টোকিও অলিম্পিক ২০২০
আর্চারিতে কোরিয়ার মতো সাফল্য চাইলে...
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
রিজওয়ান রেহমান সাদিদ
৩০ জুলাই ২০২১
অলিম্পিক আর্চারিতে পদকের নিষ্পত্তি হয়েছে চারটি, চারটি স্বর্ণই গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ঘরে। আর্চারিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশও, দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য-সূত্র জানার ইচ্ছা তো হতেই পারে! ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশ্য গুপ্তধনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিভা, পরিকল্পনা, প্রয়োগক্ষমতা...শব্দগুলো নিশ্চয়ই আপনি আজই প্রথম শুনছেন না।
আশা ছিল, তবে শেষতক তা দুরাশাতেই পরিণত। প্রাণান্ত লড়াই করে দিয়া সিদ্দিকী বিদায় নিয়েছেন নারী রিকার্ভ এককের শেষ চৌষট্টি থেকেই; রোমান সানা এগিয়েছিলেন আরেক ধাপ সামনে, তবে সেই যাত্রাও থেমে গিয়েছে অলিম্পিকে বাংলাদেশকে প্রথম এবং একমাত্র জয় এনে দেওয়ার গর্বেই।
এর আগে মিশ্র দ্বৈতেও দুজন বিদায় নিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম জি ডিওক আর আন সান জুটির কাছে হেরে। আর্চারির হালচাল সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ খোঁজ রাখলে অবশ্য এই ফলাফলে অবাক হওয়ার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত মিশ্র দ্বৈতের স্বর্ণ জিতেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ওই জুটিই, দক্ষিণ কোরিয়ার দখলে গিয়েছে এখন অব্দি টোকিও অলিম্পিক আর্চারিতে নিষ্পত্তি হওয়া বাকি তিন ইভেন্টের স্বর্ণও। টোকিও অলিম্পিকের আগ পর্যন্ত অলিম্পিক আর্চারিতে যারা জিতেছে ৩৯টি পদক, এর মধ্যে ২৩টিই স্বর্ণ-- তাদের জন্য এই ফলাফলই অবশ্য স্বাভাবিক।
কৌতূহল তাই হতেই পারে, কোন জাদুমন্ত্রবলে অলিম্পিক আর্চারির পদককে এমন 'বাপ-দাদার সম্পত্তি' বানিয়ে ফেলেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার আর্চাররা? একটু ঘেঁটেঘুটে যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে জাদুটোনা দূরে থাক, এমন জাদুকরি পারফরম্যান্সের পেছনের কারণ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে একদমই সহজ কিছু সূত্র। প্রতিভা, পরিকল্পনা, প্রয়োগ--শব্দগুলো নিশ্চয়ই আপনি আজই প্রথম শুনছেন না।
'মেধার ভিত্তিতে নির্বাচন' শব্দটা খেলাধুলার সঙ্গে সমার্থক নয় সব সময়। 'স্বজনপ্রীতি', 'ব্যক্তিগত পছন্দ' শব্দগুলো তো কান পাতলেই শোনা যায় ক্রীড়াঙ্গনে। তবে কোরিয়া আর্চারি অ্যাসোসিয়েশনে (কেএএ) এমন কিছু শোনা যাবে না আড়ি পেতেও। বয়স ২০ পেরোতে না পেরোতেই দক্ষিণ কোরিয়াকে তিন স্বর্ণ এনে দেওয়া আর্চার আন সান যেমন বলছেন, 'আমার মনে হয়, আমাদের দল নির্বাচনটা বেশ স্বচ্ছ।'
কতটা স্বচ্ছ, তার একটা ধারণাও পাওয়া যেতে পারে টোকিও অলিম্পিকের দল নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে। ২০২০ সালের মার্চে অলিম্পিক যখন স্থগিত করে দেওয়া হয় এক বছরের জন্য, দক্ষিণ কোরিয়ায় তখন কয়েক স্তরে অলিম্পিক দল বাছাই কার্যক্রম চলছিল। চাইলে ওই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিতদেরই এক বছর পরের অলিম্পিকে পাঠাতে পারতেন কর্তারা। কিন্তু তা না করে ২০২১ সালে অলিম্পিক বাছাই ডাকা হলো ফের। কারণ আর কিছুই না, পারফর্মিং আর্টের দুনিয়ায় ২০২০ সালের সেরা ব্যক্তি যে এক বছর পরেও সেরাই থাকবেন, এমন তো কোনো কথা নেই।
