তাসকিন-মোস্তাফিজ-শরীফুল: বাংলার ক্রিকেটের নতুন পেসত্রয়ী?
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
রাইসান কবির
১৪ জুলাই ২০২১
একটা সময় বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনারের খনি হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের বাঁহাতি স্পিনার খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তুলনায় পেস বোলারদের পাইপলাইনটাই যেন শক্তিশালী, উঠে আসছেন শরীফুল, হাসান মাহমুদ, শহিদুলের মতো পেসাররা। কিছুটা বিচ্যুত হয়ে যাওয়া তাসকিনও ফিরেছেন কক্ষপথে। এক পাঠক মনে করছেন, তাসকিন-মোস্তাফি-শরীফুল, এই পেসত্রয়ীতেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সাফল্য-সূত্র।
এখন থেকে প্রায় ১০-১২ বছর আগে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল স্পিন-নির্ভর, টিমের স্পিনশক্তি প্রখর। কিন্তু এখন আর কথাটা শোনা যায় না। সেটার যৌক্তিক কারণও আছে বটে। ১০-১২ বছর আগের স্পিন-নির্ভর আর স্পিনে শক্তিশালী দলটাতে এখন আর খুব বেশি বিশ্বমানের স্পিনার নেই। বলতে গেলে আছেন কেবল সাকিব আল হাসান। আর বাদবাকি যাঁরা আছেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোটামুটি সফল হলেও প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়ায় বলে-কয়ে কাঁপন ধরানোর মতো নন। স্পিন-নির্ভর দলটাতে এখন তরুণ, সম্ভাবনাময় পেসারদের ছড়াছড়ি। বাংলার ক্রিকেটে পেস বোলিংয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার স্বপ্নটাও তাই দেখতে শুরু করেছেন অনেকেই, এই তরুণদের হাত ধরেই।
বিশেষ করে 'তাসকিন-মুস্তাফিজ-শরীফুল' পেসত্রয়ীর কথা বলতে হচ্ছে আলাদা করে। স্পিডস্টার তাসকিন আহমেদ বাংলার ক্রিকেটে এসেছিলেন বেশ সাড়া তুলেই। দারুণ গতিতে বল করতে পারা তাসকিনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, মানসিকতা-- সব কিছুই ছিল আশাজাগানিয়া। তাসকিনের সবচাইতে বড় নজরকাড়া দিক ছিল, তাসকিন টাইপের কোনো পেসার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেই কোনোদিন আসে নি। নিয়মিত ১৪০ কি.মির ওপর বল করে যাওয়া বোলার দেশের ক্রিকেটে কে দেখেছে কবে? তাসকিন আরও জোরে বল করতে চান, গতি তুলতে চান ১৫০-এ, এটা অনেক সাক্ষাৎকারেই বলেছেন তিনি। এ ধরনের চিন্তাধারা আর মানসিকতার পেসার একটা দলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বে, যেখানে প্রায় সব দলেই এ রকম জোরে বল করতে পারা পেসার কমপক্ষে একজন হলেও আছেন।
শুরুর দিককার দুরন্ত তাসকিন তাঁর দারুণ ছন্দটা ধরে রাখতে পারেন নি, বাদ পড়েছিলেন দল থেকে। পরে ২০২০ সালের লকডাউনে কঠোর পরিশ্রম করে, ফিটনেসের উন্নতি করে, ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্সকে আগের চাইতেও ভালো পর্যায়ে নিয়ে তারপরেই ফিরেছেন ন্যাশনাল টিমে। কামব্যাক করার পরে পারফরম্যান্সেও আগের চাইতে বেশি ধারালো তাসকিনকে দেখা গেছে মাঠে। দারুণ লাইন-লেন্থ মেইনটেইন করে একেবারে স্পট অন বোলিং করে যাচ্ছেন টানা। আগের তাসকিন বলের লাইন আর লেংথে খুব একটা অ্যাকুরেট ছিলেন না, আর পেস বেশি থাকায় স্বাভাবিকভাবেই রান খরচ করতেন প্রচুর। কিন্তু এই তাসকিন যেন ভিন্ন তাসকিন। দারুণ পেসের সাথে অ্যাকুরেট লাইন-লেংথ, ভয়ংকর একজন তাসকিনকেই দেখা যাচ্ছে মাঠে। টেস্ট, ওয়ানডে সবখানেই বজায় রাখছেন পারফরম্যান্সের ধারা।
