচ চ্যাম্পিয়নস লিগ, দশবার জিতেছেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট...তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত হওয়াটাও এক ২১ বয়সী ছোকরার পক্ষে বিষম চাপই। কিন্তু সময়সীমাটা যদি বেঁধে দেওয়া হয় কেবলই শেষ তিন বছরের গণ্ডিতে, সহজ করে বললে জুভেন্টাসের জার্সির রোনালদোতে; কিন কি পারবেন রোনালদো হতে?
প্রশ্নটার উত্তর 'হ্যাঁ' নাকি 'না' হবে, সেটা সময়ই জানাবে। তবে জুভেন্টাসের রোনালদোর সংখ্যাগুলোতে চোখ রেখে একটা উত্তর তো অনুমান করা যেতেই পারে। হয়তো বা এই প্রশ্নের উত্তরেই মিলতে পারে, সাদা-কালো জার্সিতে রোনালদোকে সফল বলা যাবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাবও।
তা কেমন ছিলেন জুভেন্টাসের রোনালদো? রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ক্লাব রেকর্ড ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে গিয়েছিলেন তৃরিনে। গিয়েই বাজিমাত! সিরি 'আ'তে ৩১ ম্যাচ খেলে গোল ২১টি, চ্যাম্পিয়নস লিগে নয় ম্যাচে ৬ গোল। সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৩ ম্যাচ খেলে ৪৩ ম্যাচে পেয়েছিলেন ২৮ গোল, সঙ্গে ১১ অ্যাসিস্ট। ওই মৌসুমে জুভেন্টাস জিতেছিল লিগ আর ইতালিয়ান সুপার কাপের শিরোপা।
পরের মৌসুমে জুভেন্টাসকে রোনালদো সিরি 'আ'-র শিরোপা এনে দিয়েছিলেন ৩৩ ম্যাচে ৩১ গোল করে। সঙ্গে ছিল ৬ অ্যাসিস্টও। ওই মৌসুমে জুভেন্টাসের হয়ে ৩৭ গোল করে নাম লিখিয়েছিলেন ইতিহাসেও, ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে ৩৬ গোল করে জুভেন্টাসের হয়ে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলের যে রেকর্ডটা এর আগে ছিল ফেলিস প্লাসিদোর নামে।
সিরি 'আ'তে নিজের প্রথম মৌসুমে কোনো হ্যাটট্রিকের দেখা না পেলেও দ্বিতীয় মৌসুমে সেটিও পেয়েছিলেন ক্যালসিওর বিপক্ষে। জুভেন্টাসের ৪-০ গোলে জয় পাওয়ার ওই ম্যাচটা পুরোপুরিই রোনালদোময়। যে একটা গোলটা করেছিলেন গঞ্জালো হিগুয়েইন, সেখানে ফাইনাল পাসটা বাড়িয়েছিলেন রোনালদোই।
জুভেন্টাস লিগ শিরোপা জিতেছিল ওই ২০১৯-২০ মৌসুমেও। কিন্তু সিরি 'আ'র শিরোপা তো রোনালদোকে দলে টানার আগের সাত মৌসুমেও জিতেছিল জুভরা। এত বিশাল অঙ্ক খরচায় রোনালদোকে দলে ভেড়ানোর পেছনে আসল উদ্দেশ্য তো ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্যের লম্বা খরা ঘোচানো, ১৯৯৬ সালের পর থেকে যে শিরোপার দেখা মেলেনি। রিয়ালকে টানা তিন মৌসুম চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়ে আসা রোনালদোও একবার বলেছিলেন, 'জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার অসম্ভব কাজটাকেই সম্ভব করব আমি।'
কিন্তু কথা রাখতে পারেননি রোনালদো। প্রথম মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলর ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলকে উদ্ধার করেছিলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে, কিন্তু জুভেন্টাস বাদ পড়ে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালেই। পরের দুই মৌসুমে জুভেন্টাসের যাত্রা শেষ হয়েছিল রাউন্ড অব সিক্সটিনেই! ২০১৯-২০ মৌসুমে অলিম্পিক লিওঁর বিপক্ষে ম্যাচে জোড়া গোল করে তা-ও চেষ্টা করেছিলেন দলকে উদ্ধারের, কিন্তু নিজের শেষ মৌসুমে পারেননি সেটাও। পোর্তোর বিপক্ষে দুই লেগ মিলিয়ে জুভেন্টাস হেরে গিয়েছিল ৩-২ ব্যবধানে।
চ্যাম্পিয়নস লিগে সব মিলিয়ে জুভেন্টাসের জার্সিতে রোনালদো খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ২০ ম্যাচ, সেখানে পেয়েছেন ১৪ গোল। সংখ্যাটা চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার জন্যে বেশ মলিনই। সম্পূরক তথ্য হিসেবে জানিয়ে রাখাও বোধ হয় ভালো, একই সময়ে ২৪ ম্যাচ খেলে লিওনেল মেসি গোল পেয়েছেন ২০টি।
রোনালদোর শেষ মৌসুমে জুভেন্টাস হারিয়েছে লিগ শিরোপাও। তাঁর ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান যদিও যথেষ্টই দারুণ, ৩৩ ম্যাচে করেছেন ২৯ গোল, প্রথমবারের মতো জিতেছেন পাওলো রসি অ্যাওয়ার্ড (সিরি 'আ'তে সর্বোচ্চ গোলদাতা পান এই পুরস্কারই)। কিন্তু এই মৌসুম শেষেই তো 'রোনালদো ফুরিয়ে গেছেন কি না' প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে বেশ বড় আকারে।
কারণও আছে। লিগের প্রথম ৩৭ ম্যাচে ৭৫ পয়েন্ট পাওয়া জুভেন্টাসকে জিততেই হতো পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিতে। এবং জুভেন্টাসের ওই বাঁচা-মরার ম্যাচে আন্দ্রে পিরলো একাদশ সাজিয়েছিলেন তাঁকে স্কোয়াডের বাইরে রেখেই!
এমনিতেই দল খারাপ খেলছে, সুযোগ মিলছে না একাদশেও-- এসব কারণে পিরলোর থেকে রোনালদোর মন উঠে গিয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছে অনেক সংবাদমাধ্যমেই। এর আগে মরিসিও সারির আমলেও গুঞ্জন রটেছিল, 'জুভেন্টাসে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সময়টা ভালো যাচ্ছে না'। রোনালদো খুব সম্ভবত আস্থা রাখতে পারেননি মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রির কোচিংয়েও। যে কারণে ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ার পরও, থামলেন জুভেন্টাসের জার্সিতে ১৩৪ ম্যাচে ১০১ গোল নিয়েই।
জুভেন্টাসকে তাই রোনালদোর বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে হলো ময়েস কিনকে। আর জুভেন্টাসের জার্সিতে কিছুটা ক্ষয়িষ্ণু পারফরম্যান্সের কারণে রোনালদোকে ৩৬ পেরোনোর পর ইংল্যান্ডে এসে প্রমাণ করতে হচ্ছে, ফুটবলকে তাঁর এখনো অনেক কিছুই দেওয়ার আছে।
আরও অনেক চ্যালেঞ্জের মতো রোনালদো কি এই চ্যালেঞ্জটাও জিতবেন? প্রশ্নটার উত্তরে কেন যেন 'হ্যাঁ' শুনতেই মন চাইছে!