আর দক্ষিণ কোরিয়ায় তো থাকার চেয়ে না থাকার সম্ভাবনার পাল্লাই ভারি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আর্চারিতে প্রতিশ্রুতিশীলদের খুঁজে বের করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই, পরে তাঁদের দৈনিক দুই ঘণ্টা করে দেওয়া হয় আর্চারির পাঠ। হাই স্কুল কিংবা কলেজ পর্যায়ে গেলে প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা দেখানো আর্চারদের আনা হয় দেশসেরা কোচদের অধীনে। তাঁদের লক্ষ্য থাকে, দেশে পেশাদার আর্চারের সংখ্যা বাড়ানো এবং এই ধারায় জাতীয় দলে আর্চার জোগান দেওয়া।
ধারাটা সব সময়ই সঞ্চরণশীল বলে জাতীয় দলে জায়গা নিশ্চিত নয় কারোরই। পারফরম্যান্সের খানিক বিচ্যুতিই যে কাউকে জাতীয় দলের বাইরে ছিটকে ফেলতে পারে আজীবনের জন্য৷ তাই, নিজেকে শীর্ষ পর্যায়ে টিকিয়ে রাখতে কঠোর অনুশীলন করতে হয় নিজের তাগিদেই। ওয়ার্ল্ড আর্চারির প্রতিনিধি জন স্ট্যানলি জানাচ্ছেন, দিনে দশ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ২৫০০ তির ছোড়া দক্ষিণ কোরিয়ান আর্চারদের জন্য খুবই স্বাভাবিক।
এমন অনুশীলন করা এক দল আর্চার যখন নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতায় শামিল হন, লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি না হয়ে উপায় নেই। এবারের অলিম্পিকে দলগত আর্চারিতে দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়া কাং চে-ইয়াং তাই বলছেন, 'অলিম্পিকের বাছাইয়েই আমরা এমন এমন সব আর্চারের সঙ্গে লড়াই করে আসি, প্রতিভার দিক থেকে যাদের ফারাক ঊনিশ-বিশের বেশি নয়।'
তবে আর্চারিতে তো প্রতিভাই শেষ কথা নয়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তির রাখার জন্য প্রবল মানসিক শক্তিও থাকা চাই। আর দক্ষিণ কোরিয়ান আর্চারদের স্নায়ুর পরীক্ষাটাও হয়ে যায় অন্তঃদেশীয় বাছাই প্রতিযোগিতাতেই। অলিম্পিকে এসে তাঁদের মধ্যে তাই আর নার্ভাসনেসের চোরাস্রোত বয়ে যায় না, ঘটে না 'অ্যাড্রেনালিন রাশ'। কাং-ই যেমন বলছেন, 'অলিম্পিকে এসে আর্চাররা নার্ভাস হয়ে পড়তেই পারে। কিন্তু বাছাইয়েই আমাদের কীসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তা একবার ভাবলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায়।'
প্রতিভা আর মানসিক জোর অর্জনের কাজটা যেহেতু আর্চাররা নিজেরাই করছেন, কোরিয়া আর্চারি অ্যাসোসিয়েশনের তাই কাজ তাই যথাযথ সমর্থন জোগানো, আর্চারদের অনুশীলন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। এবারই যেমন, দক্ষিণ কোরিয়ার জিনচিওনে টোকিও অলিম্পিকের আর্চারি ভেন্যুর অবিকলে একটা মাঠ বানিয়ে আর্চারদের অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছিল কেএএ। শুধু তাই নয়, অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিমের আরেক দ্বীপেও, টোকিওর বাতাসের সঙ্গেও আর্চারদের খাপ খাওয়াতে হবে তো!
একঝাঁক প্রতিভাবান আর্চার অনুশীলন করছেন ইউমেনোশিনা পার্ক আর্চারি ফিল্ডের রেপ্লিকা মাঠে, তাঁদের দেওয়া হয়েছে বাতাসের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণাও...অলিম্পিক আর্চারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজত্ব করার রহস্যটা বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন তো বটেই, এখন আপনিও জানেন।