আলাদা করে একটা ম্যাচের কথা বলতেই হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচে শুরুর স্পেলে পারফেক্ট লাইন, লেংথ, বাউন্স আর পেস-- সবকিছু মিলিয়ে প্রায় নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন কিউই ব্যাটারদের। অবশ্য দুর্ভাগা তাসকিনের বোলিং পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাবে না সেটা, তাসকিনেরই বলে যে ক্যাচ পড়েছে টপাটপ। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্যাচ মিসের মাশুলও সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে তাসকিনকেই। তাসকিনের বলে ওঠা ক্যাচই ড্রপ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সব কিছুর পরেও তাসকিন যে আগের চেয়ে আরও ধারালো হয়ে ফিরে এসেছেন আর মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন সেটা নিঃসন্দেহে আশা জাগাচ্ছে ভক্তদের মাঝে। একজন দারুণ ক্রিকেটারের আভাসই পাওয়া যাচ্ছে তাসকিন আহমেদের মধ্যে। আশা করা যাচ্ছে, তাসকিন এ রকম তাসকিন হয়েই থাকবেন সামনের দিনগুলোতে। আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বে লড়াই করতে হলে যে একজন তাসকিন আহমেদকে বড্ড দরকার বাংলাদেশের ক্রিকেটে।
এবার আসা যাক কাটার মাস্টার মোস্তাফিজের কথায়। অভিষেকেই পেয়ে যাওয়া খ্যাতি আর পারফরম্যান্সের সুউচ্চ গ্রাফটা তিনি বজায় রাখতে পারেননি ক্যারিয়ারের পরের ভাগটাতে। তারপরেও খুব যে খারাপ করছেন, এমনটা বলা যাবে না। অন্তত এশিয়ার কন্ডিশনে মোস্তাফিজ বরাবরই আতঙ্কের নাম প্রতিপক্ষের জন্য। সাদা পোশাকে নিয়মিত নন, খুব একটা কার্যকরও হতে পারেননি। তবে রঙিন পোশাকে সাদা বলের ক্রিকেটে ভরসার নাম হয়ে ছিলেন সব সময়ই। কাটার-স্লোয়ারের বিষে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে হরহামেশাই উইকেট তুলছেন। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স কিছুটা মলিন হলেও তাসকিন আর মোস্তাফিজের কেমিস্ট্রিটা বেশ ভালোই জমার কথা। তাসকিনের গতির সাথে মোস্তাফিজের স্লোয়ার-কাটার-- প্রতিপক্ষ তো বিভ্রান্ত হবেই, নাকি? পেস বোলিং অ্যাটাক তাই অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় আর কার্যকরী হওয়ার কথা। এবার মাঠে সবাই নিজেদের সেরা পারফরম্যান্সটা ঢেলে দিতে পারলেই হয়।
পেসত্রয়ীর নবীনতম সদস্য শরীফুলের কথায় আসা যাক। অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য শরীফুল ইসলামের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রাটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে। ম্যাচ খেলেছেন মোটে ছয়টা, উইকেট পাঁচটা; তিন ফরম্যাট মিলিয়ে। তবে দারুণ প্রতিভাবান আর অমিত সম্ভাবনার এই পেসারেই আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। একজন পেসার হিসেবে আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার মানসিকতা সবকিছুই আছে শরিফুলের মাঝে। অ-১৯ বিশ্বকাপেও শরিফুলের এই আক্রমণাত্মক চিন্তাধারার প্রকাশ পেয়েছে। এই আক্রমণাত্মক গতিবিধি যেন বোলিংয়েও প্রকাশ পায় সেটাই হয়তো দেখার অপেক্ষায় আছেন ভক্তরা।
গতির ঝড় তোলা ডানহাতি তাসকিন আর বাঁহাতি মোস্তাফিজের স্লোয়ার-কাটার এর বিষের সাথে আক্রমণাত্মক শরিফুলের বাহাতি পেস-- বেশ বৈচিত্র্যময় আর কার্যকরী একটা পেস বোলিং ত্রয়ীর খোঁজ পেয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তাঁদের উপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎে ভালো কিছুর সম্ভাবনাও পাওয়া যাচ্ছে, অন্তত সাদা বলের ক্রিকেটে। এই পেসত্রয়ীর পারফরম্যান্স আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে, সেই আশা পরবর্তীতে যেন হতাশাতে পরিণত না হয় সে রকমটাই হয়তো প্রত্যাশা ভক্ত-সমর্থকদের। এগিয়ে চলুক দেশের ক্রিকেট, আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করার জন্য একটা শক্ত পেস বোলিং আক্রমণ যে বড় দরকার!