উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

বারামুন্দিসের শেকড়ের খোঁজে....

ইফতেখার নিলয়

২২ আগস্ট ২০২১

বারামুন্দিসের শেকড়ের খোঁজে....

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে পাপুয়া নিউ গিনিরও, প্রথমবারের মতো কোনো আইসিসি ইভেন্টের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে যারা। তবে পাপুয়া নিউ গিনির ক্রিকেট ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের সে ইতিহাসটাই জানাচ্ছেন এক পাঠক।

আঠারো শতকের একেবারে শেষ সময়ের কথা। তখন সবেমাত্র ক্রিকেটের প্রবেশ শুরু পাপুয়া নিউগিনির ভূখণ্ডে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে, সময়টা ১৮৯০। তখনও অবশ্য পিএনজি কোনো স্বাধীন ভূখণ্ড নয়। অস্ট্রেলিয়ার অধীনে তাদের ভূখণ্ডের অবস্থান। এর ঠিক ১৭ বছর আগে ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারী ক্যাপ্টেন জন মোরেসবি ১৮৭৩ সালে পা রাখেন পাপুয়া নিউ গিনিদ রাজধানী পোর্ট মোর্টয়িতে। বলে রাখা ভালো– ক্যাপ্টেন জন মোরেসবির নামেই পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় দেশটির রাজধানীর। ঘটনার পরবর্তী বর্ণনার সুবিধার্থে এটাও বলে রাখি– পাপুয়া নিউ গিনি ক্রিকেট পরিচিত 'বারামুন্দিস' নামেও।

মোরেসবির আগমনের পরপরই খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারকরাও সেখানে ভিড় করতে শুরু করে। এই খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারকরা পাপুয়া নিউ গিনিতে আসতে শুরুর পরই ধীরে ধীরে দেশটিতে ক্রিকেটের প্রসার ঘটতে শুরু করে। রাজধানী পোর্ট মোরেসবি ছাড়িয়ে মুহূর্তেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ঢেউ দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে।

যদিও এর অনেক পরে, ১৯৭৩ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর তালিকাভুক্ত হয় পূর্ব-এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশটি। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে একবার ৫৭২ রানও সংগ্রহ করেছিল তারা। ১৪ বছর আগে ২০০৭ সালে নিউ ক্যালডোনিয়ার বিপক্ষে তারা এই কীর্তি গড়ে। আর ২০১৮ সালের এপ্রিলে আইসিসি এর সব সহযোগী সদস্যকে টি-টোয়েন্টি স্ট্যাটাস দেওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলে ২০১৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে পিএনজির খেলা সব টি-টোয়েন্টিই আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে।

ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, শুরুর দিকে পিএনজিতে ক্রিকেট খেলাটা বেশি প্রচলিত ছিল উপজাতিদের মধ্যেই। মাঠের ফলানো ফসল ঘরে তোলার পর ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে তা উদযাপন করা হতো। এছাড়াও পাপুয়া নিউগিনিতে উপজাতিদের সংঘাত নিরসনেও ক্রিকেট রেখেছে মুখ্য ভূমিকা।

ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ছুঁয়ে যায় পিএনজির রাজধানী পোর্ট মোরেসবি শহরের হানুয়াবাদা গ্রামেও। কালের পরিক্রমায় পিএনজি ক্রিকেটের তীর্থস্থানে রূপ নেয়'হানুয়াবাদা। বারামুন্দিস জাতীয় দলের সিংহভাগ ক্রিকেটার হানুয়াবাদা গ্রাম থেকেই উঠে আসে। তাদের 'হোম অব ক্রিকেট' আমিনি পার্কের অবস্থানও হানুয়াবাদায়।

প্রশ্ন করতে পারেন, মাঠের নাম আমিনি পার্ক রাখা হলো কেন? পিএনজির ক্রিকেটে আমিনি পরিবারের অবদানকে সম্মান জানাতেই তারা নিজেদের হোমগ্রাউন্ডের নামকরণ করেছে 'আমিনি পার্ক'। ব্রায়ান আমিনি পিএনজি ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক। উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে নৌকায় চড়ে দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে বিভিন্ন শহরের দলকে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর নেতৃত্বে ম্যাচ খেলার রেওয়াজ ছিল দলটার। ব্রায়ানের নাতি চার্লস আমিনিও অধিনায়কত্ব করেছেন পিএনজি ক্রিকেটের। অধিনায়কত্ব ছাড়াও আমিনি পরিবারে ক্রিকেট সদস্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের জিনেই যেম ক্রিকেটে বাস। মজার বিষয় হলো– আমিনি পরিবারের সকলেই পিএনজি ক্রিকেটের তীর্থস্থান হানুয়াবাদা গ্রামেরই বাসিন্দা।

দিনের আলোয় হানুয়াবাদার মূল সড়ক দখলে থাকে শিশু-কিশোরদের। সারাদিনই এখানে ক্রিকেট খেলা চলে। ক্রিকেট এখানে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গ্রামে ক্রিকেটকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে... রাস্তায় খেলা চলাকালীন কোনো গাড়ি তাদের অতিক্রম করতে এলে প্রথমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তারপরই সুযোগ মেলে সেই রাস্তা অতিক্রমের। পিএনজির ক্রিকেট বিস্তারে হানুয়াবাদার অবদান আশা করি এখন স্পষ্ট পাঠকদের কাছে।

আমিনি পার্ক। ছবি: লুপ পিএনজি

যেহেতু, হানুয়াবাদা থেকেই বেশিরভাগ জাতীয় দলের ক্রিকেটার উঠে আসে, তাই সেই গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে গেলেই দেখা মেলে তাঁদের। স্থানীয় শিশু-কিশোররাও তাদের ঘিরে ধরে, কথা বলতে চায়, পরামর্শ চায়। জাতীয় দলের কেউই তাতে কার্পণ্য করে না, নির্দ্বিধায় মিশে যায় ওই শিশু-কিশোরদের সঙ্গে, কখনো বা তাদের সাথেই নেমে পড়েন ক্রিকেট খেলতে। নিজেদের কিশোরবেলায় ক্রিকেটকে ঘিরে দেখা স্বপ্নের পুরোনো প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠে তখন তাদের মাঝে।

১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ৭০ বছর পর স্বাধীনতা লাভ করে পাপুয়া নিউ গিনি। সে বছরই হানুয়াবাদার আমিনি পার্ক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পিএনজির মধ্যকার ঐতিহাসিক প্রীতি ম্যাচের ভেন্যু হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ঘটে দেশটির। বিশ্বকাপজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল আমিনি পার্কে ৩৫ ওভারের ম্যাচে মোকাবেলা করে বারামুন্দিসদের। কোনো মতে ১১৫ রান দাঁড় করাতে সক্ষম হয় স্বাগতিকরা। বিশ্বজয়ী সফরকারীদের কাছে এই লক্ষ্য ছিল মামুলি ব্যাপার।

আমিনি পার্কের চতুর্দিকে সেদিন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বিশ্বকাপজয়ী দলের বিপক্ষে নিজ দলের খেলা দেখতে হানুয়াবাদার বাসিন্দাদের উচ্ছ্বাস ছিলো আকাশচুম্বী। চার উইকেটে ক্যারিবিয়ানরা ম্যাচ জিতে নেওয়ার পরও তাঁরা পুরো ৩৫ ওভারই ব্যাটিং করে স্থানীয় দর্শকদের মাঠে আসা সার্থক করতে। সব ওভার খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা ৪ উইকেট হারিয়ে সংগ্রহ করে ২০১ রান। ক্লাইভ লয়েডের ৮৮ রানের বিনোদনদায়ী ইনিংস স্থানীয় সমর্থকদের মনের খোরাক মিটিয়েছিল। এরপর দিনপঞ্জিকার অসংখ্য পাতা বদলেছে। দশবার পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ও আইসিসি ট্রফিতে অংশ নিয়েও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভে বারবার ব্যর্থ হয়েছে তারা।

তবে বারামুন্দিসরা লড়াই করে যাচ্ছে এখনো। পূর্ব-এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে দুর্দান্তভাবে পারফর্ম করে গেছে স্বপ্নকে সত্যি করতে। এর আগে চারবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে অংশ নিলেও সম্ভব হয়নি বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত করা। ২০২০ সালে এসে কাঙ্ক্ষিত সেই লক্ষ্যের দেখা পেয়েছে তারা। দুবাইয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে তারা সমর্থ হয়েছে বাধা টপকাতে।

২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে প্রবেশের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছিল হানুয়াবাদার ঘরে ঘরে। কিন্তু সেখানেও বিধি বাম। মহামারী করোনার কারণে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সেই বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেছে দুই বছর।

তবে পাপুয়া নিউ গিনির ক্রিকেটারদের অপেক্ষা এক বছরেই ফুরোচ্ছে। করোনা ভাইরাসের দাপট এখনো যদিও আছে, তবে সব ঠিক থাকলে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঠিকই গড়াবে ওমান ও আরব-আমিরাতে। ২১ অক্টোবর বিকাল চারটায় বাংলাদেশের বিপক্ষেও খেলবে দেশটি। বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে তাঁরা মুখিয়ে আছেন, সেটাও কয়েকদিন আগে জানিয়েছেন দলটির ক্যাপ্টেন।

এখন দেখার অপেক্ষা, প্রথমবারের মতো বিশ্ব আসরে অংশ নিয়েই দাগ কেটে যেতে পারে কি না বারামুন্দিসরা।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×